বিশেষায়িত ব্যাংকের প্রকারভেদ Types of Specialised bank

বিশেষায়িত ব্যাংক কি?|What is Specialised Bank


যে সকল ব্যাংক গ্রাহকদের প্রয়োজন ও অর্থনীতির বিশেষ কোনো দিকে নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে বিশেষায়িত ব্যাংক বলে।

নিম্নে এ ধরনের ব্যাংকসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

১. কৃষি ব্যাংক (Agricultural bank): দেশের কৃষিখাত উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষকদের অর্থসংস্থানের জন্য যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে কৃষি ব্যাংক বলে। এটি একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার কাজ হলো কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ ইত্যাদি ক্রয়ে প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করা। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এ লক্ষ্যেই গঠিত ও পরিচালিত এ দেশের দু'টি উল্লেখযোগ্য ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান।

২. শিল্প ব্যাংক (Industrial bank): শিল্প ব্যাংকও একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। দেশের শিল্পখাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংককে শিল্প ব্যাংক বলে। এ ব্যাংকের মূল কাজ হলো শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি ও সেই সাথে প্রয়োজনীয় স্বল্পমেয়াদি ঋণদান, শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয়ে সহযোগিতা ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করা। বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক লিমিটেড (BDBL) বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংকের উদাহরণ।

৩. সঞ্চয়ী বা আমানত ব্যাংক (Savings or desposit bank): জনগণের নিকট পড়ে থাকা বিক্ষিপ্ত সঞ্চয়গুলোকে আমানত হিসেবে সংগ্রহ করে মূলধন গঠনের লক্ষ্যে যে ব্যাংক কাজ করে তাকে সঞ্চয়ী বা আমানত ব্যাংক বলে। এ ধরনের ব্যাংক জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে। এবং বিভিন্ন আকর্ষণীয় আমানত প্রকল্প গ্রহণ করে তাতে অর্থ জমা করতে উৎসাহ দেয়। আমাদের দেশে  ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক এরূপ উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি ব্যাংক।

৪. বিনিয়োগ ব্যাংক (Investment bank): দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সরবরাহের লক্ষ্যে যে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে বিনিয়োগ ব্যাংক বলে। এরূপ ব্যাংক ঋণদান ছাড়াও নতুন কোম্পানি বা শিল্প প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার উদ্দেশ্যে অবলেখক ও দায়গ্রাহকের ভূমিকা পালন করে। এ জন্য শেয়ার বিক্রয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পাশাপাশি প্রয়োজনে নিজেও প্রচুর শেয়ার ক্রয় করতে পারে। ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (ICB) এদেশে এরূপ প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।

৫. মিশ্র ব্যাংক (Mixed bank): যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একই সাথে জনগণের আমানত গ্রহণ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর ও বিভিন্ন লাভজনক খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হয় তাকে মিশ্র ব্যাংকিং বলে। মিশ্র ব্যাংকিং মূলত আমানত ব্যাংকিং এবং বিনিয়োগ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সম্মিলিত রূপ। বাংলাদেশে বর্তমানে জনগণের বিভিন্নমুখী ব্যাংকিং চাহিদা পূরণের জন্য কার্যত মিশ্র ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে।
বিশেষায়িত ব্যাংকের প্রকারভেদ
৬. বিনিময় ব্যাংক (Exchange bank): বৈদেশিক ব্যবসায়ে অর্থসংস্থান এবং বৈদেশিক বিনিময় ও লেনদেন নিষ্পত্তিতে সহায়তা করার জন্য যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে বিনিময় ব্যাংক বলে। এরূপ ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসায়ে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়, প্রত্যয়পত্র ইস্যু করে ও বিনিময় হার নির্ধারণপূর্বক বৈদেশিক দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে পৃথক কোনো বিনিময় ব্যাংক নেই। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বিনিময় শাখা এ দায়িত্ব পালন করে।

৭. সমবায় ব্যাংক (Co-operative bank): সমবায়ের ভিত্তিতে সমবায় আইনের আওতায় গঠিত ও পরিচালিত যে ব্যাংক সমিতির সদস্যদের অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য তাদেরকে স্বল্পসুদে ঋণ দেয় এবং সদস্যদের বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় আমানতস্বরূপ গ্রহণ করে মূলধন গঠন করে। তাকে সমবায় ব্যাংক বলে। এ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো সদস্যদের আর্থিক কল্যাণ; মুনাফা অর্জন নয়। এরূপ ব্যাংক সাধারণত অতালিকাভুক্ত হয়। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিঃ এ দেশে এরূপ ব্যাংকের উদাহরণ।

৮. মার্চেন্ট ব্যাংক (Merchant bank): বিনিময় ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ ব্যাংকিং এর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা ব্যাংককেই মার্চেন্ট ব্যাংক বলে। বৈদেশিক বাণিজ্যে এরা গ্রাহকদের পক্ষে প্রত্যয়পত্র ইস্যু, রপ্তানিকারক কর্তৃক উত্থাপিত বিলে স্বীকৃতি দান ও বিলের অর্থ পরিশোধ করে। এরূপ ব্যাংক বিদেশ হতে পণ্য বা যন্ত্রপাতি ক্রয় করে ভাড়া ক্রয় বা কিস্তিবন্দিতে ক্রয় পদ্ধতিতে তা গ্রাহকদের সরবরাহ করে। এরূপ ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয়, যৌথ উদ্যোগে অর্থ বিনিয়োগ করে এবং অবলেখকের দায়িত্ব পালন করে থাকে।

৯. আমদানি-রপ্তানি ব্যাংক (Import-export bank): বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান ও সহায়তার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত ব্যাংককে আমদানি-রপ্তানি ব্যাংক বলে। এই ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানিধর্মী প্রতিষ্ঠানে ঋণদান, বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রত্যয়পত্র ইস্যু, বৈদেশিক বিনিময় বিলে স্বীকৃতি প্রদান এবং লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে। আমাদের দেশে কার্যত এ ধরনের ব্যাংক নেই তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ অনেকাংশে এ দায়িত পালন করে।

১০. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যাংক (Small and cottage industries bank): দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে আর্থিক সাহায্য ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য গঠিত বিশেষায়িত ব্যাংককে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যংক বলে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য প্রোফাইল তৈরি, মূল্যায়ন এবং দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদে ঋণ মঞ্জুর করা এ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যাংক (BASIC) এরূপ ব্যাংকের উদাহরণ।

১১. কর্মসংস্থান ব্যাংক (Employment bank): বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ঋণ সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত ব্যাংককে কর্মসংস্থান ব্যাংক বলে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও বেকার সমস্যা দূর করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এরূপ ব্যাংকের উদ্দেশ্য। কর্মসংস্থান ব্যাংক' বাংলাদেশে এ ধরনের একটা বিশেষায়িত ব্যাংক।

১২. গৃহসংস্থান ব্যাংক (Housing bank): শহর এলাকায় যে প্রকট আবাসন সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তা দূর করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে গৃহসংস্থান ব্যাংক বলে। বাড়ি নির্মাণ, সংস্কার, ফ্ল্যাট ক্রয় ইত্যাদি খাতে এ ধরনের ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে এবং মাসিক কিস্তিতে উক্ত অর্থ আদায় করে থাকে। বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (HBFC) আমাদের দেশে এ ধরনের একটা প্রতিষ্ঠান।

১৩. ভোক্তা ব্যাংক (Consumer bank): ভোক্তা সাধারণকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ে সাহায্য করার জন্য গঠিত বিশেষায়িত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে ভোক্তা ব্যাংক বলে। এরূপ ব্যাংক ক্রেতাসাধারণের সুবিধার্থে ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে। যার মাধ্যমে সহজে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করা যায়। এ ছাড়া এরূপ ব্যাংক বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য; যেমন - ফ্রিজ, টিভি, গাড়ি ইত্যাদি সামগ্রী কিস্তির ভিত্তিতে সরবরাহ করে । আমাদের দেশে বিশেষায়িত এরূপ ব্যাংক নেই।

১৪. পরিবহন ব্যাংক (Transportation bank): দেশের পরিবহন খাতকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকই হলো পরিবহন ব্যাংক। যানবাহন নির্মাণ, আমদানি, ক্রয়, মেরামত, খুচরা যন্ত্রপাতি ক্রয় ইত্যাদি খাতে ঋণ দেয়ার জন্য এ ধরনের ব্যাংক গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের বিশেষায়িত ব্যাংক নেই।

১৫. বন্ধকী ব্যাংক (Mortgage bank): ভূমি অথবা স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে যে ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে ঋণ প্রদান করে তাকে বন্ধকী ব্যাংক বলে। যে ব্যাংক শুধুমাত্র ভূমি বন্ধক রেখে ঋণ দেয় তাকে ভূমি বন্ধকী ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। এরূপ ব্যাংক সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। তবে অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে স্বল্পমেয়াদি ঋণও দিতে পারে।

১৬. গ্রামীণ ব্যাংক (Grameen bank): গ্রামের জনগণকে ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে এক মহতী উদ্যোগই হলো গ্রামীণ ব্যাংক। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিক ড. মো. ইউনূস এরূপ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এরূপ ব্যাংক গ্রাম পর্যায়ে সদস্যদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি এবং তাদের নিকট থেকে সাপ্তাহিক সঞ্চয় সংগ্রহ করে। জমা একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছলে কোনো বৈষয়িক জামানত ছাড়াই সদস্যদের ঋণ দেয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url