বাণিজ্যিক ব্যাংকের ধারণা|Concept of Commercial Bank

মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য ও সেবাকর্ম উৎপাদন, বন্টন ও এর সহায়ক সকল বৈধ অর্থনৈতিক কাজ ব্যবসায় হিসেবে গণ্য। তাই শিল্প, বাণিজ্য, পণ্য বিনিময়, প্রত্যক্ষ সেবা সবই ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত। এর সবই মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এখন প্রশ্ন হলো ব্যাংকতো নানান ধরনের রয়েছে। সবইতো মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হতে পারে। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংক আলাদা ভাগ হবে কেন? আমরাতো বাণিজ্যিক আমদানি, বাণিজ্যিক খুচরা ব্যবসায় বলি না।

প্রকৃতপক্ষে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যেই ব্যাংক জনগণের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে, ঋণ দেয় ও বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদান করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। উৎপত্তি বিবেচনায় ব্যাংকের আদি কাজ-আমানত সংগ্রহ ও ঋণদান ও সেই সাথে ব্যাংকিং সেবা গ্রাহক নির্বিশেষে এই ব্যাংক প্রদান করে।

বিশেষ ধরনের গ্রাহক সেবা প্রদান নিয়ে এই ব্যাংক পরিচালিত হয় না। মার্চেন্ট ব্যাংক, আমদানি- রপ্তানি ব্যাংক, গৃহসংস্থান ব্যাংক ইত্যাদি বিশেষ ধরনের গ্রাহক ও সেবা নিয়ে কাজ করে। ঋণদান করলেও তাদের বিশেষায়িত ভাব একে ভিন্ন রূপ দিয়েছে।

কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে সর্বশ্রেণির গ্রাহককে টার্গেট করে আমানত সংগ্রহ, ঋণদান ও ব্যাংকিং সেবা দিয়ে চলেছে। মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে যে ব্যাংক আমানত সংগ্রহ, ঋণদান ও গ্রাহকদের বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদান করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে।

এই ব্যাংক বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে কম সুদে বা লাভে আমানত সংগ্রহ করে এবং অধিক সুদে বা লাভে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়। প্রাপ্ত ও প্রদত্ত সুদ বা লাভের পার্থক্যই এরূপ ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। এছাড়াও পে অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট, প্রত্যয়পত্র ইত্যাদি খোলার মাধ্যমে ব্যাংক কমিশন প্রাপ্ত হয়। গ্রাহকদের হিসাব পরিচালনার কারণে ব্যাংক চার্জ আদায়, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সেবার জন্য সার্ভিস চার্জ প্রাপ্তি ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে ব্যাংক আয় করে।


এক্ষেত্রে পরিচালনা খরচসহ বিভিন্ন খরচ-ক্ষতি বাদ দিয়ে যা থাকে তাই ব্যাংকের মুনাফা। এই ব্যাংক জনগণের জমা রাখা আমানত বা ঋণ দিয়ে মূলত ব্যবসায় করায় একে ধার করা অর্থের ধারক, স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবসায়ী ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের ধারণা

বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংজ্ঞা|Definition of Commercial Bank


বাণিজ্যিক ব্যাংক বলতে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ এবং মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বিনিয়োগের জন্য ঋণ প্রদানের কার্য সম্পাদন করাকে বোঝায়। বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতকারীদের কম সুদের হারে অর্থ সংগ্রহ এবং ঋণগ্রহীতাকে উচ্চ সুদের হারে ঋণ প্রদান করে, উভয় সুদের হারের পার্থক্য ব্যাংকগুলোর লাভের বা মুনাফার প্রধান উৎস। আর এ কারণে ব্যাংককে ধার করা অর্থের ধারক বলা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ঋণের কারবার করে থাকে।

তাই বলা যায়, যে ব্যাংক আমানত গ্ৰহণ, ঋণ প্রদান এবং মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে গঠিত ও পরিচালিত হয় তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রসঙ্গে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামত নিচে তুলে ধরা হলো:

M. N. Mishra- এর মতে,
যে ব্যাংক জনসাধারণের আমানত গ্রহণ করে এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেয় তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে।
অধ্যাপক আশুতোষ নাথ এর মতে,
বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো মুনাফা অর্জনকারী একটি আর্থিক মধ্যস্থ প্রতিষ্ঠান।
১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী, যে প্রতিষ্ঠান চলতি বা অন্য কোনো হিসাবের মাধ্যমে জনগণের নিকট থেকে অর্থ আমানত হিসাবে গ্রহণ করে এবং চেক বা আদেশপত্রের মাধ্যমে উক্ত অর্থ উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংকিং কোম্পানি বলে।

Prof. Roger- এর মতে,
যে ব্যাংক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থ ও অর্থের সমতুল্য সম্পদের ব্যবসায় করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। 
পরিশেষে বলা যায়, যে ব্যাংক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে স্বল্প সুদে আমানত সংগ্রহ এবং অধিক সুদে ঋণ প্রদান করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্দেশ্য|Objective of Commercial Bank 


বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য হলো ন্যূনতম ঝুঁকিতে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা। স্বল্পহারে স্থায়ী, সঞ্চয়ী ও চিলতি হিসাবের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করে তা উচ্চহারে ঋণদান করে বাণিজ্যিক ব্যাংক তার মুনাফা অর্জন করে থাকে। এই মুনাফা অর্জনের প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জনসাধারণের কল্যাণকর কাজ করতে হয়। নিচে বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. মুনাফা অর্জন (Earning profit): বাণিজ্যিক ব্যাংক সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য হলো ন্যূনতম ঝুঁকিতে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। ব্যাংক বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে ও স্বপ্নসুদে জনগণের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে এবং তা উচ্চহারে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক মুনাফা অর্জন করে থাকে।

২. আমানত সৃষ্টি (Collecting savings): জনগণের নিকট পড়ে থাকা অলস অর্থ বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে সংগ্রহ করে বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত সৃষ্টি করে।

৩. মূলধন গঠন (Formation of capital): বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণ জনগণের নিকট থেকে বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে সংগৃহীত আমানত একত্র করে তহবিল গঠন করে। উক্ত তহবিল থেকে দেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন মেয়াদি ঋণ প্রদান করা হয় যা বাণিজ্যিক ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য।

৪. অর্থের নিরাপত্তা (Maintaining security of money): জনগণের উদ্বৃত্ত অর্থই ব্যাংকে জমা রাখে এবং তাদের চাহিদা মোতাবেক উত্তোলন পর্যন্ত অর্থের নিরাপত্তা প্রদান বাণিজ্যিক ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য।

৫. দান (Granting loans): বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতের একটি অংশ আমানতকারীদের চাহিদা মেটানোর জন্য রেখে বাকি অংশ বিভিন্ন মেয়াদি ঋণ প্রদান করা হয়। এসব ঋণের উপর সুদ ধার্য করা হয় যা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মুনাফা।

৬. বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি (Creation of medium of exchange): চেক বন্ড, ড্রাফট, পে-অর্ডার, বিল, স্বীকারোক্তিপত্র, জমা রশিদ, ই-কার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক নতুন নতুন বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টি করে আর্থিক লেনদেন সহজতর করে থাকে।

৭. কর্মসংস্থান সৃষ্টি (Creation of employment): বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমানতের মাধ্যমে মূলধন গঠন এবং নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে ঋণ সহায়তা প্রদান করে। যাতে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তাছাড়া ব্যাংকে নতুন শাখা বিস্তৃতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে। 

৮. অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic development): মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা করাও বাণিজ্যিক ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। সরকারি আইন বাস্তবায়ন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তা এবং ঋণের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করতে হয়।

৯. ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়তা করা (Helps in trade and commerce): বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্য জটিল ও প্রতিযোগিতামূলক যা দেশ ও দেশের বাইরে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়। তাই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে ও প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা এবং পরামর্শ প্রদানে করা বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্দেশ্য। 

১০. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন (Improvisation of living standard): আমানত সৃষ্টির মাধ্যমে তহবিল গঠন, তহবিল থেকে ঋণ প্রদান করে দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। যার ফলে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাংকের অবদান থাকে।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশের সার্বিক দায়িত্বে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে। সমাজের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্দেশ্য।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য|Features of Commercial Bank


বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবসায়ী, যার প্রধান কাজ হলো স্বল্পমুদে বা লাভে আমানত হিসেবে গ্রাহকদের অর্থ জমা গ্রহণ এবং অধিক সুদে বা লাভে উক্ত অর্থ ঋণ হিসেবে অন্যদের প্রদান করা। ঋণের ব্যবসায়ী হিসেবে এ ব্যাংকের গঠন, পরিচালনা ও কার্যাবলি অন্যান্য যেকোনো ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। নিম্নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য (Objective of earning profit): মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়েই বাণিজ্যিক ব্যাংকের উৎপত্তি ঘটে। তাই এ ব্যাংকের যাবতীয় কাজ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য সামনে রেখেই পরিচালিত হয়। যে কারণে অন্যান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ন্যায় একেও তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জনের প্রয়াস চালাতে হয়।

২. সঞ্চয় সংগ্রহ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণদান (Collection of savings and sanction of short term loan): বাণিজ্যিক ব্যাংকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ ব্যাংক বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে সঞ্চয় সংগ্রহ করে এবং উক্ত সঞ্চিত অর্থ অন্যদের ঋণ, নগদ ঋণ ও জমাতিরিক্ত ঋণ আকারে প্রদান করে। অর্থ ছাড়া এ ব্যাংক প্রত্যয়পত্র, বিনিময় বিল, হুণ্ডি, ব্যাংক ড্রাফট ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রাহকদের ঋণ সুবিধা প্রদান করে।

৩. বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি (Creation of medium of exchange): মুদ্রা সৃষ্টি করতে না পারলেও বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে চেক, চেক কার্ড, ব্যাংক ড্রাফট, প্রত্যয়পত্র সৃষ্টি করা এ ব্যাংকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক অতি সহজেই এ ধরনের বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করতে পারে যা অন্যান্য ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়।

৪. শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থা (Branch banking system): অন্যান্য ব্যাংকসমূহ একটিমাত্র বা সীমিতসংখ্যক অফিসর মাধ্যমে কার্য সম্পাদনে সমর্থ হলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকের বেলায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় শাখা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে। এতে আমানত সংগ্রহ, অর্থ স্থানান্তর, বৈদেশিক বিনিময় ইত্যাদি কার্য সহজ হয়। এ কারণেই শাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এরূপ ব্যাংকের প্রসার লক্ষণীয়।

৫. তালিকাভুক্ত ব্যাংক (Scheduled bank): দেশে বিদ্যমান ব্যাংকিং আইনের আওতায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতিসাপেক্ষে বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠিত হয়। এ ধরনের ব্যাংক নিজস্ব প্রয়োজনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যাবতীয় শর্ত মেনে নিয়ে এর সদস্য ব্যাংকের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশের প্রায় সব বাণিজ্যিক ব্যাংকই তালিকাভুক্ত ব্যাংক।

৬. সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান (Service oriented organisation): মুনাফা অর্জন এ ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য হলেও, গ্রাহকদের বিভিন্নমুখী সেবাদান এ ব্যাংকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে যে ব্যাংক যত বেশি গ্রাহকদের সেবাদানে সক্ষম সে ব্যাংক তত বেশি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। তাই আধুনিক বাণিজ্যিক ব্যাংক সর্বদা অধিক সেবা প্রদানে তৎপর থাকে।

৭. মালিকানা (Ownership): বাণিজ্যিক ব্যাংক একমালিকানা, অংশীদারি, সমবায় অথবা কোম্পানি সংগঠনের আওতায় গঠিত হতে পারে। তবে সারাবিশ্বে শাখা ব্যাংক ব্যবস্থা জনপ্রিয় হওয়ায় বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই ব্যাংক যৌথমূলধনি কোম্পানি সংগঠনের আওতায় গঠিত হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান সকল তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকই যৌথমূলধনি কোম্পানি প্রতিষ্ঠান। যা ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত।

৮. আর্থিক মধ্যস্থতাকারী (Financial intermediary institution): বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো মুনাফা অর্জনকারী একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্যিক ব্যাংক এক শ্রেণির ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান হতে আমানত স্বরূপ অর্থ সংগ্রহ করে এবং অন্য এক শ্রেণির ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ হিসাবে বিতরণ করে । অর্থাৎ প্রকৃত ঋণদাতা (আমানতকারী) এবং ঋণগ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধনকারী হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংক।

৯. সুনিয়ন্ত্রিত (Highly regulated): বিশ্বের প্রায় সকল ধরনের ব্যবসায়ের চেয়ে ব্যাংকিং ব্যবসায় বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়। সেবা প্রদানের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনে সচেষ্ট থাকে। ব্যাংকসমূহ কোম্পানি আইন অনুযায়ী গঠিত ও নিবন্ধিত হয় এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে রাখে। সর্বোপরি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে Bank for International Settlement (BIS)এর সুপারিশকৃত ব্যাসেল সম্মতিও অনুসরণ করতে হয়।

১০. মূলধন গঠন (Capital formar): বাণিজ্যিক ব্যাংক একটি দেশের মূলধন গঠনে সর্বোচ্চ অবদান রাখে। আপাতদৃষ্টিতে মূলধন বাজারকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থায়নের উৎস হিসেবে মনে হলেও বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের মূলধনের বড়ো অংশই ঋণ তহবিলের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়। উক্ত ঋণের সর্ববৃহৎ অংশই সরবরাহ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। সে কারণে বাণিজ্যিক ব্র্যাংককে মূলধন গঠনের কারখানা বললে অত্যুক্তি হবে না।

১১. অর্থ ও ঋণের ব্যবসায়ী (Dealer in money & credit): বাণিজ্যিক ব্যাংক অর্থ ও ঋণের ব্যবসায়ী। বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কাজই হলো আমানত হিসেবে সংগৃহীত অর্থকে বিভিন্ন ধরনের ঋণপণ্যে পরিণত করা এবং তা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে ঋণ হিসেবে বিতরণ করা। অর্থাৎ ব্যাংকের পণ্যই হলো অর্থ বা ঋণ।

১২. আর্থিক প্রতিনিধি (Financial representative for customer): বাণিজ্যিক ব্যাংক তার গ্রাহকের আর্থিক প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করে। আর্থিক প্রতিনিধি হিসাবে ব্যাংক গ্রাহকের বিভিন্ন আর্থিক সম্পদ যেমন— চেক, বিনিময় বিল, প্রতিজ্ঞাপত্রের অর্থ সংগ্রহ ও পরিশোধ করে। তাছাড়া বিভিন্ন আর্থিক সম্পদ যেমন- শেয়ার, বন্ড , ঋণপত্র প্রভৃতি ক্রয় ও বিক্রয় করে; বিনিয়োগের সুদ ও লভ্যাংশ আদায় করে এবং একইভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক মক্কেলের দেনা পরিশোধ করে।

১৩. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সুসম্পর্ক (Good relation with central bank): বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানকারী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক যেমন নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি বিভিন্ন সহযোগিতা এবং পরামর্শও প্রদান করে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান।

১৪. অর্থ বাজারের প্রধান অংশগ্রহণকারী (Principal participant in money market): যে আর্থিক বাজারের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি আর্থিক সম্পদ যেমন: ট্রেজারি বিল, বাণিজ্যিক কাগজ, ব্যাংকের স্বীকৃতিপত্র প্রভৃতির ক্রয়-বিক্রয় সম্পাদিত হয় তাকে অর্থ বাজার বলে। বাণিজ্যিক ব্যাংক অর্থ বাজারে বিনিয়োগ এবং আর্থিক সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ে মূল ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তার আর্থিক নীতি বাস্তবায়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহযোগিতা গ্রহণ করে। এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংককে অর্থ বাজারের মধ্যমণিও বলা হয়।

পরিশেষে বলা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা একে অন্যান্য যেকোনো ব্যাংক থেকে পৃথক রূপ মর্যাদা প্রদান করেছে। এরূপ ব্যাংক ব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্ম হলেও বর্তমানকাল অবধি ব্যাংক বলতে সাধারণভাবে এ প্রতিষ্ঠানকেই বুঝানো হয়ে থাকে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url