ব্যাংক হিসাব নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়সমূহ|Factors to be Considered When Opening a Bank Account

জনাব বুলবুল আহমেদ একজন ব্যবসায়ী। প্রতি মাসে তার আয় অনেক বেশি। তাই তিনি প্রতি মাসে ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবে কিছু টাকা জমা করেন। সঞ্চয়ী হিসাবে সুদ কম হওয়ায় তিনি তার জমানো অর্থ দিয়ে একটি স্থায়ী আমানত হিসাব খোলেন। এখন টাকা জমা দিতে গিয়ে তার স্ত্রী ব্যাংকে দুটি প্রকল্পের কথা জানতে পারল।

প্রথমটিতে ৭ বছরে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা জমা দিয়ে মেয়াদ শেষে ২ লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়টিতে প্রতি মাসে ২৫,০০০ টাকা জমা দিয়ে ২০ বছরে ১ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। স্ত্রী বলার পর বুলবুল আহমেদ ভাবলেন মাসে ২৫,০০০ টাকা জমা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব। তাহলে ২০ বছর পর ১ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। ৮/৯ বছর এভাবে টাকা জমা দেওয়ার পর এখন ব্যবসায়ে মন্দার কারণে টাকা জমা দেওয়া সম্ভব পরিণত হচ্ছে না। ব্যাংক তানজীম আহমেদকে চিঠি দিচ্ছে।

এখন বুলবুল আহমেদ ও তার স্ত্রীর কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে হয়েছে। এখন ভাবছেন সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা রাখলেই ভালো করতেন। তাই বলা যায় ব্যাংক হিসাব নির্বাচনে ভুল করায় বুলবুল আহমেদকে আজকে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাই ব্যাংক হিসাব অবশ্যই চিন্তাভাবনা করে বাছাই করা উচিত। তাই ব্যাংক হিসাব খোলার সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা আবশ্যক:

১. গ্রাহকের প্রকৃতি (Nature of client): গ্রাহকের বয়স, পেশা, উপার্জন ক্ষমতা প্রভৃতি ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। প্রকৃতি অনুযায়ী গ্রাহকের লেনদেনের ধরন, তারল্য ও উপার্জনের প্রত্যাশা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। 

২. সুদের হার (Interest): সুদের হার ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। যে সকল ব্যক্তি উচ্চসুদ বা মুনাফা প্রত্যাশা করেন কিন্তু তারল্য খুব একটা প্রয়োজন নেই, তারা স্থায়ী আমানত হিসাব খুলতে পারেন। পক্ষান্তরে যে সকল ব্যক্তি সুলে পাশাপাশি তারল্যের প্রত্যাশা করেন, তারা সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে পারেন।

৩. লেনদেনের প্রকৃতি (Nature of transaction): গ্রাহকের লেনদেনের প্রকৃতির ওপর হিসাবের ধরন নির্ভর করে। যে সকল ব্যক্তির প্রতিনিয়ত প্রচুর সংখ্যক ও বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন করতে হয় এবং লেনদেনের সুবিধা ও নিরাপত্তাই সর্বাধিন প্রয়োজনীয় তাদের জন্য চলতি হিসাব সর্বোত্তম। পক্ষান্তরে যাদের লেনদেনের পরিমাণ ও সংখ্যা কম তাদের জন্য সঞ্চয়ী হিসাব উত্তম। আবার, যে সকল গ্রাহকের লেনদেন সম্পাদনের আদৌ প্রয়োজন নেই এবং শুধু বিনিয়োগ সুবিধাই মুখ্য উদ্দেশ্য তাদের জন্য স্থায়ী হিসাব আদর্শ।

৪. ব্যাকিং সুবিধা (Banking services): ব্যাংকসমূহ চলতি হিসাবের গ্রাহককে সুদ প্রদান না করলেও অন্যান্য ব্যাংকিং সুবিধা সর্বাপেক্ষা বেশি প্রদান করে। পক্ষান্তরে, স্থায়ী হিসাবে সুদ বেশি প্রদান করলেও অন্যান্য ব্যাংকিং সুবিধা খুব একটা প্রদান করে না। সঞ্চয়ী হিসাবের গ্রাহককে মাঝারি ধরনের সুদ প্রদান ও ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করে। যে সকল ব্যক্তির বিশেষত ব্যবসায়ীদের ব্যাংক প্রদত্ত সুবিধা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় তাদের জন্য চলতি হিসাব সর্বোত্তম। পক্ষান্তরে, মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের অন্যান্য ব্যাংকিং সুবিধা তেমন প্রয়োজন পড়ে না বরং বিনিয়োগ সুবিধা প্রয়োজন, তাদের জন্য সঞ্চয়ী স্থায়ী হিসাব আদর্শ বলে বিবেচিত হয়।

৫. ঋণ সুবিধা (Loan facilities): অনেক হিসাবগ্রহীতার ঋণ সুবিধার প্রয়োজন পড়ে। ব্যাংকসমূহ স্থায়ী হিসাবের বিপরীতে ঋণ মঞ্জুর করে এবং চলতি হিসাবের বিপরীতে জমাতিরিক্ত ঋণ মঞ্জুর করে।

৬. নিরাপত্তা (Safety): কোনো কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে অর্থের নিরাপত্তাপ্রাপ্তিই মুখ্য উদ্দেশ্য। বিনিয়োগের সুযোগ নেই অথচ উদ্বৃত্ত ও অলস অর্থ রয়েছে, তাদের জন্য স্থায়ী হিসাব উত্তম।

পরিশেষে বলা যায়, বাংক হিসাবের ক্ষেত্রে চলতি, সঞ্চয়ী না স্থায়ী কোনটি নির্বাচন করা হবে তা উপরিউক্ত বিক্ষ্যে বিষয়গুলোর উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও আমানতকারীর উদ্দেশ্য, ব্যাংকিং সুবিধা লেনদেনের প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।

একজন শিক্ষার্থীর জন্য যে ব্যাংক হিসাব উত্তম|Appropriate Bank Account for a Student


একজন শিক্ষার্থী কোনো উপার্জনশীল ব্যক্তি নয়। সে তার পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনের নিকট হতে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা শিক্ষা ব্যয়, খাওয়া-পরা ও আবাসন ব্যয় নির্বাহ করে। তার অনেক বেশি পরিমাণ লেনদেনের প্রয়োজন পড়ে না। একজন শিক্ষার্থীর প্রয়োজন অতিরিক্ত কিছু সুদ বা মুনাফা এবং অর্থের নিরাপত্তা। তাই তার জন্য সঞ্চয়ী হিসাব সর্বোত্তম। তাছাড়া সঞ্চয়ী হিসাব হতে একজন শিক্ষার্থী নিম্নোক্ত সুবিধা পেতে পারে:

১. সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী একই সাথে অর্থের নিরাপত্তা, স্বপ্ন হার সুদ ও নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পায়। অর্থাৎ সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী একই সাথে নিরাপত্তা, বিনিয়োগ সুবিধা ও তারল্য সুবিধা পায়।
২. এ হিসাবের মাধ্যমে যতবার ইচ্ছা অর্থ জমাদান করা যায়।
৩. এ হিসাবের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত হলেও একাধিকবার অর্থ উত্তোলন করা যায়।
৪. এ ধরনের হিসাব খুললে একজন শিক্ষার্থীকে অর্থ উত্তোলনের জন্য চেক বই এবং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য পাশ বই দেওয়া হয়।
৫. সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়া যায়। ATM, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, (EFT), ইলেকট্রনিক কার্ড ও চেক এবং অন্যান্য প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সুবিধা সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে পাওয়া যায়।

একজন চাকরিজীবীর জন্য উপযুক্ত ব্যাংক হিসাব|Appropriate Bank Account for a Service Holder 


একজন চাকরিজীবী সাধারণভাবে মাসের শেষে বেতন পান এবং অল্প অল্প করে সারা মাস ধরে বেতনের অর্থ ব্যয় করেন। তার বড় অঙ্কের লেনদেন বা অসংখ্যবার লেনদেনের প্রয়োজন পড়ে না। সেজন্য একজন চাকরিজীবীর জন্য সঞ্চয়ী হিসাব সর্বোত্তম। সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে একই সাথে সে জমাকৃত অর্থের নিরাপত্তা, বিনিয়োগ সুযোগ ও সীমিত লেনদেন সুবিধা পেতে পারেন। তাছাড়া সঞ্চয়ী হিসাব হতে তিনি নিম্নোক্ত সুবিধা পেয়ে থাকেন:

১. সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে একজন চাকরিজীবী একই সাথে অর্থের নিরাপত্তা, স্বল্প হার সুদ ও নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পান। অর্থাৎ সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে একজন চাকরিজীবী একই সাথে নিরাপত্তা, বিনিয়োগ সুবিধা ও তারল্য সুবিধা পেয়ে থাকেন।
২. এ হিসাবে তিনি যতবার ইচ্ছা অর্থ জমাদান করতে পারেন।
৩. এ হিসাবের মাধ্যমে তিনি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত হলেও একাধিকবার অর্থ উত্তোলন করতে পারেন।
৪. এ ধরনের হিসাব খুললে একজন চাকরিজীবী অর্থ উত্তোলনের জন্য চেক বই এবং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য পশ বই পান।
৫. সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ব্যাকিং সুবিধা পেয়ে থাকেন। ATM, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফর (EFT), ইলেকট্রনিক কার্ড ও চেক এবং অন্যান্য প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সুবিধা সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে পান।
৬. সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতির বিল পরিশোধ করতে পারেন।
৭. এ হিসাবের মাধ্যমে একজন চাকরিজীবী বেতন ও পেনশন উত্তোলনের সুবিধা পান।

একজন ব্যবসায়ীর জন্য উপযুক্ত ব্যাংক হিসাব|Appropriate Bank Account for a Businessman 


এজন ব্যবসায়ীকে প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক ও বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন সম্পাদন করতে হয়। তার জন্য বিনিয়োগ সুবিধার চাইতে বেশি প্রয়োজন লেনদেন সম্পাদনের সুবিধা, লেনদেনের নিরাপত্তা ও তারল্য। সেজন্য ব্যবসায়ীর জন্য চলতি হিসাব সর্বোত্তম। তাছাড়া চলতি হিসাবের মাধ্যমে একজন ব্যবসায়ী নিম্নোক্ত সুবিধা পেতে পারেন:

১. বিভিন্ন ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পাদনের সুবিধাপ্রাপ্তি ও ঝুঁকিবিহীন লেনদেনের জন্য চলতি হিসাব সর্বোত্তম।
২. চলতি হিসাবের মাধ্যমে একজন ব্যবসায়ী অসংখ্যবার এবং যেকোনো পরিমাণ অর্থের জন্য লেনদেন সম্পাদন করতে পারেন।
৩. নগদ লেনদেনের ঝুঁকি এড়াতে চলতি হিসাব সুবিধাজনক।
৪. চলতি হিসাবের মাধ্যমে ব্যবসায়ী জমাতিরিক্ত ঋণের সুবিধা পান; যা ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক লেনদেন সম্পাদনে প্রত্যয়পত্র খোলা, বিলে স্বীকৃতিদানসহ সকল ধরনের ব্যাংকিং প্রয়োজনীয় ব্যাংক সহায়তা, পরামর্শ, বৈদেশিক সেবা চলতি হিসাবের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন।
৬. চলতি হিসাবের মাধ্যমে ব্যবসায়ী চেক, বিল, ড্রাফট প্রভৃতির অর্থ সংগ্রহ ও পরিশোধ করতে পারেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url