চেকের ধারণা | Concept of Cheque

মি. মহিন একজন পুস্তক প্রকাশক। তাকে প্রায়শই কাগজ কিনতে হয়। কাগজ সরবরাহকারীগণকে তিনি নগদ অর্থ না দিয়ে ব্যাংক সরবরাহকৃত একটা ছাপানো ফরম পূরণ করে ও তাতে টাকার অঙ্ক লিখে এবং স্বাক্ষর দিয়ে তা প্রদান করেন। সরবরাহকারীগণ কখনও সরাসরি ব্যাংকে ঐ দলিল উপস্থাপন করে। আবার কখনও নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে তা জমা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন। কখনও সরবরাহকারীগণ মি. মহিন থেকে প্রাপ্ত ঐ কাগজখও অন্যের পাওনা পরিশোধে হস্তান্তর করেন। হস্তান্তরগ্রহীতা পুনরায় তা আবার হস্তান্তর করতে পারেন। এভাবে একাধিক লেনদেন বা পাওনা পরিশোধে কাগজখণ্ডটি ব্যবহৃত হয়। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ও সমাদৃত এ কাগজটি নিঃসন্দেহে চেক।

আমানতকারী ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন বা কাউকে অর্থ পরিশোধের জন্য ব্যাংক সরবরাহকৃত নির্দিষ্ট ছাপা ফরমে যে নির্দেশপত্র প্রণয়ন করে তাকে চেক বলে। 

আরো পড়ুন: বাহক চেক কি?
আরো পড়ুন: দাগকাটা চেক কি?

চেক হলো এমন একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল যা ব্যাংক সরবরাহকৃত চেকের পাতায় লেখা হয় এবং আমানতকারী তার ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের অনুরূপ স্বাক্ষর এতে প্রদান করেন। এতে চেকে উল্লিখিত কোনো ব্যক্তি (প্রাপক) কে বা তার আদেশে কোনো ব্যক্তিকে বা বাহককে অর্থ প্রদানের নির্দেশ প্রদত্ত হয়। অবশ্য আমানতকারী বা আদেষ্টা প্রাপকের স্থলে নিজ বা Self শব্দ। লিখে নিজেও প্রাপক বিবেচিত হতে পারেন। সবকিছু ঠিক থাকলে এর অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধে ব্যাংক বাধা থাকে। এ সম্পর্কেই বাংলাদেশ বহাল ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে যে, চেক হলো এক ধরনের বিনিময় বিল (শর্তহীন নির্দেশপত্র) যা কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংকের ওপর কাটা হয় এবং যার অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধ্য।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে চেকের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করা যায়:

১. চেক হলো অর্থ প্রদানের শর্তহীন নির্দেশনামা
২. আমানতকারী তার ব্যাংকারকে চেকের মাধ্যমে এরূপ নির্দেশ দিয়ে থাকে
৩. আমানতকারী নিজকে প্রাপক কোনো ব্যক্তিকে বা বাহককে অর্থ প্রদানের জন্য এর মাধ্যমে নির্দেশ।
৪. প্রাপক বা বাহক ব্যাংক কাউন্টার থেকে সরাসরি বা তার ব্যাংকের মাধ্যমে এর অর্থ সংগ্রহ করতে পারে এবং
৫. সবকিছু ঠিক থাকলে চেকের অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধ্য।

চেকের বৈশিষ্ট্য | Features of Cheque
 

আইন অনুযায়ী চেক হলো এক ধরনের বিনিময় বিল। অর্থাৎ এটি অর্থ প্রদানের একটি শর্তহীন নির্দেশনামা। বর্তমানকালে সকল সমাজেই চেক কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এর বহুল ব্যবহার হতেই উপলব্ধি করা যায়। এর যে সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় তা নিম্নরূপ:

১. লিখিত দলিল (Written documents): যে কোনো দলিলই লিখিত হয়ে থাকে। চেক যেহেতু এক ধরনের হস্তান্তরযোগ্য দলিল তাই এটাও যথানিয়মে লিখতে হয়। ব্যাংক কর্তৃক সরবরাহকৃত নির্দিষ্ট ছাপানো চেকের পাতায় চেক লেখা হয়। এরূপ লেখা বলতে শুধুমাত্র হাতে লেখাই বুঝায় না, টাইপ করেও তা লেখা হতে পারে।

২. যথাযথ পক্ষ কর্তৃক স্বাক্ষরিত (Signed by the appropriate party): চেক অবশ্যই আমানতকারী কর্তৃক স্বাক্ষরিত হতে হয়। এরূপ স্বাক্ষর ব্যাংকে রক্ষিত আমানতকারীর নমুনা স্বাক্ষরের সাথে মেলা আবশ্যক। স্বাক্ষর না মিললে ব্যাংক চেক ফেরত দেয়।

৩. একাধিক পক্ষ (Pluralities of parties): চেকে সর্বদাই একাধিক পক্ষ থাকে। এর এক পক্ষে থাকে চেকের আদেষ্টা বা আমানতকারী এবং অন্যপক্ষে থাকে আদিষ্ট বা ব্যাংক। চেকের মাধ্যমে আদেষ্টা যাকে অর্থ প্রদানের নির্দেশ দেয় তাকে বলা হয় প্রাপক। এ ছাড়াও এর সাথে অন্য বিভিন্ন পক্ষ যুক্ত হতে পারে।

৪. শর্তহীন প্রকৃতি (Unconditional nature): চেকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি শর্তহীন প্রকৃতির হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমানতকারী, ব্যাংককে চাহিবামাত্র অর্থ প্রদানের শর্তহীন নির্দেশ দেয় । তাই চেক সম্পর্কিত আইনের ধারাতে বলা হয়েছে, “চেক হলো এক ধরনের বিনিময় বিল  শর্তহীন দলিল যার অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধ্য”।

৫. হস্তান্তরযোগ্যতা (Transferability): চেক সাধারণভাবে অর্পণের দ্বারা অনেকটা নগদ অর্থের মতই হস্তাস্তরযোগ্য হয়ে থাকে। বাহককে দেয় (Payable to bearer) চেকের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অর্পণের দ্বারা তা হস্তান্তর করা যায় এবং হস্তান্তরগ্রহীতা এতে স্বত্ব লাভ করে। আদেশে দেয় (Payable to order) চেকের ক্ষেত্রে তা পৃষ্ঠাঙ্কনের মাধ্যমে হস্তান্তর করা যায়।

৬. নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের উল্লেখ (Mention of certain sum of money): চেকে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের উল্লেখ থাকে। এরূপ অর্থের পরিমাণ যদি নির্দিষ্ট না হয়। যেমন- ১,০০০ বা ২,০০০ টাকা প্রদান করুন এরূপ নির্দেশ সম্বলিত চেককে চেক হিসেবে গণ্য করা যায় না। এরূপ অর্থের পরিমাণ কথায় ও অঙ্কে একই পরিমাণ লিখা আবশ্যক।

৭. তারিখের উল্লেখ (Mention of date): চেকে প্রস্তুত তারিখের উল্লেখ করতে হয়। এটাও এর একটি বৈশিষ্ট্য। এতে যদি প্রস্তুত তারিখের উল্লেখ না থাকে, তবে ব্যাংক চেকের অর্থ পরিশোধ করে না। ভবিষ্যত তারিখের চেকে যেমনি ব্যাংক টাকা দেয় না তেমনি প্রস্তুত তারিখ যদি উপস্থাপন তারিখ থেকে ছয় মাস পূর্ববর্তী হয় তবেও ব্যাংক চেক অমর্যাদা করে।

৮. প্রাপকের নামোল্লেখ (Mention the name of payee): চেকে প্রাপকের নামোল্লেখের একটা কলাম থাকে। চেকের আদেষ্টা এখানে প্রাপকের নাম উল্লেখ করে। অবশ্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে চেকের আদেষ্টা নিজ বা Self শব্দের উল্লেখ করতে পারে। এতে আদেষ্টা নিজেই প্রাপক হিসেবে গণ্য হয়। অবশ্য বাহকের চেকে প্রাপকের নামের ঘরে কিছু না লিখলেও ব্যাংক এর অর্থ বাহককে প্রদান করতে পারে।

৯. বিহিত মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ (Payment by legal tender money): এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো দেশের অভ্যস্তরে এর অর্থ অবশ্যই দেশের বিহিত মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। বিহিত মুদ্রা বলতে সরকারি নোট (১ বা ২ টাকার নোট) ও ব্যাংক নোট (৫, ১০, ৫০০ টাকার নোট) -কে বুঝায়। এর বাইরে কোনো অর্থ গ্রহণে এর প্রাপক বা ধারককে বাধ্য করা যায় না।

১০. চাহিবামাত্র প্রদেয় (Payable on demand): চেক চাহিবামাত্র পরিশোধ্য একটি দলিল। সব কিছু ঠিক থাকলে এবং যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হলে ব্যাংক চাহিবামাত্র চেকের অর্থ পরিশোধে বাধ্য থাকে। অবশ্য আদেষ্টা পরবর্তী কোনো তারিখের উল্লেখ করে তৈরির তারিখ থেকে নির্দিষ্ট সময় পরে এর অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারে।

১১. উপস্থাপন (Presentation): চেকের অর্থ সংগ্রহের জন্য এর প্রাপক বা ধারককে ব্যাংকের নিকট তা যথানিয়মে উপস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। বাহকের চেক ও হুকুম চেক সরাসরি ব্যাংক কাউন্টারে উপস্থাপন করে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। প্রাপকের হিসাবে জমা দিয়েও এর অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা চলে। দাগকাটা চেক ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে অর্থাৎ ব্যাংকের মাধ্যমে উপস্থাপন করে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে।

১২. দাগকাটার সুযোগ (Facilities of crossing): চেকের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো এর উপরিভাগে সাধারণত বামপার্শ্বে দু'টো আড়াআড়ি দাগ দিয়ে, এর ভিতরে কিছু লিখে বা না লিখে এর ধারক বা প্রাপক একে দাগকাটা চেকে পরিণত করতে পারে। এতে চেকটি সরাসরি ব্যাংক কাউন্টার হতে ভাঙ্গানো যায় না। প্রাপকের হিসাবে তা জমা দিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়।

১৩. ঋণের প্রমাণ (Proof of burden): চেক সবসময়ই ঋণের প্রমাণ হিসেবে আদালতে গৃহীত হয়। অর্থাৎ কোনো চেক যথানিয়মে উপস্থাপনের পরও তা অমর্যাদাকৃত হলে এর জন্য দায়ী পক্ষ সংশ্লিষ্ট অন্যদের নিকট দায়বদ্ধ থাকে।‌‌সেক্ষেত্রে কোনরূপ স্বাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই অমর্যাদাকৃত চেকটি দায় নির্ধারণে যথেষ্ট বিবেচিত হয়।

হারানো চেকের জন্য করণীয় |Duties for a Lost Cheque


প্রস্তুতের পর অথচ উপস্থাপনের পূর্বে কোনো চেক হারানো গেলে তাকে হারানো চেক বলে। চেক লেখার পর অথচ প্রাপকের নিকট হস্তান্তরের পূর্বে চেক হারানো গেলে এবং উক্ত চেকের উদ্ধারকারী ব্যাংক থেকে তা উত্তোলন করে নিলে সেক্ষেত্রে উক্ত চেকের দায় আমানতকারীর ওপর বর্তে। তবে প্রাপককে হস্তান্তর করার পর তা হারানো গেলে প্রাপক আমানতকারীকে তা যথাসময়ে না জানালে এবং উক্ত চেকের অর্থ অনুরূপভাবে উঠানো হলে সেক্ষেত্রে ঐ দায় প্রাপককে বহন করতে হয়।

এভাবে কোনো হস্তান্তরগ্রহীতার নিকট থেকে চেক হারানো গেলেও যদি সে হস্তাত্তরকারীকে না জানায় তবে সেক্ষেত্রেও দায় হস্তান্তরগ্রহীতার ওপর বর্তে। তবে যথানিয়মে জানানোর পরও ব্যাংক পরবর্তীতে চেকের অর্থ প্রদান করলে তার দায় ব্যাংককে বহন করতে হয়। তাই চেক হারানো গেলে পক্ষসমূহের করণীয় নিম্নরূপ:

১. আমানতকারী বা আদেষ্টার করণীয় (Duty of drawer): চেক হারানো গেলে এবং বিষয়টি আদেষ্টার নজরে আসলে অথবা প্রাপক বা হস্তান্তরগ্রহীতা কর্তৃক তাকে এ বিষয়ে জানানো হলে সেক্ষেত্রে আদেষ্টার করণীয় হলো লিখিতভাবে তা ব্যাংককে অবহিত করা। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট চেক নম্বরের বিপক্ষে অর্থ পরিশোধ না করার জন্য ব্যাংককে অবহিত করা হয়।

২. প্রাপক বা হস্তান্তরগ্রহীতার করণীয় (Duty of payee or indorsee): প্রাপক বা পরবর্তী কোনো হস্তান্তরগ্রহীতার নিকট থেকে চেক হারানো গেলে সেক্ষেত্রে যিনি হারিয়েছেন তার দায়িত্ব হলো পূর্ববর্তী পক্ষকে যথানিয়মে লিখিতভাবে তা অবহিত করা। এরূপ জানার জ্ঞাত পক্ষের কর্তব্য হলো তার পূর্ববর্তী পক্ষকে একইভাবে তা জানানো। এভাবে আদেষ্টা জানলে তার কর্তব্য হলো ব্যাংকে অবহিত করা।

৩. ব্যাংকের করণীয় (Duty of bank): হারানো চেকের বিষয়ে আমানতকারী কর্তৃক লিখিত বিজ্ঞপ্তি পেলে বা জ্ঞাত হলে ব্যাংকের করণীয় হলো আমানতকারীর ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ স্থগিত করা। এতে আমানতকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই নির্দিষ্ট চেক নম্বরের বিপক্ষে অর্থ প্রদান বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে হিসাব নম্বর থেকে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পুনরায় বহাল করা যেতে পারে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url