ই-ব্যাংকিং কাকে বলে | What is E-Banking Banking

মি. রহমান সাহেব ও মি. রহিম দু'জন বন্ধু। একত্রে চলেন। মি. রহমান সাহেব একটু অগ্রসর চিন্তার মানুষ। শুরু থেকে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমেই লেনদেন করেন। কিন্তু  মি. রহিম টাকা-পয়সা প্রথনে বাসাতেই রাখতেন। কারণ ব্যাংকে যেয়ে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে তার খুবই বিরক্ত বোধ হতো।

কিন্তু একাধিকবার টাকা খোয়া যাওয়ায় বন্ধুর লেখালেখি তিনি এখন ব্যাংকেই সকল লেনদেন করেন। একদিন একসাথে চলতে দু'জন একটা বন্ধ দোকানে ঢুকলেন। মাল কিনে কাউন্টারে এসে মি. রহমান সাহেব একটা কার্ড বের করে দিলেন। কাউন্টারের কর্মী কী একটা কাগজ বের করে বন্ধুর স্বাক্ষর নিলো। মি. রহিম বিস্মিত! বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে মি. রহমান সাহেব বললেন, দাঁড়াও, কার্ড দিয়ে ক'টা টাকা তুলে নিই। একটা বুথে ঢুকে দু'মিনিটের মধ্যে টাকা নিয়ে বেরিয়ে আসলেন।

মি. রহিম এবার বললেন, তোমারতো যাদুর কার্ড দেখছি। তিনি এখন নিজে এটিএম কার্ড নিয়েছেন। এখন তিনি অনলাইন ব্যাংকিং করেন। দূরে কোথাও গেলে কার্ড বা চেক নিয়ে যান। মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে ব্যাংকের ব্যালেন্স জানেন। নিজের বাসার কম্পিউটারে ব্যাংকের মাধ্যমে সফটওয়্যার সেট করে নিয়েছেন। এখন হোম ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে সকল বিল প্রদান করেন ষ। সহসাই তিনি মোবাইল ব্যাংকিং এর জগতে প্রবেশ করবেন। এর সবই সম্ভব হচ্ছে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং এর কারণে।

ই-ব্যাংকিং পদ্ধতি হলো ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদানের আধুনিক কৌশল বা পদ্ধতি। এটি এমন এক ধরনের ব্যাংকিং সেবা পদ্ধতি যেখানে উন্নততর ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতিদ্রুত, নির্ভুল এবং ব্যাপক বিস্তৃত সেবা প্রদান সম্ভব। এ ধরনের ব্যাংকিং পদ্ধতি সনাতন , কায়িক শ্রমনির্ভর, সীমিত সেবাসম্বলিত, মন্থর, কাগজ ও নথির জমাকৃত স্তুপের গতানুগতিক ব্যাংকিং পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত ব্যাংক বিষয়ক লেখক ড. এ আর খান এ সম্পর্কে বলেন,

ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং হলো উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতম তড়িৎবাহী বা উপগ্রহ নির্ভর কম্পিউটারায়িত প্রক্রিয়াসমূহ যার মাধ্যমে ব্যাংক দ্রুততা ও নির্ভুলতা নিশ্চিতপূর্বক গ্রাহকদেরকে কাম্য সেবা প্রদানসহ পারস্পরিক যোগাযোগ সংস্থাপনে সক্ষম হয়।

ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং বিশারদ এইচ. লিপিস এর মতে- 
ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং হলো এমন যেখানে ইলেক্ট্রনিক পন্থায় অর্থ স্থানান্তর করা হয় এবং এরূপ স্থানান্তর সংক্রান্ত তথ্যাবলি একই পদ্ধতিতে লিখে রাখা হয়।

তিনি আরও বলেছেন,
ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং সেবা হলো সার্বিক ব্যাংকিং ডেলিভারি সেবা ব্যবস্থার উন্নততর পদ্ধতি।
Importance of electronic banking

ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকের সেবা সুবিধাসমূহ


১. স্বয়ংক্রীয় গণনা যন্ত্র (ATM );
২. ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড
৩. অন-লাইন ব্যাংকিং
৪. হোম ব্যাংকিং
৫. বিক্রয় বিন্দু সেবা (POS)
৬. স্বয়ংক্রীয় নিকাশঘর সেবা (SCH)
৭. আন্তঃব্যাংক নিকাশঘর পরিশোধ পদ্ধতি (CHIPS) ইত্যাদি।

উপসংহারে বলা যায়, ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক তড়িত্বাহী পদ্ধতি যেখানে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার করে অতিদ্রুত নির্ভুলভাবে সম্প্রসারিত ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে অর্থ উত্তোলন, সংগ্রহ, স্থানান্তর, লেনদেন সম্পন্নকরণ, তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ প্রদান, যোগাযোগ ইত্যাদি কাজ ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে সম্পাদিত হয়।

ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং এর গুরুত্ব|Importance of Electronic Banking


ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদানে ও ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নয়নে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং একটি অতি আধুনিক অভিনব সংযোজন। কায়িক শ্রমনির্ভর গতানুগতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখন ইতিহাস। অথচ মাত্র তিন দশক আগেও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যে এমন পরিবর্তন সূচিত হবে তা ভাবা যায়নি। এ ব্যবস্থার ফলে কার্যত ব্যাংক ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কিত সকল পক্ষই উপকৃত হয়েছে। বিশেষভাবে ব্যাংকার এবং গ্রাহক এর দ্বারা সরাসরি উপকৃত হয়ে থাকে। নিম্নে উভয়পক্ষের নিকট এর গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

ক) ব্যাংকারদের প্রতি গুরুত্ব (Importance towards bankers)

১. উন্নত সেবা প্রদান (Providing better service): ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে গ্রাহকদের উন্নতমানের সেবা প্রদান সম্ভব হয়। যা ব্যাংকের সুনাম বৃদ্ধি করে। আর এরূপ সুনাম নিঃসন্দেহে ব্যাংকার বা মালিকদের স্বার্থকেই সংহত করে।

২. প্রশাসনিক ব্যয় হ্রাস (Reducing administrative cost): কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দ্রুত ও সহজে কাজ করা সম্ভব হয়। ফলে অনেক কম জনশক্তি নিয়োগ করে বেশি কাজ করা যায়। এর ফলশ্রুতিতে প্রশাসনিক ব্যয় যথেষ্ট হ্রাস পায়।

৩. বিবিধ আয় বৃদ্ধি (Increasing miscelleneous income): এক সময় ব্যাংকের একমাত্র আয়ের খাত ছিল ঋণের সুদ বাবদ প্রাপ্ত আয়। কিন্তু বর্তমানে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং এর সুবাদে ডেবিট কার্ড ফি, ক্রেডিট কার্ড ফি অন লাইন ব্যাংকিং ফি, অর্থ স্থানান্তর কমিশন ইত্যাদি বিবিধ আয় সুদ বা লাভ আয়ের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ।

৪. মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি (Increasing amount of profia): ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে সেবার মান ও দক্ষতা একদিকে যেমনি বেড়েছে অন্যদিকে কমেছে প্রশাসনিক ব্যয়। ব্যাংক কর্মীদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরও সারা বিশ্বেই ব্যাংক ব্যবসায়ে মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

৫. প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বৃদ্ধি (Increasing the ability of competition): এ ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকারদের প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন সেবা ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে ব্যাংগুলোর গ্রাহক আকর্ষণের ক্ষমতা যেমনি বেড়েছে তেমনি অন্যদের তুলনায় নিজস্ব দক্ষতার উন্নয়ন ও বিকাশের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।

৬. কাগজ নির্ভরতা হ্রাস (Reducing paper-based documentation): পূর্ববর্তী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল কাগজনির্ভর। অর্থাৎ প্রতিটা বিষয় বিভিন্ন লেজারে ও ফাইলে সংরক্ষণ করা হতো। এতে কাগজের স্তূপ জমে থাকতো। ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সকল তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষণ করায় তা হ্রাস পেয়েছে।

৭. অভ্যন্তরীণ পরিবেশ উন্নয়ন (Developing internal environment): কাগজ নির্ভরতা হ্রাসের ফলে ব্যাংকের ভিতরে কাগজের স্তুপ না থাকায় এবং টেবিলে টেবিলে কম্পিউটার ব্যবহার হওয়ায় অভ্যন্তরীণ পরিবেশ উন্নত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষিত ও দক্ষ লোকেরা এখন কাজ করায় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিবেশে আমূল পরিবর্তন এসেছে।

খ) গ্রাহকদের প্রতি গুরুত্ব (Importance towards customers):

১. সময়ের সাশ্রয় (Saving time): ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বড় সুবিধা হলো এটা গ্রাহকদের মূল্যবান সময় বাঁচিয়েছে। আগে যেমন একটা চেক জমা দিয়ে কমপক্ষে আধঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো এখন তা মাত্র দু এক মিনিটের বিষয়। কম্পিউটার ডাটা ব্যাংক, ATM মেশিন, হোম ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং ইত্যাদি ব্যবস্থা ব্যাংকের সকল কাজে ব্যাপক সময় সাশ্রয়ে সক্ষম হয়েছে।

২. দ্রুত অর্থ স্থানান্তর (Quick money transfer): অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থায় হিসাব যেখানেই খোলা হোক না কেন এরূপ নেটওয়ার্কের অধীন ব্যাংক বা এর যে কোনো শাখা থেকে সহজে অর্থ উত্তোলন করা যায়। এরূপ ব্যাংকিং এর সুবাদে দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থপ্রেরণ সম্ভব। স্যাটেলাইট সুবিধা যুক্ত হওয়ায় দেশ বিদেশের যেকোন স্থান থেকে এর সুবাদে দ্রুত অর্থ প্রেরণ বা সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে।

৩. দ্রুত তথ্য প্রাপ্তি (Quick receiption of information): ব্যাংক থেকে নানান কারণেই সর্বশেষ তথ্য জানার প্রয়োজন পড়ে। এরূপ তথ্য প্রাপ্তি ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং এর সুবাদে অত্যন্ত সহজ হয়েছে। ব্যালেন্স জানা, বিবরণী প্রাপ্তি, লেনদেন সম্পর্কে জানা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে অন্যান্য ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ, হোম ব্যাংকিং সুবিধা ইত্যাদি এ কাজকে অত্যন্ত সহজ করেছে।

৪. নির্ভুল লেনদেন (Mistakeless transaction): মানবীয় সীমাবদ্ধতায় ভুল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। ইলেকট্রনিক ব্যাংক ব্যবস্থার সুবাদে এর সম্ভাবনা খুবই কমে গেছে। স্বয়ংক্রিয় গণনা যন্ত্র, কম্পিউটারে নির্ভুলতা যাচাই, হিসাব তৈরি, লেনদেন ইত্যাদি কারণে হিসাবে ভুল হওয়ায় সম্ভাবনা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের আগ্রহ মানুষের মধ্যে বেড়েছে।

৫. বিভিন্নমুখী সেবা প্রাপ্তি (Receiving various types of services): ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার কারণে গ্রাহকদের সেবা প্রাপ্তির সুযোগ অনেক বেড়েছে। আগে আমানত সংগ্রহ ও ঋণদানের মধ্যে ব্যাংকিং সেবা সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন ATM, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, হোম ব্যাংকিং ইত্যাদি বিভিন্নমুখী সেবা প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

৬. হিসাবের নিরাপত্তা (Safety of account): ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং এর সুবাদে গ্রাহকগণের হিসাবের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তাও অনেক বেড়েছে। একটা চেক জমার পর অর্থ প্রদান পর্যন্ত আগে বিভিন্ন টেবিলে নানান মানের কর্মীরা তা সম্পন্ন করতো যা এখন কার্যত একজন দক্ষ কর্মী কর্তৃক সম্পন্ন হচ্ছে। ইস্যুকৃত চেকের পাতার নম্বর থেকে শুরু করে সবই কম্পিউটারে দেখা যাচ্ছে। এতে হিসাবের নিরাপত্তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url