বৈদেশিক বিনিময়ের ধারণা | Concept of Foreign Exchange

সেলিম সৌদী আরবে চাকরি করে। সে সেখান থেকে মাসে মাসে বাবাকে টাকা পাঠায়। ওখানে সে সৌদী মুদ্রা রিয়াল জমা দেয় কিন্তু বাবা বাংলাদেশী টাকায় তা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন। তার মনে প্রশ্ন, এটা হয় কেন?

তার এক আত্মীয় বৈদেশিক বিনিময় সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান রাখেন। তিনি বললেন, দেখো এক দেশের মুদ্রা আরেক দেশে চলে না ঠিকই কিন্তু এক দেশের মানুষ অন্য দেশে কাজ করে, এক দেশের পণ্য অন্য দেশে বিক্রয় হয় এভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বা মানুষের মধ্যে লেনদেন ও দেনা- পাওনার উদ্ভব ঘটে। এই পাওনাকে ব্যাংক দেশীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে। সকল দেশেই তার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখে। পাওনাকে দেশীয় মুদ্রায় রূপান্তর করে লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা বৈদেশিক বিনিময় হিসেবে গণ্য।

সাধারণ অর্থে এক দেশের সাথে অন্য দেশের লেনদেন বা বিনিময়কে বৈদেশিক বিনিময় বলে। এরূপ লেনদেনে বৈদেশিক মুদ্রা সম্পর্কযুক্ত। যে কারণে লেনদেন নিষ্পত্তিতে উভয় দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া লেনদেন নিষ্পত্তির উপায় নির্ধারণও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এক দেশের মুদ্রাকে অন্যদেশের মুদ্রার মূল্যমানে রূপান্তর এবং লেনদেন নিষ্পত্তির কৌশলকে বৈদেশিক বিনিময় বলে।

H. E. Evitt (ইভিট) বলেছেন,

যে বিশেষ পদ্ধতি বা কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে এক দেশের মুদ্রার সাথে অন্য দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণপূর্বক উভয় দেশের সম্পদের মূল্যায়ন করা হয় তাকে বৈদেশিক বিনিময় বলে।

উপরের আলোচনা হতে এটা স্পষ্ট যে, বৈদেশিক বিনিময় মোটামুটিভাবে নিম্নোক্ত চারটি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত:

(ক) এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বৈদেশিক মুদ্রা;
(খ) এর উদ্দেশ্য হলো দেশীয় মুদ্রার সাথে বিদেশী মুদ্রার বিনিময়;
(গ) এটা বিদেশী দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির পন্থা এবং
(ঘ) পাওনা নিষ্পত্তির সাথে এটি হলো অর্থপ্রেরণের পদ্ধতিসমূহের সমাহার।
Concept of Foreign Exchange

বৈদেশিক বিনিময় হার কী | What is Rate of Foreign Exchange


কোনো দেশের এক একক মুদ্রা অন্য আরেকটি দেশের যে পরিমাণ মুদ্রা ক্রয় করতে সক্ষম তাকে বৈদেশিক বিনিময় হার বলে। অন্যভাবে বলা যায়, একটি দেশের মুদ্রার (Currency) যত সংখ্যক একক (units) অন্য দেশের মুদ্রার যত সংখ্যক একক বিনিময় করা যায় তাই বিনিময় হার। উদাহরণস্বরূপ: আমাদের দেশে যদি ৮৪ টাকায় ১ মার্কিন ডলার কিনতে পারা যায় তাহলে আমরা বলতে পারি যে, ৮৪ টাকা সমান এক ডলার অথবা ১ ডলার সমান ৭৮ টাকা।

অর্থাৎ দেশীয় মুদ্রাকে যে অনুপাতে বিদেশী মুদ্রার সাথে বিনিময় করা যায় সেই অনুপাতকেই বিনিময় হার বলে। পরিশেষে বলা যায়, বৈদেশিক বিনিময় হার বলতে আমরা সেই হারকেই বুঝে থাকি যে হারে মুদ্রাবাজারে দেশীয় মুদ্রা দ্বারা বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় বা বিক্রয় করা হয়। আরও সহজে বললে দাঁড়ায়, এক দেশের মুদ্রার সাথে আরেক দেশের মুদ্রার মূল্যানুপাতই হলো বিনিময় হার।

বৈদেশিক বিনিময় হার নির্ধারণ পদ্ধতি | Method For Calculation of the Foreign Exchange Rate


কোনো দেশের এক একক মুদ্রা অন্য আরেকটি দেশের যে পরিমাণ মুদ্রা ক্রয় করতে সক্ষম তাকে বৈদেশিক বিনিময় হার বলে। অন্যভাবে বলা যায়, একটি দেশের মুদ্রার (Currency) যত সংখ্যক একক (units) দ্বারা অন্য দেশের মুদ্রার যত সংখ্যক একক বিনিময় করা যায় তাই বিনিময় হার। উদাহরণস্বরূপ: আমাদের দেশে যদি ৭৮ টাকায় ১ মার্কিন ডলার কিনতে পারা যায় তাহলে আমরা বলতে পারি যে, ৭৮ টাকা সমান এক ডলার অথবা ১ ডলার সমান ৭৮ টাকা।

বিনিময় হার নির্ধারণের পদ্ধতি | Methods of Calculation of the rate of exchange


বিনিময় হার অনুসারে দু'দেশের মুদ্রার বিনিময় হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বৈদেশিক মূল্য বিভিন্ন রকমের হয়। তাই মুদ্রার মান (Monetary standard) অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পন্থায় বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। স্বর্ণমান ব্যবস্থায় (Gold standard) যেভাবে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়, কাগজী মুদ্রা (Paper currency) ব্যবস্থায় ঠিক সেভাবে বিনিময় হার নির্ধারিত হয় না । নিম্নে উভয় প্রকার ব্যবস্থায় বিনিময় হার নির্ধারণের পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো: ডলার।

১. স্বর্ণমান ব্যবস্থায় বিনিময় হার নির্ধারণ (Under gold standard): স্বর্ণমান ব্যবস্থা অনুসরণকারী দেশগুলো তাদের মুদ্রামান নির্দিষ্ট স্বর্ণমানের সাথে সম্পর্কযুক্ত রেখে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করলে তাকে স্বর্ণমান ব্যবস্থায় বিনিময় হার নির্ধারণ বলে। ধরা যাক, বৃটেনে এক পাউন্ডের বিপক্ষে যে পরিমাণ স্বর্ণ সংরক্ষণ করা হয় বাংলাদেশে ৯০ টাকার বিপক্ষে সেই পরিমাণ স্বর্ণ সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্বর্ণমান ব্যবস্থায় দু'টি দেশের মধ্যকার বিনিময় হার হবে ১ পাউন্ড = ১১০ টাকা। বিনিময়ের এ হারকে বিনিময়ের টাকশাল হার (Mint per exchange) এবং এরূপ হার নির্ধারণ তত্ত্বকে মিন্ট প্যারিটি তত্ত্ব (Mint Parity Theory) বলা হয়ে থাকে। এরূপ পদ্ধতি বর্তমানকালে প্রচলিত নেই বললেই চলে। এর পিছনে অন্যতম কারণ হলো:

ক) পৃথিবীর কোনো দেশই এখন কার্যত পারস্পরিক বিনিময়যোগ্য স্বর্ণমান সংরক্ষণ করে না।

খ) বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রামান বিশেষভাবে দেশসমূহের আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল এবং

গ) ভাসমান মুদ্রা ব্যবস্থায় (Floating currency system) প্রতিটা দেশের মুদ্রামান এখন কার্যত বাজার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। 

২. অপরিবর্তনীয় কাগজী মুদ্রা ব্যবস্থায় বিনিময় হার নির্ধারণ (Under inconvertible paper currency system): বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই কাগজী মুদ্রা প্রচলিত। কাগজী মুদ্রাকে গুরুত্ব দিয়ে বিনিময় হার নির্ধারণের জন্য নিম্নোক্ত দু'টি প্রখ্যাত তত্ত্ব (Theory) অনুযায়ী বিনিময় হার নির্ধারিত হতে দেখা যায়। 

(ক) ক্রয়ক্ষমতার সমতা তত্ত্ব (Purchasing power parity theory): দু দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ সংক্রান্ত তত্ত্বকেই ক্রয়ক্ষমতার সমতা তত্ত্ব বলে। অধ্যাপক গুস্তাভ ক্যাসেল (Gustav Cassel) এরূপ তত্ত্বের জনক।

তাঁর মতে, সংশ্লিষ্ট দেশের মূল্যস্তরের ওপর বিনিময় হার নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে মুদ্রার অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতা দ্রব্যমূল্য দ্বারা নির্ণয় করা হয়। উদাহরণস্বরূপ মনে করি, ‘ক’ নামক একটি জিনিস আমরা ৮৪ টাকা দিয়ে কিনতে পারি এবং ঠিক একই পরিমাণ জিনিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ ডলারে ক্রয় করা যায়। এমতাবস্থায় ডলার ও টাকার বিনিময় হার হবে ১ ডলার = ৮৪ টাকা। কারণ ১ ডলারের ক্রয়ক্ষমতা ৭৮ টাকার ক্রয়ক্ষমতার সমান। এই তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা অন্য দেশে অপেক্ষা বৃদ্ধি পেলে বিনিময় হার বৃদ্ধি পায়। এবং মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা একইভাবে হ্রাস পেলে বিনিময় হার হ্রাস পায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সাথে বিনিময় হারের হ্রাস-বৃদ্ধি এই তত্ত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। এরূপ তত্ত্বের নিম্নোক্ত অসুবিধাসমূহ লক্ষণীয়:

ক) বিভিন্ন দেশের পণ্য সামগ্রী পাশাপাশি নিয়ে মূল্যস্তর নির্ধারণ কার্যত অসম্ভব;

খ) মূল্যস্তরের সূচক প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। তাই এর ওপর নির্ভর করে বিনিময় হার নির্ধারণ কষ্টকর;

গ) দু'দেশের মধ্যে মূল্যস্তর নির্ধারণে ভিত্তি বছর কী হবে তাও নির্ণয় সম্ভব নয়;

ঘ ) পণ্যের হাজারো ভিন্নতার কারণেও কোন কোন পণ্য হিসাবে নেয়া হবে তা নির্ধারণ কষ্টকর এবং

ঙ) অবাধ অর্থনৈতিক ধারণার ওপর এ তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত; যা সকল ক্ষেত্রে অনুসৃত হয় না। বিভিন্নভাবে এরূপ তত্ত্বকে সমালোচনা করা হলেও বিনিময় হারের ওপর প্রত্যেক দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতার যে সুনির্দিষ্ট প্রভাব রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

(খ) চাহিদা ও যোগান তত্ত্ব বা আধুনিক তত্ত্ব (Demand and supply theory or Modern theory): দু ' দেশের মুদ্রার বিনিময় হার তাদের মুদ্রার পারস্পরিক চাহিদা ও যোগান অনুযায়ী নির্ধারণ সংক্রান্ত তত্ত্বকেই চাহিদা ও যোগান তত্ত্ব বলে। আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ এরূপ তত্ত্ব সমর্থন করায় একে বিনিময় হার নির্ধারণের আধুনিক তত্ত্বও বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মনে করা হয় যে, চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বিন্দুতে কোনো কিছুর দাম যেমনি নির্ধারিত হয় তেমনি অর্থের বিনিময় মূল্যও বৈদেশিক বাজারে এর চাহিদা ও যোগান দ্বারা নির্ধারিত হয়। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের মুদ্রার চাহিদা অন্য দেশগুলোর মধ্যকার লেনদেনের উদ্বৃত্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত। লেনদেন ব্যালেন্স যদি অনুকূল হয় তাহলে বৈদেশিক বাজারে দেশীয় মুদ্রার চাহিদা বাড়ে।

এরূপ অবস্থায় বৈদেশিক বাজারে দেশীয় মুদ্রার চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পায়। অপরপক্ষে যদি লেনদেন ব্যালেন্স প্রতিকূল হয় অর্থাৎ রপ্তানি কমে কিন্তু আমদানি বাড়ে তাহলে বৈদেশিক বাজারে দেশীয় মুদ্রার যোগান বাড়ে। ফলে দেশীয় মুদ্রার দাম কমে। এতে বেশি পরিমাণ দেশীয় মুদ্রার দ্বারা কম পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া সম্ভব হয়।

বৈদেশিক বিনিময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর


Q. গুস্তাভ ক্যাসেল কোন তত্ত্বের জনক?
উত্তর: গুস্তাভ ক্যাসেল ক্রয়ক্ষমতার সমতা তত্ত্বের জনক।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url