ব্যাংক হার নীতি কি | Bank Rate Policy
ব্যাংক হার কি?
তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ যে সুদের হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট থেকে তাদের প্রথম শ্রেণির বিল ও সিকিউরিটিজসমূহ বাট্টা করে তাকে ব্যাংক হার বলে।
এ হারের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলকে ব্যাংক হার নীতি বলা হয়ে থাকে। পরিমাণগত ঋণ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির মধ্যে এটি একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ১৮৩৯ সালে সর্বপ্রথম ঋণ নিয়ন্ত্রণে এ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটায়। অবশ্য তখন এটা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিল ও সিকিউরিটিজ বাট্টাকরণের মাধ্যমে গৃহীত ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতো। যে কারণে M. H. Dekock একে ‘বাট্টার হার নীতি’ (Discount-rate policy) বলে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে এ হার ৫%। যখন মুদ্রাবাজারে ঋণের আধিক্য দেখা দেয় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক হার বৃদ্ধি করে। ফলে তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অধিক হার সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট থেকে ঋণ বা তহবিল সংগ্রহ করতে হয়। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও সুদের হার বাড়ায়। ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা হ্রাস পায়। ফলে বাজারে ঋণের সরবরাহ হ্রাস পায়। এতে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়, মূল্যস্তরে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধি পায়।
অন্যদিকে যখন বাজারে ঋণ সরবরাহ হ্রাস পায় এবং এজন্য অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা বিরাজ করে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক হার কমায়। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্প হার সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ সংগ্রহ করতে পারে। বাজারে সুদের হার কমে যাওয়ায় গ্রাহকগণও অধিক পরিমাণে ঋণ নিতে আগ্রহী হয়। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়, উৎপাদন বাড়ে, বেকার সমস্যা হ্রাস পায় এবং অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে।
ব্যাংক হার নীতি কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে অনুমিত শর্তাবলি
ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ব্যাংক হার নীতি তখনই কার্যকর হয় যখন ব্যাংকিং ব্যবসায়ে নিম্নোক্ত শর্তাবলি বিরাজমান থাকে:
১. যখন ব্যাংক হার পরিবর্তনের ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রদত্ত ঋণের ওপর পূর্ব নির্ধারিত সুদের হারে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়।
২. বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণ প্রদানযোগ্য তহবিল যেক্ষেত্রে কম থাকে এং ঋণদানের সামর্থ্যের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংক হতে ঋণ সংগ্রহ করতে পারার ওপর নির্ভর করে।
৩. যদি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উত্তম সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে।
৫. বাজারে বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে যদি প্রচুর পরিমাণে প্রথম শ্রেণীর বিল, সিকিউরিটিজ ইত্যাদি জমা থাকে বা এগুলোর ব্যবহার যদি ব্যাপক হয়।
ব্যাংক হার নীতির সীমাবদ্ধতা ব্যাংক হার নীতির যে সকল সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায় তা নিম্নরূপ:
১. দেশে সুসংগঠিত মুদ্রাবাজার না থাকলে এরূপ নীতি কার্যকর করা যায় না। কারণ সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত বিল, সিকিউরিটিজ ইত্যাদি থাকে না।
২. বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত রিজার্ভ তহবিল থাকলে সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ঋণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় না। ফলে এ নীতি তার কার্যকারিতা হারায়।
৩. ব্যাংক হার হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে সাথে যদি বাজারে সুদের হার হ্রাস-বৃদ্ধি না ঘটে তবে সেক্ষেত্রে এ নীতি কার্যকর হতে পারে না।
৪. যদি বাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাইরেও ঋণদানের জন্য বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে তবে সেক্ষেত্রেও এ নীতি কার্যকর ফল দেয় না।
উপরোক্ত সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাংক হার নীতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও অদ্যাবধি ঋণ নিয়ন্ত্রণের অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে সকল দেশেই এর ব্যবহার লক্ষণীয়। বিল, সিকিউরিটিজ ইত্যাদির বাট্টাকরণের প্রয়োজন কমলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সর্বত্রই বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণের কার্যকর উৎস তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তদুপরি ব্যাংক হার হ্রাস-বৃদ্ধি অধস্তন ব্যাংকসমূহের ওপর একটা নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে। তাই অর্থনীতিতে ঋণের ব্যবসায় যতদিন চালু থাকবে ব্যাংক হার নীতির উপযোগিতাও ততদিন বিদ্যমান থাকবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
নীতি সুদ হার কি
যে সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকসমূহকে ঋণ দেয়, সেটিই রেপো রেট বা নীতি সুদহার। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতেই মুদ্রানীতির এ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারটি ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে, অতিরিক্ত তারল্য তুলে নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে ঋণ দেয়, সেটি রিভার্স রেপো হিসেবে পরিচিত।