দাগকাটা চেক| Crossed Cheque

মি. জয়নুল জরুরি কিছু টাকার প্রয়োজন। তাই সে তার বন্ধুর নিকট থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার একটা বাহক চেক নিয়ে ব্যাংকের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সে লক্ষ করলো তার গাড়িকে অন্য একটা গাড়ি অনুসরণ করছে। তার ভয় হলো। সে চেকটি বের করে তার ওপরে বামপাশে দু'টি সমান্তরাল রেখা টেনে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ গাড়িটি একটা ফাঁকা জায়গায় এসে গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। এরপর তার নিকট থেকে জোর করে চেকটি নিয়ে তাকে আহত করে চলে গেল। দুষ্কৃতিকারীরা ভেবেছিল আহত অবস্থায় তার সুশ্রূষায় যে সময় ব্যয় হবে তার মাঝেই তারা টাকাটা উঠিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু মি. জয়নুল বুদ্ধিমত্তার কারণে দুষ্কৃতিকারীরা চেকটি ভাঙ্গাতে পারেনি। কারণ দু'টি দাগ দেয়ায় চেকটি দাগকাটা চেকে পরিণত হয়েছে।

আরো পড়ুন: চেক কি?

বাহক চেক বা হুকুম চেকের উপরে সাধারণত বাম পার্শ্বে কিছু লিখে বা না লিখে আড়াআড়ি দু'টি রেখা অঙ্কন করলে ঐ চেককে দাগকাটা চেক বলে। রেখা অঙ্কন করার এ প্রক্রিয়াকে চেকে দাগকাটা (Crossing) এবং রেখা অঙ্কিত ঐ চেকটিকে দাগকাটা চেক (Crossed cheque) বলে। এরূপ চেকের অর্থ সরাসরি ব্যাংক কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করা যায় না, কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়। ১৮৮২ সালের ইংরেজি বিনিময় বিল আইনের ৭৬ (২) ধারায় বলা হয়েছে যে, যে ক্ষেত্রে একটি চেকের উপর আড়াআড়িভাবে অঙ্কিত দু'টি সমান্তরাল সরল রেখার মধ্যে “And company” অথবা “Not negotiable” বা শুধুমাত্র দু'টি সমান্তরাল রেখা অঙ্কিত থাকে তাকে সাধারণভাবে দাগকাটা চেক বলে। যেক্ষেত্রে দু'টি সমান্তরাল সরলরেখার মধ্যে “Not negotiable” শব্দ দু'টিসহ বা ব্যতিত কোনো ব্যাংকের নাম লেখা থাকে তাকে বিশেষভাবে দাগকাটা চেক বলা হয়ে থাকে।

উপরোক্ত আলোচনা ও সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে দাগকাটা ঢেকের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়।

১. বাহক বা হুকুম চেকের বামকোগের উপরে দু'টি আড়াআড়ি রেখা টানলে তা দাগকাটা ঢেকে পরিণত হয়। অবশ্য দু'টি সরাসরি দাগ চেকের উপরিভাগে কাটলেই তা দাগকাটা ঢেকে পরিচিত হয়।

২. প্রাপকের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এ চেকের টাকা সংগ্রহ করতে হয়।

৩. এ ধরনের চেক অধিক নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত।

৪. দাগকাটার পদ্ধতি অনুযায়ী এরূপ চেক দু'ধরনের; যথা- সাধারণভাবে দাগকাটা ঢেক ও বিশেষভাবে দাগকাটা চেক।
দাগকাটা চেক কি

দাগকাটা চেকের প্রকারভেদ |Types of Crossed Cheque


সাধারণভাবে কোনো চেকের বাম প্রান্তের উপরিভাগে আড়াআড়ি দু'টি সমান্তরাল রেখা টানা হলে তাকে দাগকাটা চেক বলে। এরূপ সমান্তরাল রেখার মধ্যে কিছু লেখা হতে পারে; নাও হতে পারে। দাগকাটার ফলে চেক সরাসরি ব্যাংক কাউন্টার থেকে ভাঙ্গানো যায় না। দাগকাটার প্রকারভেদ অনুযায়ী যথানিয়মে চেক ব্যাংকে জমা দিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। চেকে দাগকাটার প্রকৃতি অনুযায়ী একে নিম্নোক্ত দু'ভাগে ভাগ করা হয়:

১. সাধারণভাবে দাগকাটা চেক (Ordinary crossed cheque): যদি কোনো দাগকাটা চেকের দাগের মাঝখানে ব্যাংক শব্দের উল্লেখ না থাকে বা কোনো কিছু লেখা না থাকে সেক্ষেত্রে তাকে সাধারণভাবে দাগকাটা চেক বলে। বাংলাদেশে বহাল ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১২৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, যখন কোনো চেকের উপরিভাগে শুধুমাত্র আড়াআড়ি দু'টি সমান্তরাল রেখা বা এরূপ সমান্তরাল রেখার মধ্যে “এন্ড কোং” বা এরূপ কোনো শব্দ সংক্ষেপের উল্লেখ থাকে এবং “এতে হস্তান্তরযোগ্য নয়” এ ধরনের কোনো শব্দ উল্লেখ করা হোক বা না হোক এক্ষেত্রে যেরূপ দাগকাটা প্রতীয়মান হয় তাকে সাধারণভাবে দাগকাটা চেক বলে।

২. বিশেষভাবে দাগকাটা চেক (Specially crossed cheque): যে দাগকাটা চেকে দুই দাগের মাঝখানে কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংকের নামসহ অন্য কোনো শব্দাবলির উল্লেখ থাকে, তাকে বিশেষভাবে দাগকাটা চেক বলে। বাংলাদেশে বহাল ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১২৪ ধারায় বিশেষভাবে দাগকাটা চেক সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যেক্ষেত্রে কোনো চেকের সম্মুখভাগে “হস্তান্তরযোগ্য নয়” শব্দদ্বয়সহ বা এরূপ শব্দ ছাড়া কোনো ব্যাংকের নাম লেখা থাকে, এতে যে ধরনের দাগকাটা প্রতীয়মান হয় তাকে বিশেষভাবে দাগকাটা বা ঐ ব্যাংকের প্রতি বিশেষভাবে দাগকাটা বলা হয়ে থাকে। 

দাগকাটা চেকের বৈশিষ্ট্য | Features of Crossed Cheque


বাহক চেক বা হুকুম চেকের উপরিভাগের বাম প্রান্তে কিছু লিখে বা না লিখে দু'টি আড়াআড়ি দাগ টানস তাকে দাগকাটা চেক বলে। নিম্নে এরূপ চেকের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. দু'টি কোণাকুণি দাগ: এরূপ চেকের উপরিভাগে সাধারণত বাম পার্শ্বে দু'টি কোণাকুগি সমান্তরাল সরল রেখা টানা থাকে। অবশ্য দু'টি সমান্তরাল দাগ চেকের উপরিভাগে টানলেই তা দাগকাটা ঢেকে পরিণত হয়।

২. দাগের ভিতর কিছু লেখা বা না লেখা: সমান্তরাল সরল রেখান্বয়ের ভিতরে “এন্ড কোং”, “স্থাপকের হিসাব” ইত্যাদি লেখা থাকে। অবশ্য শুধুমাত্র সমান্তরাল সরল রেখা টানলেও ঢেকে রেখায়ন হয়ে যায়।

৩. প্রাপকের নামোল্লেখ: দাগকাটা ঢেকে প্রাপকের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়।

৪. হিসাবে জমাদান বাধ্যতামূলক: এ চেকের টাকা ব্যাংকের কোনো হিসাবে জমা দিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়। অবশ্য আমাদের দেশের সাধারণ রীতি অনুযায়ী এরূপ চেকের অর্থ সংগ্রহে তা প্রাপকের ব্যাংক হিসাবে জমা দেয়া আবশ্যক।

৫. অধিক নিরাপত্তা: এই চেক সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ এটা চুরি হলে বা হারিয়ে গেলে সহজে কেউ এর টাকা উঠাতে পারে না।

৬. রূপান্তর পদ্ধতি: চেকদাতা বা আদেষ্টা ব্যতিত অন্য কোনো ব্যক্তি দাগকাটা চেককে দাগবিহীন ঢেকে রূপান্তরিত করতে পারে না।

৭. শ্রেণিবিভাগ: চেকে দাগকাটার প্রকৃতির ভিত্তিতে একে সাধারণভাবে দাগকাটা চেক ও বিশেষভাবে দাগকাটা চেক- এই দু'ভাগে ভাগ করা হয়।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে দাগকাটা চেক অন্যান্য চেক অপেক্ষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। নিরাপত্তাগত সুবিধার কারণে এই চেক সমগ্র বিশ্বেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। 

দাগকাটা চেকের সুবিধা | Advantages of Crossed Cheque


বাহক চেক বা হুকুম চেকের উপরিভাগে বাম কোণায় আড়াআড়িভাবে সমান্তরাল দু'টি রেখা অঙ্কনের মাধ্যমে দাগকাটা চেক তৈরি করা যায়। চেকের মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা সৃষ্টি এবং ঝুঁকি হ্রাসসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা অর্জনের জন্যই ঢেকে দাগকাটা হয়। নিম্নে দাগকাটা চেকের সুবিধা আলোচনা করা হলো।

১. অধিক নিরাপত্তা (More safety): দাগকাটা চেকের অর্থ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধিত হয় বলে এই চেক হারানো বা চুরি গেলেও এর অর্থ কেউ সহজে উঠাতে পারে না। তাই এ চেকের মাধ্যমে লেনদেন অধিক নিরাপদ।

২. চেকের মূল্য পরিশোধে নিশ্চয়তা (Surity on payment): দাগকাটা চেক প্রকৃত প্রাপককে মূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এ চেকের অর্থ উত্তোলন করায় অবাঞ্ছিত কোনো বাহক এর অর্থ উত্তোলন করতে পারে না।

৩. প্রতারণা ও জালিয়াতি রোধ (Reducing fraud and cheating): দাগকাটা চেকের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার প্রতারণা ও জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হয়। মূলত এ উদ্দেশ্যেই চেকে দাগকাটা হয়ে থাকে।

৪. অপরাধী শনাক্তকরণ (Identification of criminal): দাগকাটা চেকের আরেকটি সুবিধা হলো- এ ধরনের চেকের অবাঞ্চিত কোনো পক্ষকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। চুরি যাওয়া দাগকাটা চেক ব্যাংকে আনা হলে পূর্ব সংবাদের ভিত্তিতে ব্যাংক অপরাধীকে আটক করতে পারে।

৫. বড় অঙ্কের লেনদেন (Heavy transaction): দাগকাটা চেক অর্থ লেনদেনের একটি সহজ ও নিরাপদ মাধ্যম। তাই বড় বড় অঙ্কের লেনদেন নিষ্পত্তি করতে দাগকাটা চেকের অধিক প্রচলন লক্ষ করা যায়।

৬. প্রামাণ্য দলিল (Instrument of proving): দাগকাটা চেক লেনদেন সম্পাদনে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য হয়। তাই প্রয়োজনে ব্যাংক এ চেককে আদালতে বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রামাণ্য দলি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে।

৭. রূপান্তর (Convertion): দাগকাটা চেকের আরেকটি সুবিধা হলো প্রয়োজনে দাগকাটা চেককে। আদেষ্টা দাগছাড়া চেকে রূপান্তর করতে পারে। বিশেষভাবে দাগকাটা চেককেও আদেষ্টার দ্বারা দাগছাড়া চেকে রূপান্তর করা যায়। সেক্ষেত্রে আদেষ্টা বা প্রস্তুতকারী বরাবর তা উপস্থাপন করা হয়। তিনি দাগ দু'টি একটানে কেটে পাশে নমুনা স্বাক্ষরের অনুরূপ স্বাক্ষর প্রদান করেন। 

৮. ঋণ-আমানত সৃষ্টি (Creation of loan-deposits): দাগকাটা চেক বাধ্যতামূলকভাবে ব্যাংকে জমা করতে হয় বলে ব্যাংক সহজেই ঋণ-আমানত সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ব্যাংকের ঋণ প্রদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

পরিশেষে বলা যায়, আর্থিক লেনদেনের ঝুঁকি হ্রাসের জন্য যেরূপ চেকের উৎপত্তি তেমনি চেকের অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দাগকাটা চেকের উৎপত্তি । প্রকৃতপক্ষে এ চেকের মূল উদ্দেশ্য হলো- বাহক চেক ও হুকুম চেকের অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

দাগকাটা চেকের অসুবিধা|Disadvantages of Crossed Cheque


নিরাপত্তার বিচারে দাগকাটা চেক সর্বোত্তম এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বড় পরিমাণ অঙ্কের লেনদেনে এরূপ চেক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও এটি অসুবিধামুক্ত তা বলা যায় না। নিম্নে এর অসুবিধাসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. নগদ উত্তোলনে অসুবিধা (Disadvantages to cash withdrawn): বাহক ও হুকুম চেকের অর্থ যেভাবে সরাসরি ব্যাংক কাউন্টার থেকে উত্তোলন করা যায় দাগকাটা চেকের অর্থ সেভাবে সংগ্রহ করা যায় না। এরূপ চেক ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়ে অর্থ সংগৃহীত হলে পরবর্তীতে চেক কেটে তা উঠাতে হয়। যা সময়সাপেক্ষ এবং ঝামেলাপূর্ণ।

২. হস্তান্তরে অসুবিধা (Disadvantages of negotiation): বাহক চেক যেভাবে শুধুমাত্র অর্পণের দ্বারা এবং হুকুম চেক অনুমোদন ও অর্পণের দ্বারা হস্তান্তর করা যায় ভাগকাটা চেক সেভাবে হস্তান্তর করা যায় না। এক্ষে প্রাপককেই কার্যত তার হিসাবে চেক জমা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়।

৩. অধিক উপযোগ সৃষ্টিতে বাধা (Hindrances in creating more utility): বাহক চেক ও হুকুম চেকের ক্ষেত্রে সহজেই তা হস্তান্তরের সুযোগ থাকায় একই চেক একাধিক লেনদেন সহজেই ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে এরূপ আবর্তন অর্থের সরবরাহ বাড়ায় ও অধিক উপযোগ সৃষ্টি করে। দাগকাটা চেকের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না।
Next Post Previous Post
2 Comments
  • Anonymous
    Anonymous 28 July, 2023

    Thanks

  • Jobair
    Jobair 28 July, 2023

    Thanks

Add Comment
comment url