আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রেমিটেন্সের ভূমিকা| Role of Remittance in Socio-economic Development
রেমিট্যান্স কি?|What is Remittance
রেমিট্যান্স হলো বিদেশ হতে দেশে অর্থ প্রেরণ। অর্থাৎ রেমিটেন্স বলতে নিজ দেশের বাইরে কর্মরত ব্যক্তি কর্তৃক তার পরিবার বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রেরিত অর্থকে বোঝায়। রেমিটেন্স যেকোনো দেশের জন্যই বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসতে পারে তবু উন্নয়নশীল দেশগুলোই রেমিটেন্সের প্রধান গ্রহীতা।
John Black- এর মতে,
বিদেশে কর্মরত কর্মীদের কর্তৃক নিজ দেশে অর্থ প্রেরণকে রেমিটেন্স বলে।
সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর সবচেয়ে। বেশি রেমিটেন্স গ্রহণকারী দেশ ভারত। বাংলাদেশের রেমিটেন্স গ্রহণের হার বর্তমানে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১০%। এর আর্থ-সামাজিক ভূমিকা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রেমিটেন্সের ভূমিকা|Role of Remittance in Socio-economic Development
বিশ্বায়নের এই যুগে এক দেশের লোক অন্য দেশে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত নিজ দেশে অর্থ প্রেরণ করতে হয়। আর এই অর্থ প্রেরণই হলো রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল দেশ। জনশক্তির তুলনায় পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র এদেশে নেই । তাই বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি করে। অর্থাৎ যে দেশে উদ্বৃত্ত জনশক্তি ও মানবসম্পদ বিদ্যমান এবং বেকারত্ব বেশি সে সকল দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. জাতীয় ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি (Increasing national and per-capita income): বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে কর্মরত থেকে যে আয় করে তা জাতীয় আয় হিসাবের মধ্যে ধরা হয়। যে ছেলে-মেয়ে দেশে বেকার ঘুরে বেড়াতো সে যখন বিদেশে যেয়ে আয় করে ও অর্থ দেশে পাঠায় তা নিঃসন্দেহে জাতীয় ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
২. রাষ্ট্রীয় সামর্থ্য বৃদ্ধি (Increasing state ability): বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়ায়। এরূপ বৈদেশিক মুদ্রা সরকার মূলধনী দ্রব্যাদি আমদানিতে ব্যয় করতে পারে। এছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রতিকূল ভারসাম্য এর দ্বারা হ্রাস পায়। আন্তর্জাতিক মন্দাবস্থার পরও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারার অন্যতম শক্তি হিসেবে রেমিটেন্স যে ভূমিকা রেখেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৩. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি (Increasing the reserve of foreign currency): একটা দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার যতটুকু রিজার্ভ গড়ে উঠেছে তাতে রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গার্মেন্টস শিল্পখাতে রপ্তানি বাণিজ্য বেশি হলেও সেক্ষেত্রে কাপড়সহ উপকরণ আমদানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। অথচ রেমিটেন্সের আয় কার্যত খরচ বহির্ভূত।
৪. দেশীয় মুদ্রার মূল্যমান বৃদ্ধি (Increasing the value of local currency): বর্তমানকালে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের ওপর ভিত্তি করে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার বা মূল্যমান নির্ণীত হয়। একটা দেশের প্রচুর জনশক্তি যখন বিদেশে কর্মরত থাকে ও অর্থ পাঠায় তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রেরিত রেমিটেন্স দেশীয় মুদ্রার মূল্যমান বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৫. পরিবারিক সমৃদ্ধি অর্জন (Earning family prosperity): বিদেশে কর্মরত জনশক্তি যখন দেশে টাকা পাঠায় তখন দেশ যেমনি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পায় তেমনি পরিবারগুলো দেশীয় মুদ্রায় প্রেরিত অর্থ লাভ করে। এতে পারিবারিক জীবনে স্বচ্ছন্দ আসে। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে এখন যে স্বচ্ছন্দ লক্ষণীয় তার একটা বড় কারণ হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।
৬. বেকার সমস্যার সমাধান (Solving unemployment problem): বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ হওয়ায় দেশের বেকার সমস্যার সমাধান ঘটে। একটা পরিবারের একটা সন্তান যখন বিদেশে থেকে টাকা পাঠায় তখন ঐ টাকা তার ছোট ভাই বা আত্মীয়রা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে বা ব্যবসায় গড়ে তুলে কাজে লাগায়। যা বেকার সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে।
৭. ভোগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি (Increasing cusumption and production): বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিটেন্স পরিবারগুলোর ভোগ সামর্থ্য বাড়ায়। ফলে দেশে ভোগের পরিমাণ বাড়ে ও বাজার সম্প্রসারিত হয়। এতে উৎপাদন বাড়ে। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তা নিশ্চিতভাবে মানুষের আয় বৃদ্ধি করে। আয় বৃদ্ধি পেলে যেমনি আবার ভোগ বাড়ে তেমনি এর অংশবিশেষ সঞ্চয় ও মূলধন বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে।
৯. বাণিজ্য ঘাটতির অর্থায়ন (Financing trade deficit): বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই অতিমাত্রায় আমদানি নির্ভর একটি দেশ। বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, যানবাহন এবং বিভিন্ন মূলধনজাতীয় সম্পদ আমদানি করে। যার জন্য একে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার মতো যথেষ্ট পণ্য বা সেবা উৎপাদন করতে পারে না। ফলে বাংলাদেশে সর্বদাই বাণিজ্য ঘাটতি (রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি বেশি) বিদ্যমান। রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি ব্যয় মেটাতে একেবারেই অপর্যাপ্ত। রেমিট্যান্স বাণিজ্য ঘাটতি অর্থায়নে ভূমিকা পালন করে।
১০. পরিশোধ উদ্বৃত্তের উন্নয়ন (Improvement in balance of payment): পরিশোধ উদ্বৃত্ত কোনো দেশের জনগণের সাথে অন্যান্য দেশের জনগণের লেনদেনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তি ও পরিশোধের পার্থক্যকে নির্দেশ করে। পরিশোধ উদ্বৃত্ত সকল ধরনের লেনদেনকে অন্তর্ভুক্ত করে। পক্ষান্তরে, বাণিজ্য উদ্বৃত্ত শুধু পণ্যের আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত লেনদেনকে অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশে বাণিজ্য ঘাটতি থাকার কারণে তা সবসময়ই সার্বিক পরিশোধ উদ্বৃত্তের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রেমিট্যান্স পরিশোধ উদ্বৃত্তের উন্নয়ন ঘটায়। পূর্বে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশকে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভর করতে হতো। সে অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করেছে রেমিট্যান্স।
১১. বিনিয়োগ বৃদ্ধি (Increased investment): দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে দেশীয় সঞ্চয় তথা বিনিয়োগের পরিমাণ কম। দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অস্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগও (Foreign Direct Investment-FDI) আশাব্যাঞ্জক নয়। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের অন্তরায়। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখে। যদিও রেমিট্যান্স হিসেবে অর্জিত অর্থ সাধারণভাবে বিদেশে যাওয়ার জন্য গৃহীত পরিশোধ (১০.৫৫%), জমি ও কৃষি সরঞ্জাম ক্রয় (১১.২৪%), শিক্ষা ব্যয় (২.৭৫%), খাদ্য ও পোশাক ক্রয় (২০.৪৫ %), গৃহাদি নির্মাণ (১৫.০২%) কাজে ব্যবহৃত হয়। তথাপি রেমিট্যান্স হিসাবে অর্জিত অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়ক। বিনিয়োগ বৃদ্ধি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
১২. দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ (Preventing devaluation of domestic currency): বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় মেটাতে সর্বদাই বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সবসময়ই বৈদেশিক মুদ্রার যোগান অপেক্ষা বেশি থাকে বলে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মূল্য হ্রাস পায়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পায় যা দেশীয় মুদ্রার মানে স্থিতিশীলতা রক্ষায় অবদান রাখে।
রেমিট্যান্সের সমস্যা | Problems related to remittance
দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে রেমিট্যান্স আশীর্বাদস্বরূপ। তবে রেমিট্যান্স শুধু ইতিবাচক দিক সম্পন্ন নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রেমিট্যান্স কিছু সমস্যাও সৃষ্টি করে। যেমন
১. মেধা পাচার (Brain drain): পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ দেশান্তরিত হলে দেশে সৃষ্ট মেধা পাচার হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি ভর্তুকিতে পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের পর সেই দক্ষ মানুষ দেশান্তরিত হলে তার দক্ষ সেবা ও উৎপাদন কর্মকাণ্ড হতে দেশ বঞ্চিত হয়। দেশের অর্থে সৃষ্ট দক্ষতা দেশের সেবা কার্যে ব্যবহৃত হয় না। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
২. বিলাস পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি (Increase in import of luxury products): রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে বিলাস পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পায়। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব পণ্যের আমদানি পুনরায় দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি করে ও পরিশোধ উদ্বৃত্তের অবনতি ঘটায়।
৩. রেমিট্যাপের অপব্যবহার (Misuse of remittance): রেমিট্যাপ অর্জনকারী পরিবারের সদস্যরা সহজেই অধিক অর্থ প্রবাহ অর্জন করে। এ সকল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিশেষত তরুণ-তরুণীদের এ অর্থের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়।
৪. আঞ্চলিক বৈষম্য (Regional disparity): রেমিট্যাপ পরোক্ষভাবে আঞ্চলিক বৈষম্যকে উসকে দেয়। বাংলাদেশে সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চলের প্রচুর সংখ্যক মানুষ প্রবাসী। যা অন্যান্য জেলার সাথে বৈষম্য বৃদ্ধি করে।
৫ . আয় বৈষম্য (Income inequality): উন্নত ও বেশি আয়ের দেশসমূহে সাধারণভাবেই শ্রমের মূল্য বেশি। ফলে ঐ সকল দেশে কর্মরত পেশাজীবী ও শ্রমিকরা বেশি পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে এবং তা তাদের পরিবারে প্রেরণ করে। এর ফলে আয় বৈষম্য দেখা দেয়।
পরিশেষে বলা যায়, রেমিট্যান্সের নেতিবাচক কতকগুলো দিক থাকলেও এর সুবিধা অনেক বেশি। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।