ব্যাংক বা ব্যাংকিং ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য|Features of a Bank and the Banking business
ব্যাংক হলো একটি মধ্যস্থ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এটি এক শ্রেণির মানুষের নিকট হতে অর্থ সগ্রহ করে অন্য শ্রেণির মানুষকে উক্ত অর্থ ধার দেওয়ার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। ব্যাংকের মুনাফা হলো ঋণগ্রহণকারী পক্ষের নিকট হতে প্রাপ্ত সুদ এবং আমানত জমাকারী পক্ষকে প্রদত্ত সুদের পার্থক্য। ব্যাকে যেহেতু অর্থ ও ঋণের ব্যবসায়ে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান তাই সাধারণ ব্যবসায় হতে এর প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। ব্যাংক ব্যবসায়ের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. আর্থিক মধ্যস্থ প্রতিষ্ঠান (Financial intermediary Institution): ব্যাংক বিশেষ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের প্রায় যাবতীয় কার্যক্রম অর্থকে ঘিরে সম্পাদিত হয়। ব্যাংক আর্থিক পণ্যের ব্যবসায়ী। ব্যাংক জনগণের নিকট হতে উদ্বৃত্ত সপ্তগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের ঋণ পণ্যে রূপার করে অন্য একশ্রেণির ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে তা ঋণ হিসাবে বিতরণ করে। অর্থাৎ ব্যাংক শুধু আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধনকারী হিসাবে ভূমিকা পালন করে। এজন্য ব্যাংককে আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান বলা হয়।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা
২. সম্পদ রূপান্তরকারী (Asset tansformer): ব্যাংক দায় গ্রহণের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যাংক আমানত হিসাবে যখন অর্থ সাহ করে তখন ব্যাংক আমানতকারীর নিকট উক্ত আমানতকৃত অর্থের জন্য দায়বদ্ধ থাকে। একইভাবে আর্থিক বাজারে কোনো আর্থিক হাতিয়ার (শেয়ার) বিক্রয় করেও বিনিয়োগকারীদের নিকট হতে দায় গ্রহণ করে। দায় হিসাবে সংগৃহীত অর্থকে বিভিন্ন ধরনের সম্পদে রূপান্তর করে। ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ বিনিয়োগ প্রভৃতি ব্যাংকের সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত দায়কে সম্পদে পরিণত করার এই প্রক্রিয়াকে সম্পন রূপান্তরকরণ (Asset transformation) বলে।
৩. আমানত সংগ্রহ (Deposit collection): ব্যাকে যে অর্থ ব্যবহার করে ব্যবসায় করে তার অধিকাংশই বাহ্যিক বিভিন্ন উৎস হতে আমানত সংগ্রহ করে। অর্থাৎ ব্যাংক প্রধানত অন্যের অর্থ দিয়েই ব্যবসায় পরিচালনা করে। ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের আমানত হিসাবে যে অর্থ সংগ্রহ করে তাই ব্যাংক তহবিলের সর্ববৃহৎ অংশ। অর্থাৎ ব্যাংকের ব্যবসায় বহুলাংশে আমানত সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল।
৪. ঋণদান (Loan disbursement): ব্যাংক আমানত হিসেবে সংগৃহীত অর্থ অলস ফেলে রাখে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশিত নির্দিষ্ট পরিমাণ সঞ্চিতি রেখে বাকি অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। বিতরণকৃত ঋণ হতে অর্জিত সুদই ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক স্বপ্ন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে থাকে।
৫. বিনিয়োগ (Investment): ব্যাংক আমানত হিসেবে সংগৃহীত অর্থ শুধু ঋণ হিসেবেই বিতরণ করে না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক সরাসরি নিজেই বিনিয়োগ করে।
৬. চেকের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ প্রদান (Providing facility of withdrawing cash using cheque by depositors): ব্যাংকের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ব্যাংক নিজ নামে প্রস্তুতকৃত চেকের মাধ্যমে আমানতকারীকে তার আমানতকৃত অর্থ উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করে। তাছাড়া ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডারের মাধ্যমেও ব্যাংক অর্থ উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করে ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান চেক, ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করতে পারে না।
৭. বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টিকারী (Developer of mode of exchange): কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট ও মুদ্রা প্রচলন করে, যা বিনিময়ের সর্বজন স্বীকৃত মাধ্যম। অন্যদিকে, বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ চেক, বিনিময় বিল, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, ট্রাভেলার্স চেক প্রভৃতি বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টি করে।
৮. প্রতিনিধিত্বকারী (Agent of customer): ব্যাংক গ্রাহকদের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। ব্যাংক গ্রাহকের পক্ষে তার পাওনা অর্থ আদায়, প্রাপ্য বিলের অর্থ আদায় বিনিয়োগের সুদ ও লভ্যাংশ আদায় করে। একইভাবে দেনা পরিশোধ, মূল্য পরিশোধ, প্রদেয় বিলের অর্থ পরিশোধসহ বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে ব্যাকে গ্রাহকের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
৯. আর্থিক সেবাদানকারী (Provider of financial services): ব্যাংক আমানত হিসেবে গৃহীত অর্থের নিরাপন সংরক্ষক। তাছাড়া লেনদেন সম্পাদনে স্বীকৃতিপত্র ইস্যু, প্রত্যয়পত্র ইস্যু, পরামর্শ প্রদান, অর্থ স্থানান্তর, বৈদেশিক মুদ্রা সপ্তগ্রহ, অবলেখন প্রভৃতি আর্থিক সেবা প্রদান করে। অর্থাৎ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান।
১০. সাংগঠনিক কাঠামো (Organization structure): সাধারণত ব্যাংক বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান। দেশে প্রচলিত ব্যাংকিং আইনের আওতায় যেকোনো ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান গঠিত হতে পারে। অর্থাৎ ব্যাংক এক মালিকানা, অংশীদারি অথবা যৌথমূলধনি হতে পারে। তবে বর্তমান বিশ্বে ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ব্যাপক আধুনিকায়ন ও কার্যাবলির পরিসর বড়ো হওয়ায় বর্তমানে যৌথমূলধনি সংগঠনের মাধ্যমেই ব্যাংক ব্যবসায় গঠিত ও পরিচালিত হয়।
১১. সর্ববৃহৎ মূলধন সরবরাহকারী (Largest capital provider): ব্যবসায় জগতে ব্যাংকই সর্ববৃহৎ মূলধন সরবরাহকারী। উন্নত বিশ্বে বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের বাহ্যিক অর্থায়নের ৪৫ ভাগেরও বেশি ব্যাংকে সরবরাহ করে। তাছাড়া সরকারও উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য ব্যাংক হতে অর্থায়ন গ্রহণ করে। তাই ব্যাংককে মূলধনের কারখানা বললে অত্যুক্তি হবে না।
১২. অতিনিয়ন্ত্রিত ব্যবসায় (Highly regulated business): বিশ্বে অন্য সকল ধরনের ব্যবসায় অপেক্ষা সম্ভবত ব্যাংকিং ব্যবসায় বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যাংক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায় প্রত্যেক দেশে ব্যাংকিং আইন বিদ্যমান। তাছাড়া অভিভাবক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ওপর নিবিড় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাং ব্যবসায়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় Bank for International Settlement (BI) এর আওতায় গঠিত ব্যাসেল কমিটি ব্যাংক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাসেল সম্মতি প্রণয়ন করে, যা প্রায় সারা বিশ্বেই অনুসরণ করা হয়।
১৩. নিরাপত্তা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক Symbol of safety & trust): ব্যাংক আমানতকারীদের আমানতকৃত অর্থ ও সম্পত্তির নিরাপদ সড়ক্ষক। ব্যাংকসমূহ আমানত হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের এবং লকারে রক্ষিত মূল্যবান সম্পত্তির নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে। এজন্য একে নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া ব্যাংক অন্যের অর্থে ব্যবসায় করে। একারণে তাকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে যেমনি ব্যবসায় পরিচালনা করতে হয় তেমনি যথাসময়ে উপযুক্ত সেবা প্রদানে আন্তরিক থাকতে হয়। কারণ জনগণের আস্থা অর্জনের মধ্যেই তার সাফল্য অন্তর্নিহিত থাকে। উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক হচ্ছে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী একটি প্রতিষ্ঠান। এটি নিজের টাকায় নয় পরের টাকায় ব্যবসায় করে। তাই উপর্যুক্ত স্বতয় বৈশিষ্ট্যাবলি এ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়।