বাংলাদেশের বীমা ব্যবসা|Bangladesh Insurance Business

বাংলাদেশে বীমা শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ এবং বীমা ব্যবসায়ের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের পেশাদারিত্বের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে নভেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স একাডেমি। স্বাধীনতার পূর্বে এদেশের অধিকাংশ বিমা কোম্পানির মালিক ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা এদেশের বিমা ব্যবসায়ের উন্নয়নে তেমন অবদান রাখেননি। স্বাভাবিকভাবে বীমা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পোশাদারিত্বের উন্নয়ন তখনও ঘটেনি। এ সমস্যা সমাধানে অবদান রাখছে বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স একাডেমি।

বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স একাডেমির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরূপ:

১. বীমা ব্যবসায়ের পেশাদারি শিক্ষা দান ও তাদের সনদ প্রদান।
২. বীমা ব্যবসায়ের সার্বিক অবস্থার ওপর গবেষণা ও বিরাজমান সমস্যা উদ্ঘাটন করা।
৩. বিমা ব্যবসায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বিশেষ করে সাধারণ বিমা কর্পোরেশন (SBC) ও জীবনবিমা কর্পোরেশন (JBC) এর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
৪. বৃহত্তর জনস্বার্থে বিমা সংক্রান্ত গবেষণা ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সুপারিশ প্রস্তাব করা এবং জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা।
৫. দেশ-বিদেশের বীমা বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা।
৬. বীমার ব্যবসায়ে অবদান রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা। বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স একাডেমি উপর্যুক্ত উপায়ে এদেশের বিমা ব্যবসায়ে অবদান রাখে।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কার্যাবলি|Functions & duties of authority of Insurance

অত্র আইনের ১৫ ধারা অনুসারে, কর্তৃপক্ষের মৌলিক কার্যাবলি ও দায়িত্ব হবে নিম্নরূপ:

১. বীমা ও পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণ করা
২. বিমা শিল্পের উন্নয়নে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করা
৩. বাংলাদেশ বিমা শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহের উন্নয়নে অবদান রাখা
৪. বীমা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার, সভা ইত্যাদির আয়োজন করা
৫. বীমাকারী, পুনঃবীমাকারী, মধ্যস্থতাকারীর নিবন্ধীকরণ এবং অনুরূপ নিবন্ধনের নবায়ন, সংশোধন, প্রত্যাহার বা বাতিলকরণ
৬. বীমা ও পুনঃবিমা মধ্যস্থতাকারী এবং এজেন্টদের আচরণবিধি সংক্রান্ত নিয়মাবলি এবং নির্দেশিকা প্রণয়ন
৭. জরিপকারীদের লাইসেন্স প্রদান এবং এর নবায়ন, সংশোধন, প্রত্যাহার, স্থগিত বা বাতিল করা
৮. বীমাযোগ্য স্বার্থ, জীবনবিমা পলিসির সমর্পণ মূল্য প্রভৃতি বিষয়ের মিমাংসা করা
৯. বীমাকারী ও বীমা মধ্যস্থতাকারীর হিসাবরক্ষণ প্রণালি এবং হিসাব বিবরণী প্রেরণের ছক নির্ধারণ
১০. একচ্যুয়ারিয়াল প্রতিবেদন প্রস্তুত করার ছক ও পদ্ধতি নির্ধারণ
১১. বীমা ও পুনঃবীমা কোম্পানির তহবিল ও বিনিয়োগ কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ের সমস্যা|Problems of Insurance Business in Bangladesh


বাংলাদেশের মতো দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিতে বীমার গুরুত্ব ও অবদান অনেক। স্বাধীনতার পরে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এদেশের বিমা শিল্পের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ঘটেনি। বীমার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না ঘটার পেছনে নিম্নোক্ত প্রতিবন্ধকতাসমূহ প্রভাব বিস্তার করে:

১. প্রশাসনিক দুর্বলতা (Weak administration): বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ ও যথাযথ বাস্তবায়নে দুর্বলতা রয়েছে। বীমা ব্যবসায়ও তার ব্যতিক্রম নয়। যে কারণে বিমা ব্যবসায়ে কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এতে বীমা ব্যবসায়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণামূলক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। ফলে বীমাগ্রহীতারা বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারে না।

আরো পড়ুন: বীমা কি?
আরো পড়ুন: বীমা ব্যবসায়ের মূলনীতি

২. পেশাদারিত্বের অভাব (Lack in professionalism): আধুনিক বিশ্ব এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায় জগতে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এদেশে বীমা শিক্ষা তেমন প্রসার লাভ করেনি। উচ্চতর প্রশিক্ষণদানের জন্য রয়েছে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনসিওরেন্স একাডেমি; যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।

৩. সেবার নিম্নমান (Lower service quality): বাংলাদেশে বিমা ব্যবসায় এখনো গতানুগতিক ধারায় পরিচালিত। ফলে আধুনিক বিমা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের যে ধরনের উন্নত সেবা প্রদান করে তা এদেশের বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ দিতে পারে না।

৪. দাবি পরিশোধে বিলম্ব (Delay in paying claims): বিমাগ্রহীতার বীমাকৃত বিষয়বস্তুর ক্ষতি হলে বীমাকারীর উচিত যথাশীঘ্র ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বীমাকারীগণ দাবির অর্থ পরিশোধে প্রায়শই বিলম্ব করে।এতে বীমাগ্রহীতারা অসন্তুষ্ট হন এবং বীমা কোম্পানিসমূহের ওপর তারা যথেষ্ট আস্থা রাখতে পারেন না।

৫. দুর্বল অর্থনীতি (Weak economy): বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশি হলে সেখানেই বীমা পরিসেবার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার কারণে বিমা পরিসেবার চাহিদাও কম; যা বীমা ব্যবসায়ের দ্রুত উন্নতির বড় অন্তরায়।

৬. নিম্ন আয় (Lower income): বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় কম। এ কারণে এখানে সঞ্চয়ের পরিমাণও কম। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অধিক সঞ্চয় বীমা ব্যবসায়ের বিশেষত, জীবনবীমার উন্নয়নে অবদান রাখে। বাংলাদেশে নিম্ন আয় তথা নিম্ন সঞ্চয় বীমা ব্যবসায়ের অন্যতম সমস্যা।

৭. অনুন্নত শিল্প (Under developed industry): বাংলাদেশে তেমন কোনো বৃহদায়তন শিল্পকারখানা নেই। কৃতিপয় বৃহৎ শিল্প বাদে এদেশের শিল্প প্রধানত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ বৃহদায়তন শিল্পকারখানায় অগ্নিবিমাসহ অন্যান্য বীমা পরিসেবার চাহিদা বেশি থাকে। অর্থাৎ বৃহৎশিল্প তেমন নেই বলে এদেশে অগ্লিবিমা ব্যবসায়ও উন্নতি লাভ করছে না। দুর্ঘটনা বীমাও শিল্পের উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল।

৮. নৌপরিবহন খাতের দুর্বলতা (Weakness in nevigation sector): বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর একটি দেশ। তাই প্রতিবছর বাংলাদেশকে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যপণ্য ও মূলধন সামগ্রী আমদানি করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই নৌপথে প্রচুর পরিমাণ পণ্যদ্রব্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। তাছাড়াও নদীমাতৃক এই দেশে যাতায়াত ব্যবস্থার অন্যতম বাহন নৌযান। তা সত্ত্বেও এ দেশের নৌপরিবহন খাত যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেনি । উন্নত নৌপরিবহন ব্যবস্থা বিমা ব্যবসায় বিশেষভাবে নৌবীমা ব্যবসায়ের উন্নয়নে অবদান রাখে। অনুন্নত নৌপরিবহন ব্যবস্থা বীমার উন্নয়নে বড় বাধা।

৯. জনসাধারণের আস্থার অভাব (Lack of public confidence): আমাদের দেশে বীমা ব্যবসায়ে নিয়োজিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সততা ও নিষ্ঠার বিষয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ যথেষ্ট আস্থাশীল না। তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এমন অনেক অসাধু বিমা ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব লক্ষ করা গেছে যারা প্রিমিয়াম হিসেবে অর্থ নিয়ে পরবর্তীতে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। সে কারণে জনসাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর তেমন আস্থাশীল নয়। জনগণের আস্থাহীনতা বীমা ব্যবসায়ের উন্নতিতে বড় বাধা।

১০. মূলধনের অভাব (Lack of capital): বৃহদায়তন ব্যবসায় হিসেবে বীমা ব্যবসায়ের গঠন ও পরিচালনায় প্রচুর মূলধন প্রয়োজন। কিন্তু এদেশে নিম্ন আয় ও সঞ্চয়ের কারণে বৃহদায়তন মূলধন যোগান দেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়। 

১১. প্রাচীন পদ্ধতি (Traditional strategy): বাংলাদেশে বিমা ব্যবসায় গঠন, পরিচালনা ও সেবাদানে এখনো গতানুগতিক ব্যবস্থা ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ফলে আধুনিক বিশ্বের সাথে এ দেশের বীমা ব্যবসায় তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। তবে অজস্র এ সমস্যাসমূহের উপযুক্ত সমস্যাগুলোই অধিকতর উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে বীমা শিল্পের সমস্য সমাধানের উপায়|Solutions for the Problems of Insurance Sector in Bangladesh


বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ে অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান। বীমা ব্যবসায়ের সমস্যাসমূহ দূর করা গেলে বীমা ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি লাভ করতে পারে। বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ে বিদ্যমান সমস্যাসমূহের সমাধান নিম্নোক্ত উপায়ে অর্জিত হতে পারে:

১. কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়ন (Effective policy formation): এদেশের বীমা ব্যবসায়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে এবং বিমাখাতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সবার আগে প্রয়োজন— দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন।

২. বীমা শিক্ষার ও প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রসার (Enhancement of education & training facilities for insurance): দক্ষ, আধুনিক ও মানসম্মত সেবা প্রদান বাংলাদেশের বীমা শিল্পের সম্প্রসারণের পূর্বশর্ত। বীমা ব্যবসায়ে জড়িত ব্যক্তিবর্গ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিমা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। এজন্য এদেশে উচ্চতর বিমা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ও উন্নত প্রশিক্ষণ সুবিধার সম্প্রসারণ আবশ্যক।

৩. গবেষণা ও উন্নয়ন (Research & Development): বীমা ব্যবসায়ের বিদ্যমান সমস্যাসমূহের সূক্ষ্মাতিসূ উদ্ঘাটন, চাহিদা অনুযায়ী সেবা প্রদান এবং বীমা ব্যবসায়ের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য পরোক্ষভাবে অবদান রাখে গবেষণা উন্নয়ন (R & D) কার্যক্রম। কিন্তু বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায় নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম একেবারেই অপর্যাপ্ত। কাজেই ফার্ম হতে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বীমা গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ আবশ্যক।

৪. প্রচারণামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি (Enhancement of publicity): বীমা ব্যবসায়ের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক ভিত্তিক প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা আবশ্যক। প্রচারণা বিমা বিষয়ে মানুষের ভুল ধারণা, অবিশ্বাস ও অনগ্রহ দূর করতে সহায়তা করে।

৫. বিমা ব্যবসায়ের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ (Increasing monitoring & regulating activities): অতীতে বাংলাদেশে বিভিন্ন নামে-বেনামে বিমা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং জনগণের নিকট হতে বিভিন্নভাবে প্রিমিয়ামের অর্থ আদায় করে উধাও হয়ে গেছে। বর্তমানেও এ সমস্যা বিদ্যমান। তাছাড়া অনেক বীমাকারী বীমাদাবি পরিশোধে গাফিলতি ও বিলম্ব করে। সর্বোপরি বীমাখাতে বিদ্যমান অন্যান্য সমস্যা সমাধানে বীমাখাতের আরও নিবিড় তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।

৬. বীমা ব্যবসায়ের আধুনিকায়ন (Modernization of insurance): বাংলাদেশে বিদ্যমান বিনা ব্যবসায় একেবারেই গতানুগতিক ধারার। ফলে আধুনিক ব্যবসায় ও জীবনের চাহিদা মেটাবার মতো বীমা পরিসেবা দিতে এ সকল বিনা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। কাজেই বাংলাদেশে বিমা ব্যবসায়ে নিয়োজিত সকল বিনা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা এবং সেবাদান প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন ও উন্নত প্রযুক্তির সংযোজন নিশ্চিত করা আবশ্যক।

৭. উদ্ভাবনমূলক বীমা পরিসেবা বৃদ্ধি (Providing innovative insurance service): বাংলাদেশে বিমা প্রতিষ্ঠানসমূহ শুধু গতানুগতিক বীমা সুবিধা ও সেবা প্রদান করে। কিন্তু বিমা ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবনমূলক নিত্য নতুন সেবা প্রদান।

৮. গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র বীমা সেবা চালু (Micro insurance for rural areas): বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামের দরিদ্র মানুষদেরকে বীমা সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার জন্য গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র বিমা সেবা কার্যক্রম চালু করা আবশ্যক।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনাময় খাতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বীমাখাত। এ খাতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপসমূহ ত্বরিত গতিতে গ্রহণ করা আবশ্যক।

বাংলাদেশে বীমা শিল্পের সম্ভাবনা|Prospects of Insurance Business in Bangladesh


বাংলাদেশে গত চার দশকে বীমা ব্যবসায়ের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হলেও এ খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা বিদ্যমান। বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনার উৎসসমূহ নিম্নরূপ:

১. অধিক জনসংখ্যা (Large population): বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ের উন্নতির প্রথম সম্ভাবনার উৎস এদেশের ব্যাপক লোকসংখ্যা। তাছাড়া ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য বর্ধিত বিমা সুবিধা প্রদান করতে হলে বিমা ব্যবসায়ের প্রসার ঘটাতেই হবে।

২. মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি (Increase in per-capita income): বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) আশাব্যঞ্জকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসাথে বাড়ছে মোট জাতীয় ও মাথাপিছু আয়। বর্ধিত আয়ের সাথে সাথে বাড়ছে সঞ্চয় প্রবণতা ও মূলধন গঠন যা পরোক্ষভাবে সকল ধরনের বিমা পরিসেবার চাহিদা বৃদ্ধি করছে। জাতীয় ও মাথাপিছু বর্ধিত আয় ক্রমাগতভাবে বীমার উন্নয়নে অবদান রাখছে।

৩. ক্ষুদ্র বীমার সুযোগ (Scope of micro insurance): বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। যাদের অধিকাংশ কৃষিজীবী ও নিম্ন আয়ের। তাদেরকে অত্যাধুনিক ও বৃহত্তর বিমা ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করা অসুবিধাজনক। এ ধরনের মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের মতো ক্ষুদ্র বীমার ব্যবস্থা করে তাদের বীমা পরিসেবার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। অর্থাৎ বিশেষ ধরনের ক্ষুদ্রায়তন ও গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র বিমাকারী প্রতিষ্ঠানের মতো বীমা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিমা সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব।

৪. বিনিয়োগের সুযোগ (Investment scope): বাংলাদেশে বিমাকারীরা প্রিমিয়াম হিসেবে যে অর্থ আদায় করে তা বিনিয়োগের লাভজনক ক্ষেত্র খুবই সামান্য। বিমা প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের তহবিল সাধারণত ট্রেজারি বিল, বন্ড ও ব্যাকিং প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে যা যথেষ্ট লাভজনক নয়। কিন্তু বর্তমানে বিমা কোম্পানিসমূহ গৃহায়ন এবং ইজারা প্রভৃতি লাভজনক খাতে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। বর্ধিত বিনিয়োগ সুযোগ বিমা ব্যবস্থার উন্নয়নে অবদান রাখছে।

৫. সরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধি (Increased government support): বিমাখাতের সর্বাত্মক উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার ২০১০ সালে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন-২০১০ প্রণয়ন করেছে। তাছাড়া উক্ত আইনের আওতায় ‘বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ' নামে বিশেষায়িত সংস্থা গঠন করেছে। বিমাখাতে শৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেলে বিমাখাতে আরও দ্রুত উন্নতি হবে।

৬. বীমা পরিসেবার মানোন্নয়ন (Improvement in insurance services): অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিমা কোম্পানিসমূহ বি পরিসেবার মানোন্নয়নে উন্নত প্রযুক্তির সংযোজন এবং প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী গঠন করছে যা বিমার গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করছে।

৭. বীমা শিক্ষার প্রসার (Expansion in insurance education): দেশে বিমা বিশেষজ্ঞ গড়ে তোলার জন্য উচ্চ বিশেষায়িত শিক্ষাদানের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স একাডেমি  উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে।

৮. সেবার বৈচিত্রায়ন (Service diversification): বাংলাদেশে বিমা কোম্পানিসমূহ সেবার মানোন্নয়নের পাশাপাশি নি পরিসেবার বৈচিত্রায়নও করছে । বর্তমানে প্রতিষ্ঠানসমূহ কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরে সেবার প্রচলন ও প্রসার ঘটাচ্ছে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে বিমা ব্যবসায়ের বর্তমান অবস্থা যথেষ্ট সন্তোষজনক না হলেও অদূর ভবিষ্যতে এদেশে বিমা উন্নতি লাভ করার অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান।

বাংলাদেশে বীমা ব্যবসায়ের বর্তমান অবস্থা|The Present Condition of Insurance Business in Bangladesh


ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে বীমা ব্যবসায়ের খুব একটা প্রসার ঘটেনি। অবশ্য ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে বেশ কতকগুলো বিমা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এ সময়ে বিমা কোম্পানিসমূহকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৩৮ সালে বিমা আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইন দীর্ঘকাল ধরে সর্বভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। দেশ ভাগ হওয়ার পর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে বিমা ব্যবসায়ের দ্রুত উন্নতি সাধিত হতে থাকে। এ সময়ে পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সমগ্র পাকিস্তানে বিমা ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি লাভ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বিমা ব্যবসায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। বিশেষ করে বাংলাদেশে যে সকল বিমা ব্যবসায় গড়ে উঠেছিল তার প্রায় সবগুলোরই মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিক শ্রেণির লোকজন। স্বাধীনতার পর নবগঠিত বাংলাদেশের সরকার এদেশের বিমা ব্যবসায়কে পুনর্গঠিত করার জোর প্রয়াস চালায়। ১৯৭২ সালে ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতির ৯৫ নং আদেশ বলে, বিদেশি বিমা কোম্পানি বাদে সকল বিমা কোম্পানিকে জাতীয়করণ করে। সকল বিমা কোম্পানিকে পাঁচটি বিমা কোম্পানির আওতায় নিয়ে আসে। ১৯৭৩ সালে আবার পাঁচটি সংস্থাকে ভেঙে দুটি বিমা সংস্থায় রূপান্তর করা হয়। যথা:

(ক) সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (SIC) এবং
(খ) জীবনবীমা কর্পোরেশন (JIC)

১৯৮৪ সালের সংশোধিত বীমা আইনে ব্যক্তিমালিকানায় বীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন দুটি বীমা কোম্পানি, ছাড়াও ৪৫ টি সাধারণ বীমা কোম্পানি ৩০ টি জীবনবীমা কোম্পানি রয়েছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url