বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা | Banking System in Bangladesh

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। নবগঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রের এক ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অভিযাত্রা। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনামলে এদেশে বেশ কিছু ব্যাংক ও তাদের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ সকল ব্যাংকের অধিকাংশেরই মালিক ছিল ভারতীয়। ফলে দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে ঐ সকল ব্যাংকের অনেকগুলোই এদেশ থেকে বিলুপ্তি ঘটে।

পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটলে এদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা আবার নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নিকট হতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এ সময় এ দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা আবার ভেঙে পড়ে। কারণ তৎকালীন পাকিস্তানে যে সকল ব্যাংক গড়ে উঠেছিল সেগুলোরও অধিকাংশের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা।


১৯৭১ সালে আবার এ দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। স্বাধীনতার চার দশকে ব্যাংক খাতে বাংলাদেশ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। বাংলাদেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬৫ টি। যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ৬ টি, ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ৩২ টি, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৯ টি, ইসলামি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৮ টি, বিশেষায়িত ব্যাংক ৬ টি, সমবায় ব্যাংক ৩ টি এবং ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী ব্যাংক (গ্রামীণ ব্যাংক) ১ টি।
Banking System in Bangladesh

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার সমস্যা |Problems of Banking System in Bangladesh


স্বাধীনতার অল্প সময় পর থেকে এক ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার যাত্রা। অনেক চড়াই উতরাই পার করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা আজকের অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাতে এখনও বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান, যা ব্যাংকিং খাতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন ব্যাহত করছে। ফলে ব্যাংকিং খাত দেশের অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত অবদান না। দেশের ব্যাংকিং খাত নিম্নোক্ত সমস্যাবলি পরিলক্ষিত হয়:

১. সমস্যাগ্রস্ত ঋণের আধিক্য (Problem of huge distressed credit): বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যাগ্রস্ত কম শু ভূষণের আধিক্য বিদ্যমান। আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত ঋণের গড় পরিমাণ ২-৫ শতাংশ হলেও ২০০১ সালে বাংলাদেশে এর পরিমাণ ছিল ৩১.৪১ শতাংশ।

২. অলাভজনক ব্যাংক ও ব্যাংক শাখার আধিক্য (Losing banks & bank branches): বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবসায় লিপ্ত অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর লোকসান দেয়। তাছাড়া কিছু সংখ্যক ব্যাংকের শাখাকেও প্রতিবছর লোকসান গুনতে হয়। অভাবনীয় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সোনালী ও জনতা ব্যাংকসহ কতিপয় ব্যাংক প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ লোকসানের মুখোমুখি হয়। তাছাড়া প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যে ব্যাংকের শাখা রয়েছে তার অধিকাংশই প্রতিবছর প্রচুর লোকসান বহন করে।

৩. ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন সম্পাদ অজ্ঞতা ও অনীহা (Ignorance & aversion in conducting transaction through banks): বাংলাদেশের জনসাধারণের একটি বড়ো অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন সম্পাদনে অপারগ ও অনিচ্ছুক। এতে সকল মানুষকে যেমন বৃহত্তর ব্যাংকিং পরিসেবার আওতায় নিয়ে আসা যায় না, তেমনি আমানত গ্রহণ মূলধন গঠন এবং কথদানসহ সামগ্রিক ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

৪. রাজনৈতিক প্রভাব (Political influence): বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিশেষত, সরকারি ব্যাংকসমূহে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবাঞ্চিত প্রভাব ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে। যা ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনায় প্রায়শই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বিপুল পরিমাণ সমস্যাগ্রস্ত ঋণ, লোকসানি ব্যাংক ও শাখাসমূহের নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে করা যাচ্ছে না- তারও একটি বড়ো কারণ রাজনৈতিক প্রভাব।

৫. গ্রাম্য আমানতের ছবিরতা (Stagnant rural deposit): বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানতের পরিমাণ সন্তোষজনকভাবে বাড়লেও মোট আমানতে গ্রামাঞ্চলের আমানতের অবদান মাত্র ২০ % -এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অর্থাৎ আমানতের ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চল তেমন বড়ো অবদান রাখতে পারছে না।

৬. মূলধনের স্বতা (Shortage of capital): উন্নয়নশীল দেশসমূহে অবকাঠামোগত উন্নয়নে নতুন শিল্প -কারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রভৃতি কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থায়ন প্রয়োজন। কিন্তু এদেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত হওয়ায় ব্যাংক বিপুল পরিমাণ মূলধনের চাহিদা মেটাবার মতো পর্যাপ্ত আমানত গ্রহণ ও মূলধন গঠন করতে পারে না।

৭. সেবার বৈচিত্রায়নের অভাব (Lower product diversification): বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত গতানুগতিক ব্যাংকিং পরিসেবা প্রদান করে । কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক আধুনিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করলেও অজ্ঞতার কারণে মানুষ সে সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না। তবে এ অবস্থার ক্রমোন্নতি হচ্ছে।

৮. দক্ষ জনশক্তির অভাব (Lack of skilled manpower): এদেশের প্রায় সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দক্ষ জনশক্তির অভাব বিদ্যমান। ব্যাংক ব্যবস্থাপক ও প্রধান কার্যনির্বাহী (CEO) প্রভৃতি পদের জন্য যোগ্য ও দক্ষ কর্মীর অভাব বিদ্যমান। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকসমূহে এ ধরনের সমস্যা কম থাকলেও সরকারি ব্যাংকসমূহে এ সমস্যা আরও প্রবল। কারণ কর্মী নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান। যে কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যোগ্য লোক নিয়োগ ও পদোন্নতি পায় না।

৯. প্রশিক্ষণ সুবিধার অভাব (Lack of training facilities): ব্যাকিং খাতে নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গুত্বপূর্ণ। অবদান রাখে প্রশিক্ষণ। অথচ দীর্ঘকাল ধরে ব্যাংক কর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত। ব্যাংকসমূহ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্ন কর্মীদের প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করে না। ব্যাংক কর্মীদের প্রশিক্ষণে নিয়োজিত শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট (Bangladesh Institute of Bank Management- BIBM) ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এক্ষেত্রে অবদান রাখলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না।

১০. গবেষণা ও উন্নয়নের অভাব (Lack of research & development effort): অন্যান্য সকল খাতের ন্যায় ব্যাংকিং খাতে গবেষণা খুবই কম হয়। সে কারণে এ খাতের সমস্যাগুলো আবিষ্কার ও তা নিরসনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য -উপাত্ত পাওয়া যায় না।

১১. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব (Lack of transparency and accountability): বাংলাদেশে আইন প্রণয়নে, গীত আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে যথেষ্ট শিথিলতা বিদ্যমান। যা ব্যাংকিং খাতেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে না। এতে গ্রাহকগণ অনেক সময় ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না।

পরিশেষে বলা যায়, অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ এ দেশে ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নে অনেক সমস্যা বিদ্যমান। দুর্বল অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে উপর্যুক্ত সমস্যাসমূহ বিদ্যমান।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে করণী Recommendations for Solving Problems of Banking Sector in Bangladesh


বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান সমস্যা অনেক। এসকল সমস্যার রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। তবে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান সমস্যা নিম্নোক্ত উপায়ে সমাধান করা যায়: 

১. সমস্যাস্ত ঋণ সমস্যা সমাধানে ব্যাংকসমূহকে ঋণদানের ক্ষেত্রে আরও দূরদর্শিতা অবলম্বন , প্রদত্ত ঋণের তদারকি আবশ্যক।

২. অলাভজনক ব্যাংক শাখাসমূহের সংঙ্কার, প্রয়োজনে সেগুলো কব করা।

৩. ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন সম্পাদনে জনসাধারণের আগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার ও প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।

৪. গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করার সর্বাত্মক প্রয়াশ চালানো।

৫. ব্যাংক প্রদত্ত সেবার বৈচিত্র্যায়ন, আধুনিকায়ন ও উন্নততর ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিতকরণ।

৬. দক্ষ জনশক্তি নিয়োগে সচেষ্ট হওয়া।

৭. ব্যাংক কর্মীদের প্রশিক্ষণের সুবিধা সম্প্রসারণ।

৮. গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ। পরিশেষে ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করে এদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব।

বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ বিধান Regulatory Framework of Banking System in Bangladesh 


আর্থিক ব্যবস্থায় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর্থিক ব্যবস্থায় যেকোনো ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ব প্রতারণা সম্পূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিতে পারে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সামগ্রিক জার্থিক ব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা গু অংশ। সে কারণে বিশ্বের সকল দেশেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গড়ে উঠেছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url