বীমা চুক্তি কাকে বলে | What is Insurance Contract

মানুষের জীবন ও সহায়-সম্পদ সকল সময়ই ঝুঁকি দ্বারা পরিবেষ্টিত। মানুষকে এ সকল ঝুঁকি বা বিপদের বিপক্ষে আর্থিক নিষ্কৃতি বা নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয় তাকেই বিমা চুক্তি বলে। এরূপ চুক্তিতে একপক্ষ তার জীবন বা সম্পত্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রিমিয়াম প্রদানপূর্বক অন্যের ওপর অর্পণ করে এবং অপরপক্ষ এর বিনিময়ে অন্যের ঝুঁকি গ্রহণ করে। ফলে বীমাকৃত কারণে ক্ষতির উদ্ভব হলে ঝুঁকি গ্রহণকারী পক্ষ অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকে। এক্ষেত্রে ঝুঁকি গ্রহণকারী পক্ষকে বীমাকারী (Insurer) এবং প্রিমিয়াম প্রদানকারী পক্ষকে বীমাগ্রহীতা (Insured or Policy holder) বলা হয়ে থাকে। বীমা চুক্তি সম্পর্কে কতিপয় সংজ্ঞা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

১. Ghosh ও Agarwala -এর মতে,
বীমা হলো এমন একটি চুক্তি যেখানে প্রিমিয়াম নামক প্রতিদানের বিনিময়ে একপক্ষ অপরপক্ষকে সম্ভাব্য ক্ষতি সংঘটনের কারণে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেয় অথবা নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা সংঘটিত হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।

২. M. N. Mishra এরূপ চুক্তি প্রসঙ্গে বলেন,
বীমা হলো এমন কিছু (চুক্তি) যার মাধ্যমে উভয়ের স্বীকৃত আকস্মিক বিপদের জন্য বিমাকারী বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয় এবং এরূপ ঝুঁকি গ্রহণের প্রতিদানে সে অপর পক্ষের নিকট হতে বীমা সেলামি প্রাপ্ত হয়।

উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণ করলে বীমা চুক্তির নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়:

১. বীমা চুক্তিতে দু'টি পক্ষ থাকে বিমাকারী ও বীমাগ্রহীতা
২. এর এক পক্ষ তার ঝুঁকি অন্যের ওপর অর্পণ করে এবং অপর পক্ষ সেই ঝুঁকি বহনের প্রতিশ্রুতি দেয়
৩. এরূপ ঝুঁকি গ্রহণের বিনিময় মূল্য হলো প্রিমিয়াম বা সেলামি এবং
৪. এক্ষেত্রে বীমাগ্রহীতার জীবন বা সম্পত্তির ক্ষতি হলে বিমাকারী প্রতিশ্রুত অর্থ বা ক্ষতিপূরণে বাধ্য থাকে।
বীমা চুক্তি কাকে বলে

বীমা চুক্তির বৈশিষ্ট্য|Features of Insurance Contract


মানুষের জীবন বা সম্পত্তির ঝুঁকি আর্থিকভাবে মোকাবিলার কৌশলই হলো বিমা বা বিমা চুক্তি। প্রিমিয়ামের বিনিময়ে নিজ জীবন বা সম্পত্তির ঝুঁকি অন্যের কাঁধে চাপিয়ে স্বস্তিপূর্ণ জীবনযাপন বা কর্মপরিচালনার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের বিমা আজকের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। বীমা বা বীমা চুক্তির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ:

১. লিখিত চুক্তি (Written contract): কোনো সাধারণ চুক্তি মৌখিক, লিখিত বা লিখিত ও নিবন্ধিত হতে পারে বলে বিধানে উল্লেখ থাকলেও বিমা চুক্তি অবশ্যই লিখিত হতে হয় । বিমাগ্রহীতা ও বিমাকারী উভয়ের স্বাক্ষরে এরূপ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে থাকে। বীমাপত্রে চুক্তির বিষয়বস্তু ও শর্তাদি লেখা থাকে। যা উভয়পক্ষ পালনে বাধ্য থাকে।

২. বৈধ চুক্তি (Valid contract): বিমা কোনো বাজিখেলা নয়; আইন অনুযায়ী এটা বৈধ চুক্তি। এর একপক্ষে থাকে বিমাকারী প্রতিষ্ঠান (Insurer) ও অন্যদিকে থাকে বিমাগ্রহীতা (Policy holder)। একপক্ষের প্রস্তাব ও অপরপক্ষের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে এরূপ চুক্তি সম্পাদিত হয়। বৈধ চুক্তির সকল উপাদান বা গুণ এতে থাকা আবশ্যক।

৩. আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা (Financial safety device): বিমা হলো সম্ভাব্য ক্ষতির বিপক্ষে আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে বা সম্পদ নষ্ট হলে বিমা কোম্পানি তা ফেরত দিতে পারে না বটে তবে এরূপ মৃত্যু বা সম্পদহানির কারণে যে আর্থিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় বিমা তার বিপক্ষে আর্থিক নিরাপত্তা বিধান করে।

৪. প্রিমিয়াম (Premium): বীমার ক্ষেত্রে বিমাকারী কর্তৃক ঝুঁকি গ্রহণের প্রতিদান হলো বিমাগ্রহীতা প্রদত্ত প্রিমিয়াম। জীবন বিমার বেলায় এরূপ প্রিমিয়াম সাধারণত কিস্তিতে পরিশোধ্য। তবে নৌ, অগ্নি বা অন্যান্য বিমার বেলায় সাধারণত এক কিস্তিতেই এরূপ প্রিমিয়াম পরিশোধ করা হয়।

৫. বিমাযোগ্য স্বার্থ (Insurable interest): এরূপ চুক্তিতে বিমাকৃত বিষয়বস্তুর ওপর বিমগ্রহীতার আর্থিক স্বার্থ থাকা আবশ্যক। অন্যথায় সে এর ওপর বীমা করতে পারে না। ক-এর বাড়ি খ বিমা করতে পারে না। কিন্তু বাড়িটি যদি খ- এর নিকট বন্ধক রাখা হয় তবে সে ঐ বাড়িতে বীমা করতে পারে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে এরূপ স্বার্থ থাকায় একে অন্যের জীবনে বিমা করার অধিকারী।

৬. বিশ্বাসের সম্পর্ক (Fiduciary relationship): এতে বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার মধ্যে সম্বিশ্বাসের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বীমা সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সঠিকভাবে প্রদানে উভয়পক্ষ বাধ্য থাকে। বিমাগ্রহীতা কোনো তথ্য প্রদানে মিথ্যাবর্ণনা অথবা প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ কর বিমাকারী প্রতিষ্ঠান তার দায় অস্বীকার করতে পারে।

৭. নির্দিষ্টতার প্রতি গুরুত্বারোপ (Importance on certainity): বিমা চুক্তিতে নির্দিষ্টতার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। এ জন্য বীমাপত্রে ক্ষতি সংঘটনের কারণ, বিমাকৃত টাকার পরিমাণ, বীমাপত্রের মেয়াদ, প্রিমিয়ামের পরিমাণ এবং তা পরিশোধের উপায়, দাবি পরিশোধ পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় সুস্পষ্টভাবে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

৮. ঝুঁকি বণ্টনের উদ্দেশ্য (Purpose of distributing risk): যত বেশি বীমা চুক্তি করা যায় বা বিমাপত্র খোলা সম্ভব হয় ঝুঁকি বন্টনেরও ততই সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে লাভের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। এজন্যই অধ্যাপক মর্গ্যান, এম.এন. মিশ্র প্রমুখ লেখকগণ বিমাকে ঝুঁকি বণ্টনের যৌথ ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঝুঁকির সম্মুখীন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ঝুঁকি বণ্টনের উদ্দেশ্য নিয়েই মূলত এরূপ চুক্তির উদ্ভব ঘটেছিল।

৯. মানব কল্যাণ সংশ্লিষ্টতা (Relatedness with human welfare): সকল চুক্তিতেই পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়টি জড়িত থাকলেও বীমা চুক্তিতে মানব কল্যাণের বিষয়টির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। মানব জীবন ও সম্পত্তির সম্ভাব্য বিপদ ও ঝুঁকির বিপক্ষে বিমা চুক্তি আর্থিক প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে বিধায় এরূপ চুক্তিকে সবাই প্রত্যক্ষভাবে মানব কল্যাণ সংশ্লিষ্ট বিবেচনা করে থাকে।

বীমা চুক্তির প্রকৃতি|Nature of Insurance Contract 


মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ঝুঁকি আর্থিকভাবে মোকাবেলার কৌশলই হলো বিমা। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও তার সহায় সম্পদ সব সময়ই ঝুঁকি দ্বারা পরিবেষ্টিত। বিমা হলো এই ঝুঁকি মোকাবেলার সম্মিলিত আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সারা বিশ্বে জীবন ও সম্পত্তির ঝুঁকি নিরসনে বিমা অত্যন্ত ফলপ্রসু ও কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। নিম্নে এর প্রকৃতি তুলে ধরা হলো:

১. ঝুঁকি বণ্টনের যৌথ ব্যবস্থা (Co-operative device of risk distribution): বীমা হলো একই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উক্ত ঝুঁকি বণ্টনের একটা সমবায় বা যৌথ ব্যবস্থা। ১০,০০০ গাড়ি মালিক প্রত্যেকেই তাদের গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন। এখন বীমা কোম্পানি প্রত্যেকের নিকট থেকে প্রিমিয়াম গ্রহণপূর্বক যদি কারও গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয় তবে উক্ত দাবি পরিশোধের নিশ্চয়ত দিচ্ছে। সবার নিকট থেকে প্রাপ্ত প্রিমিয়াম তাঁর আয় এবং বিমাদাবি তার মুখ্য ব্যয় হিসেবে গণ্য।

২. আর্থিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Financial protection device): বীমা হলো সম্ভাব্য ক্ষতির বিপক্ষে আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে বা সম্পদ নষ্ট হলে বিমা কোম্পানি তা ফেরত দিতে পারে না বটে তবে এরূপ মৃত্যু বা সম্পদহানির কারণে যে আর্থিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় বিমা তার বিপক্ষে আর্থিক নিরাপত্তা বিধান করে। জীবন বিমার ক্ষেত্রে বিমা নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা দেয় এবং সম্পত্তি বীমার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে থাকে।

৩. ঝুঁকির বিপক্ষে প্রিমিয়াম (Premium against risk): মানুষের জীবন ও সম্পত্তিতে ঝুঁকিগত বাধা দূর করা বীমার কাজ। এই ঝুঁকি গ্রহণের বিপক্ষে বিমা কোম্পানি প্রিমিয়াম লাভ করে। অর্থাৎ প্রিমিয়াম হলো ঝুঁকি গ্রহণের বিনিময় মূল্য বা প্রতিদান। তাই ঝুঁকির মাত্রার উপর প্রিমিয়ামের পরিমাণ নির্ভর করে। ঝুঁকি বেশি হলে প্রিমিয়াম বেশি এবং ঝুঁকি কম হলে প্রিমিয়াম কম হয়। ঝুঁকির পরিমাণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন বিমা ব্যবসায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য নানান বিষয়ের বৈজ্ঞানিক চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।

৪. নিশ্চয়তা বা ক্ষতিপুরণ (Assurance or compensation): বীমা নিশ্চয়তা বা ক্ষতিপূরণের চুক্তি। জীবনের ক্ষেত্রে হানি হলে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না বিধায় বিমা কোম্পানি সেক্ষেত্রে পূর্ব থেকেই চুক্তিতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে। তাই জীবন বিমাকে নিশ্চয়তার চুক্তি বলে। অন্যদিকে সম্পত্তির ক্ষতির ক্ষেত্রে বিমা আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। অর্থাৎ ক্ষতি সম্পূর্ণ বা আংশিক যা-ই হোক না কেন তা পূরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। তাই সম্পত্তি বীমাকে ক্ষতিপূরণের চুক্তি বলা হয়ে থাকে।

৫. চুক্তি সংশ্লিষ্ট ঘটনা বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ (Compensation of contractual event or accident): বীমা চুক্তি সংশ্লিষ্ট ঘটনা বা দুর্ঘটনার কারণে জীবন ও সম্পত্তির হানি হলে অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে। কোন জীবন বা সম্পত্তি নানান কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সকল কারণে উদ্ভূত ক্ষতিতে বীমাব্যবস্থা ক্ষতিপূরণ বা অর্থ প্রদানের কথা বলে না। কেউ আত্মহত্যা করলে বা স্বেচ্ছায় গুদামে আগুন লাগালে বিমা সেক্ষেত্রে অর্থ দিবে তা প্রত্যাশা করা যায় না। বীমা চুক্তিতে যেই কারণে উদ্ভূত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ করা হবে বলা থাকে। সেই সকল প্রত্যক্ষ কারণে উদ্ভূত ক্ষতির জন্যই শুধুমাত্র বীমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ করে।

৬. বীমা জুয়াখেলা নয় (Insurance is not gambling): জুয়াখেলা নিঃসন্দেহে অনৈতিক ও অকল্যাণকর কাজ । এরূপ চুক্তির বিষয়বস্তুতে কারও কোন আর্থিক স্বার্থ থাকে না। খেলায় এক পক্ষ জিতলে বা হারলে আরেক পক্ষ তাকে অর্থ দিবে বা পাবে এ ধরনের জুয়ার প্রতিশ্রুতিতে কারও কোন বৈধ স্বার্থ নেই। কিন্তু বিমা হলো একটা বৈধ ও কল্যাণকর ব্যবসায়। এক্ষেত্রে বিমাকৃত বিষয়বস্তুতে বিমাগ্রহীতার বৈধ আর্থিক স্বার্থ থাকে, যা সুরক্ষা করা বিমার কাজ। এরূপ প্রতিরক্ষা বিধানে সবার নিকট থেকে যে প্রিমিয়াম পায় তা থেকেই বিমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ বা অর্থ পরিশোধ করে। অতিরিক্ত অর্থই তার মুনাফা। তাই বীমাকে কখনই জুয়াখেলার সাথে তুলনা করা যায় না।

বীমা চুক্তির অপরিহার্য উপাদান|Essential Elements of Insurance Contract


মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ঝুঁকির বিপক্ষে আর্থিক প্রতিরক্ষা সম্বলিত চুক্তিই হলো বিমা চুক্তি। এটি বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত যেমনি একটা চুক্তি অন্যদিকে সকল দেশেই তা গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যবসায়। যে কারণে চুক্তি সংশ্লিষ্ট আইনগত ও ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট উভয় ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় উপাদান এরূপ চুক্তিতে লক্ষণীয়:

(ক) সাধারণ চুক্তির আইনানুগ উপাদান ও
(খ) বীমচুক্তি সংক্রান্ত বিশেষ উপাদান

(ক) সাধারণ চুক্তির আইনানুগ উপাদানসমূহ (Legal elements of general contract): সাধারণ চুক্তির আইনানুগ উপাদান তে বীমচুক্তির সেসব উপাদানকে বোঝায় যে উপাদানসমূহ সকল বৈধ চুক্তিতে থাকে। আমাদের দেশে প্রচলিত ভারতীয় চুক্তি ইন- ১৮৭২ এর ১০ ধারা মতে, বৈধ চুক্তির নিম্নোর পাঁচটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক

১. সম্মতি বা প্রস্তাব ও স্বীকৃতি (Agreement or offer & acceptance): যেকোনো বৈধ চুক্তিতে প্রভাব ও স্বীকৃতির বিষয় থাকে। একপক্ষ প্রস্তাব উপস্থাপন করে এবং অন্যপক্ষ উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাব ও স্বীকৃতির সমষ্টিই হলো সম্মতি। বিনচুক্তির ক্ষেত্রে বিগ্রহীতার নিকট হতেই চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব আসে এবং বিনাকারী তা গ্রহণ করে। তবে প্রস্তাব বিনাকারীর নিকট হতেও আসতে পারে এবং বিমগ্রহীতা উক্ত প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করতে পারে।

২. আইনসম্মত প্রতিদান (Legal consideration): যেকোনো চুক্তি আইনানুগভাবে কলব্যযোগ্য হতে হলে পক্ষসমূহের মধ্যে সকল প্রদান আইনানুগভাবে বৈধ হতে হবে। কোনো সম্মতিতে বেআইনি প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি থাকলে তা কখনো আইনানুগ চুক্তি হতে পারে না। বিমচুক্তির ক্ষেত্রে বিগ্রহীতা তার বিষয়বস্তুর ক্ষতির ঝুঁকি প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বিমাকারীর নিকট হস্তান্তর করে। পক্ষান্তরে বিনাকারী বিমাগ্রহীতাকে তার বিমাকৃত বিষয়বস্তুর ক্ষতি হলে আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। এখানে প্রিমিয়াম এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি উভয়ই বৈধ প্রতিদান।

৩. চুক্তি সম্পাদন যোগ্যতা (Competent to make a contract): যেকোনো চুক্তিকে আইনানুগভাবে গ্রহণযোগ্য ও বলবৎযোগ্য হতে হলে চুক্তির সাথে সম্পৃক্ত সকল পক্ষের চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতা থাকতে হবে। নাবালক, বিকৃত মস্তিষ্ক, দেউলিয়া ঘোধিত ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদনের যোগ্য নয়। এ ধরনের ব্যক্তির সাথে চুক্তি করা হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। বিমচুক্তিতে বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতারও তাই চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতা থাকবে হবে।

৪. স্বেচ্ছা সম্মতি (Free consent): চুক্তিতে আবস্থ সকল পক্ষের স্বেচ্ছা সম্মতি থাকতে হবে। জোরপূর্বক, মিথ্যা প্রলোভন, প্রতারণা, মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন বা ভুলক্রমে সম্মতি দেওয়া হলে তা বৈধ চুক্তিতে রূপ নেবে না। বিমাচুক্তিতেও বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার স্বেচ্ছা সম্মতি থাকতে হবে।

৫. বৈধ উদ্দেশ্য (Legal objective): চুক্তিকে আইনানুগভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হলে চুক্তির উদ্দেশ্য বৈধ হতে হবে। বেআইনি, অনৈতিক, জনবিরোধী উদ্দেশ্যে চুক্তি করা যায় না। বিমচুক্তির উদ্দেশ্যও বৈধ হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় বিমাচুক্তি আইনানুগভাবে বলবৎযোগ্য হবে না।

The consideration clause of an insurance contract includes


খ. বিমচুক্তি সংক্রান্ত বিশেষ উপাদান (Special elements related to insurance): চুক্তি আইনের উপযুক্ত সাধারণ উপাদান ও বীমাভুক্তির ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিশেষ উপাদানসমূহ থাকা আবশ্যক:

১. ক্ষতিপূরণের নীতি (Principle of Indemnity): ক্ষতিপূরণের নীতি অনুযায়ী বীমাকারী বীমিগ্রহীতা সংঘটিত ক্ষতি অপেক্ষা বেশি ক্ষতিপূরণ দিতে পারে না। সংঘটিত ক্ষতি অথবা বীমাকৃত অর্থের চাইতে বেশি অর্থ ক্ষতিপূরণ প্রদান করলে তা বেআইনি বলে বিবেচিত হবে।

২. বীমাযোগ্য স্বার্থ (Insurable interest): বীমাচুক্তি গ্রহণযোগ্য, বৈধ ও আইনত কাবতযোগ্য হওয়ার জন্য বিমাকৃত বিষয়বস্তুতে অবশ্যই বীমাগ্রহীতার বীমাযোগ্য হার্ট থাকতে হবে। বিদাযোগ্য স্বার্থ বলতে বীমাকৃত বিষয়বস্তুতে বিমাগ্রহীতার আর্থিক স্বার্থকে বোঝায়। যার অস্তিত্বে বিমাগ্রহীতা আর্থিকভাবে লাভবান হয় এবং যার ক্ষতি হলে বা বিনষ্ট হলে বিগ্রহীতা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জীবনবীমার ক্ষেত্রে জীবন ও জীবিকা, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিমার ক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্য ও স্থাবর - অস্থাবর সম্পত্তি এবং দায় বিমার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য দায় বীমার বিষয়বস্তু। বীমাগ্রহীতার এসকল বিষয়বস্তুতে আর্থিক অর্থ থাকতে হয়।

৩. চূড়ান্ত সধিশ্বাস (Utmost good faith): বীমাচুক্তিতে সকল পক্ষের মধ্যে চূড়ান্ত সম্বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকতে হবে। চূড়ান্ত সবিশ্বাসের নীতি অনুযায়ী বিমাকারী ও বীমাগ্রহীতা বিমচুক্তি সংক্রান্ত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এক পক্ষ অন্য পক্ষের নিকট প্রকাশ করবে। অর্থাৎ বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতা বিমাচুক্তির বিষয়ে সমমনা হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গোপন করা বা মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া এ নীতির পরিপন্থি। কোনো পক্ষ মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে বা তথ্য গোপন করলে বিমচুক্তি বাতিল হতে পারে বা আইনানুগভাবে দায়বন্ধ হতে পারে। এজন্য বিমচুক্তিকে বলা হয় চূড়ান্ত সবিশ্বাসের চুক্তি।

৪. স্থলাভিষিক্তকরণ (Doctrine of subrogation): স্থলাভিষিক্তকরণ বলতে বিমাকৃত বিষয়বস্তুতে বিমাগ্রহীতার অধিকার ও স্বার্থকে বীমাকারীর নিকট হস্তান্তরিত করাকে বোঝায়। বীমাকারী যদি বীমাগ্রহীতার সম্পত্তির সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। তবে বীমাকৃত বিষয়বস্তুর ভগ্নাবশেষ প্রাপ্তির অধিকার বীমাকারী পাবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণের পর বীমাকৃত বিষয়বস্তুর আইনগত অধিকার বিমাকারী পাবে।

৫. শর্তাবলি বা নির্ভরপত্র (Warranties): সকল ধরনের বিমাপত্রে বিশেষত, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিমাপত্রে বীমাকরী ও বিমাগ্রহীতা পরস্পরের প্রতি কিছু শর্তারোপ করতে পারে। শর্তাবলি লিখিত বা অলিখিত হতে পারে। কোনো পক্ষ এ সকল শর্ত পালন না করলে বা অবহেলা করলে আইনগতভাবে বিমচুক্তি বাতিল হতে পারে। যেমন- নৌবীমার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যাত্রাপথে জাহাজ চলাচলের শর্ত এবং অগ্লিবিমার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার শর্ত থাকতে পারে। বিমগ্রহীতা এ সকল শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে বিমাকারী ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করতে পারে।

৬. নিকট বা প্রত্যক্ষ কারণ (Proximate cause): বিমাচুক্তি অনুযায়ী শুধু বিমাপত্রে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ ঘটনা বা ঘটনাসমূহের দ্বারা বীমাকৃত বিষয়বস্তুর ক্ষতি হলেই ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। অন্যথার ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় না। অনেক সময় একাধিক ঘটনার ধারাবাহিকতায় বীমাকৃত বিষয়বস্তুর ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্ষতির প্রত্যক্ষ বা নিকটতম কারণকে বিবেচনা করা হয়। নিকটতম বা প্রত্যক্ষ কারণ যদি বীমাকৃত থাকে বা বীমাপত্রে উল্লেখ করা থাকে তবে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় । অন্যথায় ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় না।

৭. স্বত্বাপণ (Assignment or transfer of interest): বীমাপত্রের দাবি বা বীমাদাবির অর্থপ্রাপ্তির অধিকার বীমগ্রহীতা জন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রদান করতে পারে। বিমাদাবির অর্থপ্রাপ্তির অধিকার বিমাগ্রহীতা অন্য কোনো পক্ষকে হস্তান্তর করলে তাকে বিমার স্বত্বাপণ বলা হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃত বীমাগ্রহীতাকে স্বত্বাপণকারী বা হস্তান্তরকারী এবং যাকে বীমাপত্রের অধিকার প্রদান করা হয় তাকে স্বত্বার্পণ গ্রহীতা বলে। স্বত্বাপণের ফলে বীমাপত্রের ক্ষতিপূরণ বা বিমাদাবির অর্থ পাওয়ার অধিকার স্বত্বাপণ গ্রহীতার নিকট হস্তান্তরিত হয়। 

উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, বীমাচুক্তি যেহেতু একটি আইনসম্মত চুক্তি সেজন্য এই চুক্তিতে সাধারণ চুক্তির আইনগত উপাদানের পাশাপাশি ব্যবসায় হিসেবে বীমাচুক্তির বিশেষ উপাদান উপস্থিত থাকা অপরিহার্য তা না হলে বীমাচুক্তি আইনসম্মত হয় না।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url