শাখা ব্যাংক‌ বা শাখা ব্যাংকিং | Branch Banking

শাখা ব্যাংকিং কি | What is Branch Banking?


যে ব্যাংক একটিমাত্র কেন্দ্রীয় অফিসের নিয়ন্ত্রণে থেকে অনেকগুলো শাখা অফিসের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাকে শাখা ব্যাংক বলে। ব্যাপক অর্থে, যে ব্যাংক দেশে-বিদেশে একই নামে অনেকগুলো শাখা অফিস খুলে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় অফিসের মাধ্যমে শাখাগুলো পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে সেই ব্যাংককে শাখা ব্যাংক বলে।

শাখা অফিসগুলোর উন্দ্র কেন্দ্রীয় অর্কিসের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থাকে এবং সকল শাখার আদর্শ ও নীতি একই থাকে । শাখা ব্যাংকের কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে উল্লেখ করা হলো: M. C. Vaish- এর মতে,

The branch banking is a system that a single bank operates in the country through countrywide network of branches.

অর্থাৎ শাখা ব্যাংকিং পদ্ধতি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে একক অফিসের দেশের ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়। Prof. Mclead- এর মতে,

Branch banking system is that system of banking which controls and maintain many Horanches either within the country or in abroad.

অর্থাৎ যে ব্যাংক ব্যবস্থায় দেশে -বিদেশে অনেকগুলো শাখা খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাকে শাখা ব্যাংক ব্যবস্থা বলে। উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটি সম্প্রসারিত ব্যাংক ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থায় একটি প্রধান অফিসের অধীনে অনেকগুলো শাখা অফিস পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।

শাখা ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য | Features of branch banking


বৃহদায়তন মূখন ও অনেকগুলো শাখার মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদানের সুযোগ থাকায় শাখা ব্যাংকের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. শাখা অফিস (Branch office): শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকসমূহ দেশে-বিদেশে শাখা অফিস খুলে ব্যাংকিং পরিসেবা প্রদান করে। শাখা ব্যাংক মূলত একই নামে দেশে-বিদেশে শাখা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে।

২. কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ (Centralized control): দেশ -বিদেশের সকল শাখা কার্যালয়ই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিয়ষ্মণাধীনে থাকে। কেন্দ্রীয় কার্যালয় কর্তৃক প্রস্তাবিত নীতি - পদ্ধতি অনুসরণে শাখা অফিসসমূহ বাধ্য থাকে।

৩. শাখা অফিসের স্বাধীনতা (Independence of branches): প্রধান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকলেও শাখা ব্যবস্থাপকগণ শাখা অফিসের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেন।

৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সুসম্পর্ক (Relation with central bank): শাখা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে। শাখা ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক যেমনি নিয়স্থতি হয় তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত সেবা ও সহযোগিতাও লাভ করে।

৫. বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান (Large organization): শাখা ব্যাংক একটি বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। শাখা ব্যাংকের কার্যক্রম, কার্যক্ষেত্র, মূলধনের পরিমাণ বেশি থাকে। পরিশেষে বলা যায়, শাখা ব্যাংক অধিক সামর্থ্যসম্পন্ন বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান। দেশে-বিদেশে শাখা অফিস খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এর মূল নিয়ন্ত্রণ তার কেন্দ্রীয় অফিসের ওপর ন্যস্ত থাকে।

শাখা ব্যাংকের সুবিধা | Advantages of branch banking


শাখা ব্যাংক একই নামে দেশে-বিদেশে অফিস খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। শাখা ব্যাংক সাধারণত যৌথমূলধনি বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান। বিপুল মূলধন ও সামর্থ্যের কারণে শাখা ব্যাংক বেশ কিছু সুবিধা লাভ করে। শাখা ব্যাংকের সুবিধাসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. দক্ষ সেবা (Efficient service): শাখা ব্যাংক উন্নততর ব্যাংকিং সেবা দিতে সক্ষম। শাখা ব্যাংকের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সেবাদানের গড় ব্যয় কম হয়। তাছাড়া বৃহদায়তন হওয়ার কারণে কর্মের বিভাজন ও বিশেষায়নের সুযোগ বেশি থাকে। এতে দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি ব্যাংকিং সেবাদানের ব্যয়ও হ্রাস পায়।

২. বৃহৎ কার্যক্ষেত্র (Wide work place): শাখা ব্যাংক দেশে-বিদেশে শাখা অফিস খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে ব্যাংকিং পরিসেবার আওতা বিস্তৃত হয়।


৩. সহজ বৈচিত্রায়ন (Diversification): শাখা ব্যাংক বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে। এতে বৈচিত্রায়ন অর্জন যেমন সহজ হয় তেমনি ঝুঁকির পরিমাণও হ্রাস করা যায়।

৪. সুদের হারে সমতা (Parity in interest rate): শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অল্প সংখ্যক ব্যাংক সারা দেশে ব্যাংকিং ব্যবসায় পরিচালনা করে বলে সারা দেশে ব্যাংকিং খাতে সুদের হারে সমতা বিরাজ করে।

৫. দক্ষ নগদ ব্যবস্থাপনা (Efficient cash management): শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অর্থ স্থানান্তর সহজসাধা। এতে ব্যাংকের অলস উদ্বৃত্ত নগন অর্থ থাকে না। ফলে নগন ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষতা ও অধিক উপার্জনশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

৬. দক্ষ কর্মী (Efficient worker): শাখা ব্যাংকের সামর্থ্য বিপুল। এতে দক্ষ কর্মী নিয়োগদান যেমন সম্ভব তেমনি প্রশিক্ষণ প্রদান , তুলনামূলক অধিক প্রণোননা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা সহজ হয়।

৭. অর্থ স্থানান্তর (Money transfer): শাখা ব্যাংক নিজ শাখার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে যত্রতত্র দ্রুত ও কম খরচে অর্থ স্থানান্তর করতে পারে। এতে লেনদেন সম্পাদনে যেমন গতিশীলতা আসে তেমনি দক্ষতাও অর্জিত হয় এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটে।

৮. কার্যকরী সিদ্ধান্ত (Effective decision): শাখা ব্যাংকের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বেশি থাকে বলে ব্যাংকিং ও অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ নিয়োগের সুযোগ পায়। এতে শাখা ব্যাংকের পক্ষে তুলনামূলক ভালো বিনিয়োগ ও ঋণদান সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়।

৯. প্রচার সুবিধা (Publicity): শাখা ব্যাংক সারা দেশে ব্যাংকিং পরিসেবা প্রদান করে। এতে ব্যাংক সারা দেশের মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পায়। ফলে এ ধরনের ব্যাংকের পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতাও বেশি হয়।

১০. গ্রাহকের আস্থা (Customer confidence): শাখা ব্যাংক সারা দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যক্ষ নিরম্নণাধীনে থাকে বলে এ ধরনের ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থাও বেশি থাকে। সুবিধা এবং গ্রাহকের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়। পরিশেষে বলা যায়, শাখা ব্যাংক বিপুল জয়তন ও মূলধনসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দক্ষ সেবা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, অর্থ স্থানান্তরের সুবিধা এবং গ্ৰাহকের আস্হা অর্জনে সমর্থ হয়।

শাখা ব্যাংকিংয়ের অসুবিধা | Disadvantages of branch banking


শাখা ব্যাংক বৃহদায়তন ও অধিক সামর্থ্যসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এর বেশ কিছু অসুবিধা রয়েছে। শাখা ব্যাংকে সি গ্রহণে জটিলতা সমন্বয়হীনতা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। শাখা ব্যাংকের মৌলিক সমস্যাসমূহ নিম্নরূপ : 

১. বিলম্বিত সিদ্ধান্ত (Late in decision making): শাখা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে জটিলতা দেখা দেয়। কারণ শাখা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা, বিচিত্র ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। এতে তথ্য সপ্তাহ, প্রক্রিয়াকরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ব্যাংকে অব্যবস্থাপনা ঘটে। 

২. একচেটিয়া প্রবণতা (Monopoly): শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মাত্র কতিপয় ব্যাংক সারাদেশে ব্যাংকিং ব্যবসায় পরিচালনা করে। এতে ব্যাংকসমূহের মধ্যে একচেটিয়া প্ৰকাতা দেখা দেয়। দেশের বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ও সম্পদ মাত্র কতিপয় ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের নিকট কেন্দ্রীভূত হওয়ায় তারা স্বেচ্ছাচারিতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যা অনেক সময় দেশে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি করে।

৩. সিদ্ধান্তে জটিলতা (Complexity in decision making): শাখা অফিসকে যেকোনো ধরনের বড়ো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অফিসের অনুমতি নিতে হয়, যা উদ্যোগ গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

৪. আঞ্চলিক বৈষম্য (Regional disparity): শাখা ব্যাংক আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। শাখা ব্যাংক সমগ্র দেশ হতে তহবিল সংগ্রহ করলেও সাধারণভাবে শিল্পোন্নত অঞ্চলসমূহে তা ঋণ আকারে বিতরণ করে। এতে সুবিধা বঞ্চিত অঞ্চলসমূহ আরও পিছিয়ে পড়ে।

৫. অযৌক্তিক প্রতিযোগিতা (Irrational competition): শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা একই এলাকায়। কেন্দ্রীভূত হয় বলে শাখা অফিসসমূহের মধ্যে এক ধরনের অযৌক্তিক প্রতিযোগিতার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

৬. সমস্বয়হীনতা (Lack of combination): শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অসংখ্য শাখার মধ্যে অনেক সময় সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়।

৭. লোকসানি শাখার প্রভাব (Impact of lossing branch): শাখা ব্যাংকের লোকসানি শাখাসমূহ লাভজনক শাখার কার্যক্রমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। পরিশেষে বলা যায়, শাখা ব্যাংক বৃহদায়তন ব্যাকিং প্রতিষ্ঠান। অধিক মূলধন, সহজ বৈচিত্রায়ন, অর্থ স্থানান্তরসহ বেশ কিছু বিষয়ে শাখা ব্যাংকিং অনেক সুবিধাজনক। তা সত্ত্বেও শাখা ব্যাংকের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতা, সমন্বয়হীনতাসহ আরও কিছু অসুবিধা বিদ্যমান।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url