চেকের অনুমোদন বা হস্তান্তর | Negotiation or Indorsement of Cheque

ইংরেজি Indorsement শব্দটি ল্যাটিন Indorsum শব্দ হতে উদ্ভূত। যার অর্থ হলো পিছন পিঠে স্বাক্ষর করা। অর্থাৎ কারও নিকট হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে চেকের পিঠে স্বাক্ষর করাকে সাধারণভাবে চেকের অনুমোদন বলে। হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন অনুযায়ী চেক এক ধরনের হস্তান্তরযোগ্য ঋণের দলিল, যা বৈধ অনুমোদনের দ্বারা একজনের নিকট থেকে অন্যজনের নিকট হস্তান্তর করা যায়।

তবে এরূপ অনুমোদন অবশ্যই আইনাননুগ হতে হয়। আমাদের দেশে বহাল হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন অনুসারে বৈধ অনুমোদনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নিয়ম প্রযুক্ত হয়:

১. বাহকের চেক শুধুমাত্র প্রদানের মাধ্যমে হস্তান্তর বা অনুমোদন করা যায়।
২. হুকুম চেকে অবশ্যই উল্টো পিঠে বৈধ অধিকারীকে স্বাক্ষর দিয়ে অনুমোদন ও হস্তান্তর করতে হয়। অনুমোদন অবশ্যই সম্পূর্ণ চেকের জন্য হতে হয়।
৩. আংশিক অনুমোদনে পূর্ণ হস্তান্তর বুঝায় না।
৪. হুকুম চেকে একাধিক প্রাপকের নামোল্লেখ থাকলে অনুমোদনের ক্ষেত্রে সকল প্রাপকের স্বাক্ষর থাকতে ‌হয়।৫. প্রাপক বা প্রাপকদের পক্ষে তাদের আইনানুগ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিও স্বাক্ষর করে অনুমোদন করতে পারে।
৬. চেকে দুই বা ততোধিক অনুমোদন স্বাক্ষর থাকলে প্রতিটি ক্রমানুসারে ধরা হয়।
৭. আমাদের দেশে দাগকাটা চেক কখনই অনুমোদন দেয়া বা হস্তান্তর করা যায় না।

উপসংহারে বলা যায়, হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে চেকের পিঠে বা এতদসংগে সংযুক্ত কাগজে কিছু লিখে বা না লিখে এর প্রাপক কর্তৃক স্বাক্ষর কার্যকে চেকের অনুমোদন বা স্বত্ত্বান্তরকরণ বলে। এর ফলে নতুন প্রাপক পূর্ববর্তী প্রাপকের ন্যায় আইনগত অধিকার ভোগ করে।
Indorsement of Cheque

চেকের অনুমোদনের প্রকারভেদ | Types of Negotiation of Cheque


হস্তান্তরের উদ্দেশ্য হুকুম চেকের উল্টো পিঠে বা এতদসংলগ্ন কাগজে কিছু লিখে বা না লিখে স্বাক্ষর করাকেই চেকের অনুমোদন বলে। এরূপ অনুমোদন নানান ধরনের হয়ে থাকে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:

১. সাধারণ বা ফাঁকা অনুমোদন (Blank endorsement): চেকের আদেষ্টা বা প্রাপক চেকের উল্টো পৃষ্ঠায় কিছু না লিখে হস্তাত্তরের উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র স্বাক্ষর করলে তাকে সাধারণ বা ফাঁকা অনুমোদন বলে। এরূপ অনুমোদনের ফলে যে কেউ ব্যাংক থেকে এরূপ চেকের অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। এরূপ অনুমোদনের ফলে হুকুম চেক মূলত বাহক চেকে পরিণত হয়। আদেষ্টা যদি প্রাপকের নামের স্থলে ‘নিজ’ লেখে এবং পিছনে নমুনা স্বাক্ষর দেয় তবে ঐ চেক যে বাহক ঢেকে পরিণত হয়েছে সেটা প্রমাণ ব্যাংকের পক্ষে সহজ। অন্যথায় প্রাপকের পরিচিতি ও বাহকের পরিচিতি ব্যাংক পরীক্ষা করবে।

২. বিশেষ বা পূর্ণ অনুমোদন (Special or full endorsement): যখন অনুমোদনকারী চেকের পিঠে কাকে অনুমোদন করে হস্তান্তর করা হলো তার নাম উল্লেখপূর্বক স্বাক্ষর করে তাকে বিশেষ বা পূর্ণ অনুমোদন বলে। যদি চেকের প্রাপক চেকের পিঠে লিখে যে- মি. মামুনকে অথবা তার আদেশ অনুসারে দেয় তবে তাকে এ ধরনের অনুমোদন বলা হবে। সেক্ষেত্রে মি. মামুন কাউকে অনুমোদন করতে চাইলে আগের মতো কিছু লিখে বা না লিখে স্বাক্ষর করবেন।

৩. সীমিত অনুমোদন (Restrictive endorsement): এ ধরনের অনুমোদনের ফলে অনুমোদন বলে প্রাপক এর মালিকানা লাভ করলেও পুনরায় তা হস্তান্তর করতে পারে না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নতুন প্রাপকের হস্তান্তরের অধিকার সীমিত করা হয়। যদি প্রাপক ‘ক’ চেকের পিঠে লিখে যে শুধুমাত্র ‘খ’ কে প্রদান করুন তবে তা এর উদাহরণ।

৪. শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন (Canditional endorsement): চেকের অনুমোদনের সাথে কোনো ধরনের শর্ত আরোপ করা হলে তাকে শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন বলে। চেক এক ধরনের হস্তান্তরযোগ্য দলিল। তাই এটি অর্থ প্রদানের শর্তহীন নির্দেশ। বিলের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষ স্বীকৃতি বিলের আদেষ্টা কর্তৃক গৃহীত হতে পারে। চেকের ক্ষেত্রেও তাই শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন গ্রহণযোগ্য। যেমন- চেকের পিঠে ১ মে তারিখে লেখা হলো ১৫ মে তারিখের পরে প্রদান করুন ‘অথবা’ গুদামে মাল পৌছানোর নিশ্চিত খবর প্রাপ্তি সাপেক্ষে রহিমকে প্রদান করুন।

চেকের অমর্যাদা Dishonour of Cheque


ব্যাংক কর্তৃক চেকের অর্থ প্রদানের অস্বীকৃতিকে চেকের অমর্যাদা বলে। চেক হলো আদেষ্টা কর্তৃক ব্যাংকের ওপর চাহিবামাত্র অর্থ প্রদানের একটি শর্তহীন নির্দেশনামা। ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের বর্ণনা

অনুসারে চেক ব্যাংকে উপস্থিত করা মাত্র কোনো প্রকার অনিয়ম না থাকলে ব্যাংক চেকের টাকা প্রদানে বাধ্য থাকে। কিন্তু আইনসঙ্গত কারণ লক্ষ্য করা গেলে সেক্ষেত্রে ব্যাংক চেকের অর্থ পরিশোধ করে না। অর্থাৎ, চেকের অর্থ প্রদান না করে ব্যাংক কর্তৃক চেকটি ফেরত দেয়া হলে তা চেকের অসম্মান বলে বিবেচিত হয়। যে কোনো ব্যাংকে চেক অমর্যাদার কারণ সম্বলিত একটি ফরম ছাপানো থাকে। কোনো চেক অমর্যাদাকৃত হলে ঐ ছাপানো ফরমে বর্ণিত কারণের পাশে একটি (✓) চিহ্ন প্রদান করে ব্যাংক উক্ত ফরম চেকসহ চেকের ধারককে ফেরত দেয়।

ফলে প্রাপক বা ধারক চেক অমর্যাদার কারণ সম্বন্ধে জানতে ও প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। একটি বৈধ চেকের কতকগুলো অপরিহার্য শর্ত থাকে যা পালিত না হলে চেক স্বভাবতই অমর্যাদাকৃত হয়। এরূপ শর্তসমূহ নিম্নরূপ:

১. চেকের পাতা যথাযথভাবে পূরণ করা
২. হিসাবে আমানতকারীর পর্যাপ্ত টাকা থাকা
৩. হিসাব চালু অবস্থায় থাকা
৪. ব্যাংকে সংরক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের অনুরূপ স্বাক্ষর চেকে প্রদান করা
৫. হিসাব সম্পর্কে গ্রাহকের বা আদালতের কোনো বিশেষ নির্দেশ না থাকা ইত্যাদি।

পরিশেষে বলা যায়, চেক পরিশোধের শর্তসমূহের অনুপস্থিতিতে ব্যাংক চেকের অর্থ পরিশোধ করতে অসম্মতি প্রকাশ করলে তাকে চেক প্রত্যাখ্যান বা চেকের অমর্যাদাকরণ বলে। কোনো চেক অমর্যাদাকৃত হলেও তার আইনগত গুরুত্ব বহাল থাকে। অর্থাৎ প্রাপকের পাওনা প্রমাণে তা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়।

চেক অমর্যাদাকৃত বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণ | Reasons for Dishonour of Cheque


আমানতকারী কর্তৃক কোনো চেক ব্যাংকে উপস্থাপিত হওয়ার পর ব্যাংক উক্ত চেকের অর্থ পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে চেক প্রত্যাখ্যান বলে। এক বা একাধিক ন্যায়সঙ্গত কারণে ব্যাংক চেক পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। নিম্নে চেক অমার্যাদার কারণগুলো বর্ণনা করা হলো:

১. চেক লেখকের উপযুক্ত পরিমাণ অর্থ না থাকলে বা জমাতিরিক্ত ঋণের কোনো বন্দোবস্ত না থাকলে
২. চেকে আদেষ্টার স্বাক্ষর না থাকলে
৩. চেকে প্রদত্ত আদেষ্টার স্বাক্ষর অস্পষ্ট হলে
৪. চেকে প্রদত্ত স্বাক্ষর এবং ব্যাংকে সংরক্ষিত স্বাক্ষর না মিললে
৫. চেকে তারিখ না থাকলে
৬. চেকের তারিখ অস্পষ্ট হলে
৭. তারিখের ওপর কাটাকাটি (Overwrting) থাকলে এবং তথায় নমুনা স্বাক্ষর না দিলে
৮. চেকে টাকার পরিমাণ উল্লেখ না থাকলে
চেকে টাকার পরিমাণ কথায় এবং অঙ্কে গরমিল থাকলে
১০. টাকার অঙ্কে বা কথায় লিখনে ঘষামাজা হলে
১১. পূর্ব বা পর তারিখের চেক হলে
১২. চেক বাসি হলে
১৩. ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিয়া দ্বিতীয় পত্র চেকে হিসাব নম্বর না থাকলে
১৪. এক হিসাবের চেক অন্য হিসাবে ব্যবহার করলে
১৫. অন্য ব্যাংকের বা শাখার চেক উত্থাপিত হলে
১৬. চেকে কাটাকাটি থাকলে এবং নমুনা দস্তখত না দিলে
১৭. চেকে অনুমোদনের প্রয়োজন হলে এবং তা না থাকলে
১৮. হুকুম চেকে প্রাপকের নাম না থাকলে
১৯. হুকুম চেকে হস্তান্তর আইনসিদ্ধ না হলে
২০. চেকে আদেষ্টার সীলমোহর প্রয়োজন হলে এবং তা না থাকলে
২১. চেক যথাসময়ে ব্যাংকে উপস্থাপন করা না হলে
২২. শর্তযুক্ত অনুমোদনের ক্ষেত্রে শর্ত পূরণ না হলে
২৩. দাগকাটা চেক যথানিয়মে উপস্থাপন করা না হলে
২৪. চেক ছেঁড়া বা অস্পষ্ট হলে
২৫. অনলাইন ব্যাংকিং সুযোগ বা থাকলে এবং অন্য ব্যাংকের শাখার চেক উপস্থাপিত হলে
২৬. আমানতকারীর ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের ওপর ব্যাংকের কোনো পূর্বস্বত্ব থাকলে
২৭. ব্যাংকে একাধিক ব্যক্তির নামে যৌথ হিসাবের ক্ষেত্রে সকল আমানতকারী বা যারা জীবিত আছে তাদের সকলের স্বাক্ষর না থাকলে
২৮. গ্রাহকের চেক হারানো গিয়েছে, এ মর্মে ব্যাংক জ্ঞাত হলে
২৯. চেক লেখক কোনো নির্দিষ্ট চেকের টাকা প্রদানে নিষেধাজ্ঞামূলক বিজ্ঞপ্তি দিলে
৩০. চেক লেখার পর চেক লেখকের মৃত্যু বা দেউলিয়াত্বের নোটিস ব্যাংক পেলে
৩১. আদেষ্টার মস্তিষ্ক বিকৃতির নোটিস ব্যাংক পেলে
৩২. চেকের ধারকের স্বত্বে কোনো ত্রুটি আছে বলে ব্যাংক পরিষ্কার বুঝতে পারলে
৩৩. চেকের অর্থ প্রদানে বা আমানতকারীর হিসাব থেকে কোনো টাকা প্রদানে ব্যাংক আদালত কর্তৃক গরিনিশী আদেশ বা নিষেধাজ্ঞামূলক কোনো বিজ্ঞপ্তি পেলে 

উপরোক্ত এক বা একাধিক কারণে ব্যাংক চেকের অমর্যাদা করতে পারে। এ ছাড়াও ব্যাংক যদি কোনো কারণে চেকের উপস্থাপক সম্পর্কে বা উত্থাপিত চেক সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হতে না পারে তবে সেক্ষেত্রেও চেকের অর্থ প্রদানে বিরত থাকতে পারে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url