ফ্যাক্টরিং ও ফোরফেইটিং ধারণা| Concept of Factoring & Forfaiting

বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টরিং ও ফোরফেইটিং এক নতুন ব্যবস্থা। ব্যাংকসমূহ বৈদেশিক বাণিজ্যে একদিকে আমদানিকারককে প্রত্যয়পত্র খোলার সুযোগ দিয়ে এবং আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ঋণ মঞ্জুর করে যেমনি অর্থায়ন করে তেমনি রপ্তানিকারককে রপ্তানিকৃত পণ্য উৎপাদন বা সংগ্রহে ঋণ মঞ্জুর করে থাকে। এক্ষেত্রে আমদানিকারক রপ্তানিকারক কর্তৃক উত্থাপিত মেয়াদি বিলে স্বীকৃতি দিয়ে পাঠালে ব্যাংক তা বাটাকরণের সুযোগ দিয়েও দীর্ঘকাল থেকে অর্থায়ন করে এসেছে। কিন্তু এরূপ বাণিজ্যে বিনিময় বিল বা উভয়ের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

ফ্যাক্টরিং কি|What is Factoring 


প্রাপ্য বিল (বিনিময় বিল বা অঙ্গীকারপত্র) মেয়াদপূর্তির পূর্বেই কোনো ফ্যাক্টর (Factor) এর নিকট কম দামে বিক্রয় করে অর্থ সংগ্রহ করাকেই ফ্যাক্টরিং বলে। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রাপ্য বিল এভাবে কমদামে কিনে মেয়াদপূর্তিতে দেনাদার থেকে এর অর্থ সংগ্রহ করে ব্যবসায় করলে তাকে ফ্যাক্টর বলা হয়। প্রাপ্য বিলের বিক্রেতা এবং ফ্যাক্টরের মধ্যে এরূপ ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে শর্ত উল্লেখ করে যে চুক্তি সম্পাদিত হয় তাকে ফ্যাক্টরিং চুক্তি বলা হয়ে থাকে। এরূপ বিল ক্রয়ের সময় ফ্যাক্টর এরূপ বিলের অর্থ প্রদানের জন্য দায়ী পক্ষ বা দেনাদারের আর্থিক অবস্থা, সুনাম-সুখ্যাতি, বিলের ধরন, মেয়াদপূর্তির সময় ইত্যাদি দেখে থাকে।
ফ্যাক্টরিং ও ফোরফেইটিং ধারণা
মেয়াদপূর্তিতে যদি দেনাদার বিলের অর্থ পরিশোধ না করে তবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঐ দায় ফ্যাক্টর না বিলের বিক্রেতা বহন করবে তা নির্ণীত হয়। তবে সাধারণভাবে এরূপ দায় ফ্যাক্টরই বহন করে থাকে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা ফ্যাক্টরই গ্রহণ করে। বৃহদায়তন রপ্তানি বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে এরূপ প্রাপ্য বিল জমা পড়ে। এরূপ বিলের অর্থ সংগ্রহ, হিসাব সংরক্ষণ ও অর্থ সংগ্রহ বিষয়ে জটিলতা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি কাজে প্রতিষ্ঠানকে আলাদা বিভাগ খুলতে হয়।

ফ্যাক্টরিং এর কারণে রপ্তানিকারকের এরূপ বিভাগ খোলা ও পরিচালনার প্রয়োজন পড়ে না। এরূপ বিল পাওয়ার সাথে সাথেই সে তার ফ্যাক্টরের নিকট এটা বিক্রয় করে এর অর্থ সংগ্রহ করতে ও রপ্তানি বাণিজ্যে অধিক মনোযোগী হতে পারে। অন্যদিকে ফ্যাক্টরও এরূপ ব্যবসায় থেকে আয় করার সুযোগ পায়। অবশ্য ফ্যাক্টরগণ কমিশনের বিনিময়েও প্রাপ্য বিলের অর্থ আদায়ের দায় গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে বিলের হিসাব সংরক্ষণসহ অর্থ আদায়ের সকল দায়িত্ব ফ্যাক্টরই পালন করে। বিল বাট্টাকরণ অপেক্ষা ফ্যাক্টরিং এ কমিশন বা বাট্টার হার বেশি হয়ে থাকে।

ফ্যাক্টরিংয়ের বৈশিষ্ট্য| Features of Factoring


সাধারণভাবে, ফ্যাক্টর বিনিময় বিল একটি নির্দিষ্ট বাট্টায় ক্রয় করে এবং ফ্যাক্টরিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রক্রিয়াকরণ ফি আদায় করে। অর্থাৎ ফ্যাক্টরিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিষয়সমূহ হচ্ছে:

১. রপ্তানিকারক তার বৈদেশিক বিনিময় বিল (প্রাপ্য বিল) কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বাট্টায় বিক্রয় করে।
২. বিক্রয়ের ফলে বিলের মালিকানা ও দায়-দায়িত্ব এবং ঝুঁকি ফ্যাক্টরের (বিনিময় বিলের ক্রেতা) নিকট হস্তান্তরিত হয়।
৩. ফ্যাক্টর মেয়াদ শেষে আমদানিকারকের নিকট হতে বিলের অর্থ আদায় করে।
৪. কোনো কারণে আমদানিকারক বিনিময় বিলের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার সে ক্ষতি ফ্যাক্টরকেই বহন করতে হয় এবং
৫. এরূপ অর্থায়নের মেয়াদ ৬ মাস পর্যন্ত হতে পারে। 

কাজেই বলা যায়, রপ্তানিকারক বিনিময় বিলের বিপরীতে পণ্য রপ্তানি করলে এবং মেয়াদপূর্তির পূর্বেই উক্ত বিনিময় বিল রপ্তানিকারকের দেশীয় কোনো ব্যাংকের নিকট বিক্রয় করলে এবং উক্ত বিক্রয়ের ফলে বিনিময় বিলের সমুদয় দায়-দায়িত্ব ক্রেতার (Factor) নিকট হস্তান্তরিত হলে তাকে ফ্যাক্টরিং বলে।

এরূপ অর্থায়ন পদ্ধতিকে আন্তঃদেশীয় ফ্যাক্টরিংও (Cross Border Factoring) বলা হয়। ফ্যাক্টরিং এর অনেকগুলো সুবিধা বিদ্যমান। যেমন- রপ্তানিকারক বিনিময় বিল বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থায়ন সুবিধা পায়। তাছাড়া বিনিময় বিলের ঋণ ঝুঁকি ফ্যাক্টরের নিকট হস্তান্তরিত হয়। সর্বোপরি রপ্তানিকারকের অর্থপ্রবাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটে।

ফোরফেইটিং কি|What is Forfaiting


বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারককে প্রাপ্য বিলের বিপক্ষে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি অর্থায়নের আধুনিক ব্যবস্থাকেই ফোরফেইটিং বলে। ফ্যাক্টরিং এর ক্ষেত্রে বিল ক্রয়, হিসাব সংরক্ষণ, বিলের অর্থ আদায় ইত্যাদি বিষয় মুখ্য।

কিন্তু ফোরফেইটিং এর ক্ষেত্রে কার্যক্রম এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এক্ষেত্রে আদায়ই নয় আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যকার প্রস্তাবিত পুরো লেনদেনকেই বিবেচনায় নেয়া হয়। বিলম্বে অর্থ পরিশোধের যে শর্তে রপ্তানি হতে যাচ্ছে তাতে অর্থায়নই এক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত বিক্রয় শর্ত, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা, মূল্য পরিশোধের সময় ও শর্ত ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে ফোরফেটার এক্ষেত্রে বাট্টা বা কমিশনের হার নির্দিষ্ট করে।

এটা রপ্তানিকারককে জানালে এবং রপ্তানিকারক প্রয়োজন বোধ করলে প্রস্তাবিত বিক্রয় চুক্তির মূল্যের সাথে এই কমিশন যুক্ত করে আমদানিকারককে নতুন মূল্য নির্দিষ্ট করে দিতে পারে। সব পক্ষ এতে সম্মত হলে প্রথমে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। অতঃপর তার প্রেক্ষিতে রপ্তানিকারক ও ফোরফেইটারের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়ে থাকে।

ধরা যাক, ইংল্যান্ডের একটা কোম্পানি বাংলাদেশের একটা হাসপাতালে বিলম্বে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ শর্তে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার চুক্তি করতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে উক্ত লেনদেনকে বিবেচনায় নিয়ে ফোরফেইটার এক্ষেত্রে অর্থায়নের দায়িত্ব নিতে পারে। ব্যাংক থেকে হাউজবিল্ডিং ঋণ বা ভোক্তা ঋণ নিতে গেলে যেভাবে অগ্রিম তারিখের চেক দিতে হয়। এক্ষেত্রে সেভাবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আগাম প্রাপ্য বিল নিয়ে নেয়া হয়ে থাকে। এরূপ বিলের পক্ষে আমদানিকারকের ব্যাংক প্রদত্ত নিশ্চয়তা সনদ থাকতে হয়।

ফোরফেইটিংয়ের বৈশিষ্ট্য|Features of Forfaiting


১. মূলধনি পণ্যদ্রব্যের রপ্তানিকারক তার প্রাপ্য বিল বা প্রতিজ্ঞাপত্র বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থায়ন সুবিধা গ্রহণ করাই হলো ফোরফেইটিং।
২. অনুরূপ বিক্রয়ের ফলে বিল বা প্রতিজ্ঞাপত্রের মালিকানা দায়-দায়িত্ব এবং সকল প্রকার ঝুঁকি (ঋণ ঝুঁকি, বৈদেশিক ঝুঁকি) বিল বা প্রতিজ্ঞাপত্রের ক্রেতার নিকট হস্তান্তরিত হয়।
৩. দলিলের ক্রেতা মেয়াদ শেষে আমদানিকারকের নিকট হতে দলিলের মূল্য আদায় করে।
৪. দলিলের অর্থ আমদানিকারকের নিকট হতে আদায়ে ব্যর্থ হলে দলিলের ক্রেতা রপ্তানিকারকের নিকট বা অন্য কারো নিকট অর্থ দাবি করতে পারে না।
৫. এরূপ অর্থায়নের মেয়াদ ৩ বছর থেকে ৭ বছর পর্যন্ত হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ফ্যাক্টরিং ও ফোরফেইটিং উভয়ই বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়নের জনপ্রিয় পদ্ধতি। ফ্যাক্টরিং ও ফোরফেইটিং প্রায় একই ধরনের অর্থায়ন। পদ্ধতিদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্যের মৌলিক বিষয় হচ্ছে তাদের মেয়াদ। ফ্যাক্টরিং স্বল্পমেয়াদি এবং ফোরফেইটিং দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url