নিকাশ ঘরের ধারণা|Concept of Clearing House in Banking

নিকাশ ঘর কি? What is Clearing House in Banking


নিকাশ ঘরের ইংরেজি প্রতিশব্দ “Clearing house Clearing”। শব্দের অর্থ পরিচ্ছন্ন করা বা নিষ্পত্তি করা এবং house বলতে নির্দিষ্ট স্থানকে বোঝায়। কাজেই Clearing house বা নিকাশ ঘর বলতে লেনদেন নিষ্পত্তির স্থানকে বুঝায়। ব্যাংকিং শাস্ত্রে নিকাশ ঘর কথাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় লেনদেন নিষ্পত্তির উপায়কে নির্দেশ করা হয়।

নিকাশ ঘর এর উদ্ভাবক কে?


অর্থনীতিবিদ আরভিল নিকাশ ঘর ধারণার উদ্ভব ঘটান। বিভিন্ন ব্যাংকের মধ্যে সম্পাদিত লেনদেনের ফলে ব্যাংকসমূহের মধ্যে উদ্ভূত দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির উপায় ও প্রক্রিয়া হচ্ছে নিকাশ ঘর। কেন্দ্রীয় নিজস্ব ব্যবস্থায় ব্যাংকসমূহের মধ্যকার আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনা নিষ্পত্তিতে ভূমিকা পালন করে। যেহেতু সকল ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে হিসাব থাকে তাই আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির কাজটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অত্যন্ত সহজে সম্পাদন করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন শাখা অফিসের সহায়তায় দেশের সর্বত্র নিকাশ ঘর কার্যক্রম পরিচালনা করে। অবশ্য কোনো জায়গায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা না থাকলে অন্য কোনো ব্যাংকের সহায়তায় নিকাশ কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারে। যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংক নিকাশ ঘর কার্যক্রমের জন্য সোনালী ব্যাংকের সহায়তা গ্রহণ করে।

বর্তমানে ব্যাংকসমূহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশে শাখা অফিস খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পাদন করে। ব্যাংকিং কার্যক্রমে প্রয়োছ গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকসমূহ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। ব্যাংকসমূহ অন্য ব্যাংকের চেক, বিল প্রভৃতির লেনদেন সম্পাদন করতে গিয়ে এক ব্যাংকের অন্য ব্যাংকের দেনা-পাওনা সৃষ্টি হয়। এর ফলে এক ব্যাংকের নিকট হতে নিজস্ব উপায়ে অন্য ব্যাংকের নিকট হতে অর্থ আদায় করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যবহুল হয়ে পড়ে। এ কারণে ব্যাংকসমূহ পারস্পরিক দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়।

উল্লেখ্য বর্তমান ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থার উদ্ভবের ফলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকাশ ঘরে নির্দিষ্ট সময়ে স্ব-শরীরে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এরূপ চেক সংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকাশ ঘরে যা ACH (Automated Clearing House), বাংলাদেশে BACH (Bangladesh Automated Cleraring House) নামে পরিচিত সেখানে প্রেরণ করে। নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। পদ্ধতিগত উন্নয়ন ঘটলেও নিকাশ ঘর ব্যবস্থা পূর্ববৎ বিদ্যমান এবং তা আরো বেশি কার্যকর হয়েছে।

Oxford Dictionary of Business- এ বলা হয়েছে,
নিকাশ ঘর হলো সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীভূত ও স্বয়ংক্রিয় একটি পদ্ধতি।
নিকাশ ঘরের ধারণা

নিকাশ ঘরের বৈশিষ্ট্য|Features of Clearing House in Banking


১.নিকাশ ঘর হলো আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির স্থল
২. এটি একটি প্রাত্যহিক লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা
৩. কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিকাশ ঘর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করে
৪. নির্দিষ্ট সময়ে সদস্য ব্যাংকসমূহ তাদের পাওনার প্রমাণ ও বিবরণসমেত বিবরণাদি এখানে ইমেজ আকারে প্রেরণ করে এবং
৫. ইলেক্ট্রনিক ক্লিয়ারিং পদ্ধতি অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সদস্য ব্যাংকসমূহের হিসাবকে ডেবিট বা ক্রেডিট করে লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে।

নিকাশ ঘরের গুরুত্ব Importance of Clearing House  in Banking


ব্যাংক ব্যবসায়কে গতিশীল ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিনই কার্যকর সহায়তা প্রদান করে চলেছে তাই হলো নিকাশ ঘর। চেকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন বিশেষভাবে সম্ভব হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতার কারণেই। নিম্নে নিকাশ ঘরের গুরুত্ব বা সুবিধাসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. মিতব্যয়ী পন্থা (Economic policy): দেনা-পাওনা মীমাংসার জন্য নিকাশ ঘর ব্যবস্থা একটি মিতব্যয়ী পন্থা। এটা থাকার ফলে ব্যাংকসমূহ নির্ধারিত পন্থায় সুশৃঙ্খলভাবে কম খরচে নিজেদের মধ্যকার দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করতে পারে।

২. সময়ের সাশ্রয় (Time saving): এই ব্যবস্থায় চেক বা ড্রাফটের টাকা সংগ্রহের জন্য আদিষ্ট ব্যাংকে যেতে হয় না বলে এগুলোর অর্থসংগ্রহে অনেক সময় বাঁচানো যায়।

৩. লেনদেনের সুবিধা (Advantages of transactions): নিকাশ ঘর থাকার দরুন ব্যবসায়ীরা গ্রাহক বা দেনাদারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত চেক অতি অল্পসময়ে ব্যাংকের মাধ্যমে ভাঙাতে পারে। ফলে ব্যবসায়িক লেনদেন ত্বরান্বিত হয়।

৪. দেনা-পাওনার দ্রুত নিষ্পত্তি (Quick settlement of transactions): নিকাশ ঘরের মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ব্যাংকগুলো পারস্পরিক দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করতে পারে। এর অবর্তমানে ব্যাংকগুলোকে দেনা পাওনার নিষ্পত্তির জন্য বহু ঝামেলা পোহাতে হতো।
 
৫. ব্যাংকের নগদ আমানতের ওপর প্রভাব (Influence on the cash deposit of bank): নিকাশ ব্যবস্থা ব্যাংকগুলোকে স্বল্প পরিমাণ নগদ তহবিল নিয়ে কাজ কারবার চালাতে সাহায্য করে। এ ব্যবস্থা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ সৃষ্টিরও সহায়ক।

৬. অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনে সহায়তা (Assistance in realising economic condition): নিকাশ ঘর থাকলে সদস্য ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে গৃহীত চেক নগদ আদায়ের নিমিত্তে নিকাশ ঘরে জমা দেয়। নিকাশ ঘরে সকল চেক জমা হয়। এ থেকে নিকাশ ঘরের আওতাধীন অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়।

৭. অর্থ স্থানান্তরের সহায়ক (Helpful in transfer of money): নিকাশ ঘর থাকার ফলে ব্যাংকের গ্রাহকগণ অতি সহজে ও কম ঝুঁকিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা-পয়সা চেকের মাধ্যমে স্থানান্তর করার সুযোগ পায়।

৮. আন্তঃব্যাংকিং লেনদেন নিষ্পত্তি (Interbanking Transaction Settlement): নিকাশ ঘরের ধারণা ও নিকাশ পদ্ধতির উদ্ভবই ঘটেছে আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির জন্য। বিভিন্ন ব্যাংক ও শাখার মধ্যে চেক, বিল, ড্রাফট প্রভৃতির মাধ্যমে লেনদেন সম্পাদনের ফলে যে সকল আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনার উদ্ভব ঘটে তা নিষ্পত্তি করা নিকাশ ঘরের প্রধান কাজ।

৯. ঋণ নিয়ন্ত্রণ (Control Debt): নিকাশ ঘর ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের তারল্য অবস্থা জানতে পার, ফলে ঋণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজসাধ্য হয়।

নিকাশ ঘর পদ্ধতি|Method of Clearing House in Banking


আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির পদ্ধতিই হচ্ছে নিকাশ ঘর। ব্যাংকসমূহের লেনদেন নিষ্পত্তিতে সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিকাশ ঘর পরিচালনা করে। নিকাশ ঘর ব্যবস্থা দুটি উপায়ে আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করে। যথা:
১. সনাতন পদ্ধতি (Traditional method Clearing House in Banking)
২. স্বয়ংক্রিয় নিকাশ ঘর (Automated clearing house) 

১. সনাতন পদ্ধতি (Traditional method Clearing House in Banking): নিকাশ ঘর ব্যবস্থার সনাতন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের প্রতিনিধিগণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ বিভাগে উপস্থিত হয়ে দেনা-পাওনার নিষ্পত্তি করেন। সমগ্র প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ভূমিকা পালন করে। সেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের প্রতিনিধিগণ নিজেদের পক্ষে একটি ব্যাংক বিবরণী প্রস্তুত করেন। পরবর্তীতে বিবরণীসমূহ নিয়ে একটি সমন্বিত বিবরণী প্রস্তুত করা হয়।

২. স্বয়ংক্রিয় নিকাশ ঘর (Automated clearing house in Banking): তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় এখন সনাতন পদ্ধতির ন্যায় ব্যাংক প্রতিনিধিকে উপস্থিত হয়ে লেনদেন নিষ্পত্তি করতে হয় না। বর্তমানে তার ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকাশ কার্যক্রয় সম্পাদন করা হয়। 

বাংলাদেশে কবে থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকাশ ঘর চালু করে?

যুক্তরাজ্যের সহায়তায় ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করে। স্বয়ংক্রিয় নিকাশ ঘর ব্যবস্থায় দুটি স্তরে দেনা-পাওনার নিষ্পত্তি করা হয়। 

প্রথমত, বাংলাদেশ স্বয়ংক্রিয় চেক প্রক্রিয়াকরণ ব্যবহার (Bangladesh Automated Cheque Processing System-BACPS) সহায়তায় চেকের মাধ্যমে সংঘটিত লেনদেনের ফলে উদ্ভূত দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি করা হয়। চেককে বড়ো অঙ্কের চেক ও ছোটো অঙ্কের চেক এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ৫ লক্ষ টাকা বা তার কম মূল্যবিশিষ্ট চেককে ছোটো অঙ্কের চেক এবং ৫ লক্ষ টাকার বেশি মূল্যের চেককে বড়ো অঙ্কের চেক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ছোট অঙ্কের চেকের লেনদেন তুলনামূলক দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়।

দ্বিতীয়ত, চেক ভিন্ন অন্য যেকোনো প্রকার তহবিলের স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ বৈদ্যুতিক তহবিল স্থানান্তর নেটওয়ার্ক (Bangladesh Electronic Fund Transfer Network-BEFTN) সহায়তা নেওয়া হয়। BEFTN সহায়তায় দেশ-বিদেশের বিদ্যমান যেকোনো স্থানে নিমেষেই অর্থ স্থানান্তর করা যায়। ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ৪০ টি ব্যাংক নিয়ে এ পদ্ধতির যাত্রা শুরু হয়। পরিবেশে বলা যায়, নিকাশ ঘর পদ্ধতি বেশ জটিল। তবে বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহারে এ পদ্ধতি বেশ সহজ ও গতিশীল গেছে। উপর্যুক্ত উপায়ে নিকাশ ঘর পদ্ধতি আন্তঃব্যাংকিং দেনা-পাওনার নিষ্পত্তি করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url