বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ
২০১৮ সালের ১৬ মার্চ জাতিসংঘ বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেশের অর্থনীতিতে ব্যবসায় তথা শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের অবদান প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। এক সময় শিল্প-বাণিজ্যে উন্নত এলাকা হিসেবে এ অঞ্চলের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ছিল। শিল্প - বাণিজ্যে প্রসিদ্য স্থান হিসেবে বিশেষ করে মসলিন কাপড়ের জন্য ‘সোনারগাঁ’এবং সমুদ্রবন্দর ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য ‘চট্টগ্রাম’ এর নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে। নিচে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের উপাদানগুলো বর্ণনা করা হলো:
১. প্রাকৃতিক পরিবেশ (Natural environment): বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের অধিকাংশ উপাদানই ব্যবসায় স্থাপনের জন্য অনুকূল। দেশের প্রায় সব অংশই সমতল ও নদীবিধৌত। ফলে, সহজেই এখানে কৃষিজাত বিভিন্ন শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল উৎপাদন ও বাজারজাত করা যায়। এখানে ব্যবসায় বা শিল্প স্থাপনের জন্য রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাস। দেশে বিদ্যমান খনিজ কয়লা, চুনাপাথর, কঠিন শিলা প্রভৃতি শিল্প বিকাশের সহায়ক। দিন দিন বনভূমির পরিমাণ কমে গেলেও আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ বনজ সম্পদ। অসংখ্য নদ- নদী ও বিশাল সমুদ্র উপকূল থাকায় মৎস্য শিল্প বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশও এখানে আছে। এখানকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যও বেশ লক্ষণীয়, যা পর্যটন শিল্প বিকাশে বেশ সহায়ক। যথেষ্ট পরিমাণ নদ -নদী, জলাশয় ও সমুদ্র থাকায় দেশে মৎস্য, লবণ ও পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
২. অর্থনৈতিক পরিবেশ (Economic environment): বিশ্ব অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ধীরে ধীরে জোরদার হচ্ছে। জিডিপিতে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। সরকার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষিত যুবকদের আইটি এর ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সম্পত্তি ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নেমে এসেছে। এতে ব্যবসায়ে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে। শেয়ার বাজার চাঙ্গা করার জন্য বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। অবকাঠামোগত সুবিধা, বিদ্যুৎ সুবিধা, সহজ ব্যাংক ঋণ প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে শিল্প-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হচ্ছে। দেশের মাথাপিছু আয় দিন দিন বাড়ায় এদেশের অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নতি বেশ লক্ষণীয়। উৎপাদন ও বণ্টনে স্বাধীনতা থাকায় এবং প্রতিযোগিতা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ায় এখানে ব্যবসায়ের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। দক্ষ উদ্যোক্তা ও সম্ভা জনশক্তির কারণে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প গড়ে ওঠছে।
৩. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ (Social and cultural environment): বাংলাদেশের মানুষ জাতিগত, ঐতিহ্যগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে উদার, পরিশ্রমী এবং সৃজনশীল। অতীতে জাহাজ নির্মাণ করে এবং মসলিন কাপড় উৎপাদন করে এদেশের মানুষ তাদের প্রতিভা ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখেছে। সোনারগী এক সময় ব্যবসায়, শিক্ষা দীক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কারু শিল্পে ছিল বিশ্বসেরা। বর্তমানেও জামদানি শাড়ি এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছে। এছাড়া, বাংলাদেশে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আধিক্য, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুসম্পর্ক, জাতীয়তাবোধ, জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-ভাবনার ধরন, ঐতিহ্য, রীতি ও প্রথা সবই ব্যবসায়ের জন্য বেশ অনুকূল। এগুলোর ভিত্তিতে এদেশে ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, ট্যানারি ও কলকারখানা থেকে বর্জ্য ও রাসায়নিক নির্গমনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ সামাজিক পরিবেশের অন্যতম নেতিবাচক দিক। সরকার এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যও জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
৪. রাজনৈতিক পরিবেশ (Political cnvironment): বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে স্থিতিশীল। সরকারের নীতিও আগের চেয়ে অনেক যুগোপযোগী ও ব্যবসায়বান্ধব। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছে। ধর্মঘট, হরতালসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে অনেক কমে গেছে। এখানে সার্বভৌমত্বের কোনো সমস্যা পরিলক্ষিত হয় না। বর্তমানে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ ও বাংলাদেশে শিল্প-বাণিজ্য বিকাশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
৫. ধর্মীয় পরিবেশ (Religious environmen): বাংলাদেশে ধর্মীয় পরিবেশ প্রায় সব ধরনের ব্যবসায়ের জন্যই অনুকূল। এখানে একাধিক ধর্মের লোক থাকায় ব্যবসায়ে ভিন্নতা আনার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া, এখানে ধর্মীয় বিশ্বাস, চর্চা ও অনুভূতি সবই ব্যবসায়ের অনুকূলে। ধর্মের প্রচার ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বও কোনো ব্যবসায়ে বাধা তৈরি করে না। তবে, এটি মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলায় ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ ব্যবসায়ে বেশ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের বেশ সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হয়। সর্বোপরি, বাংলাদেশের ধর্মীয় পরিবেশ যথেষ্ট ব্যবসায়বান্ধব।
৬. আইনগত পরিবেশ (Legal environment): আইনগত পরিবেশের বেশ কিছু উপাদান বাংলাদেশে আধুনিক ও যুগোপযোগী হলেও অনেকগুলো আইন (শিল্প আইন, বাণিজ্য আইন প্রভৃতি) বেশ পুরোনো। পরিবেশ সংরক্ষণ ও ভোক্তা আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দরকার। এছাড়া দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের শিল্প -বাণিজ্যের উন্নতি নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু, এদেশ আইন প্রণয়নে যথেষ্ট সফল হলেও তা বাস্তবায়নে অতটা দৃঢ় নয়। আবার, দেশীয় পণ্য ও শিল্প রক্ষায় দেশীয় উদ্যোক্তা সংরক্ষণমূলক আইনেও দুর্বলতা রয়েছে।
৭. প্রযুক্তিগত পরিবেশ (Technological environment): যেসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পরিবেশে উন্নত, তারা শিল্প-বাণিজ্যেও উন্নত। তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সহজতর করে। ফলে, উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ ও গুণগত মান বাড়ে। বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশের প্রযুক্তিগত উপাদানগুলো সব ক্ষেত্রেই উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তাই, ব্যবসায়ের সব শাখায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এদেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটছে। গড়ে ওঠছে বহু বিজ্ঞান ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া, প্রযুক্তি আমদানির সুযোগও এদেশে রয়েছে। আবার, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত পরিবেশের উন্নয়নের ধারা বেশ গতিশীল। আর, এর ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল।
তাই বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশের অনেক উপাদানই শিল্প-বাণিজ্যের অনুকূল বা সহায়ক। সব ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির উন্নতির জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও জনসাধারণকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নের সমস্যা|Problems at Developing Business Environment in Bangladesh
বাংলাদেশে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকলেও তা এখনো আশানুরূপ উন্নতি অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশ সবক্ষেত্রে আশানুরূপ নয়। ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা লক্ষণীয় তা হলো:
১. অপর্যাপ্ত প্রযুক্তি (Insufficient technology): কৃষি ব্যবস্থা ও শিল্প কারখানা পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর নয়। মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়। বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। তবে, উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং কলাকৌশলের জন্য আমরা এখনো বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল।
২. অর্থ ব্যবস্থা (Financial condition): বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ দিন দিন বাড়লেও সঞ্চয়ের পরিমাণ সেইভাবে বাড়ছে না। তাই, বিনিয়োগ ও মূলধন গঠনের প্রবণতা কম। পুঁজিবাজার এবং ঋণ ব্যবস্থাও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ কারণে কিছু অসাধু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
৩. রাজনৈতিক পরিস্থিতি (Political condition): বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। তবে, অতীতে দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা অপরাজনীতি থেকে সরে আসতে সময় লাগছে। অনেকের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ষড়যন্ত্র, অসাধু ব্যবসায়ীদের কালোবাজারি প্রভৃতির কারণে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অনেক শুভ উদ্যোগ বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না।
৪. প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর স্বল্পতা (Limited infrastructural facility): প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অপরিহার্য এমন মৌলিক কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধাকে অবকাঠামো বলে। ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকা আবশ্যক। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে অনেক প্রকল্প হাতে নিলেও তা বাস্তায়নে সময় লাগছে। এজন্য শিল্প-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় রাস্তা-ঘাট, যানবাহন ব্যবস্থা, গ্যাস, পানি সরবরাহ, বন্দর সুবিধা প্রভৃতির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে, কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে শিল্প-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হচ্ছে না।
৫. প্রাকৃতিক বিপর্যয় (Natural disaster): বাংলাদেশে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেকটাই অনুকূল বলে বিবেচিত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলজ, বনজ ও প্রাণিজ সম্পদের দ্রুত হ্রাস, খনিজ সম্পদের অপচয়, নদীভাঙন, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব এদেশের ব্যবসায়ের ওপরও পড়ছে।
৬. নৈতিকতা ও সঠিক মূল্যবোধের অভাব (Lack of ethics and proper values): অনেক অসাধু ব্যক্তি ব্যবসায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অনুসরণ করে না। কোনো কোনো ব্যবসায়ী নীতি -নৈতিকতার বিসর্জন দিয়ে ব্যবসায় পরিবেশকে জটিল করে তুলছে। এছাড়া, অনেক ব্যবসায়ীদের মূল্যবোধেও ঘাটতি লক্ষণীয়, যা ব্যবসায় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে।
৭. আইনগত ব্যবস্থা (Legal condition): বাংলাদেশের আইনগত পরিবেশ ব্যবসায়ের জন্য বেশ ইতিবাচক। পুরোনো ও সেকেলে আইনগুলো আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে। এছাড়া, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নসহ মালিক- শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে, ব্যক্তিবিশেষের সীমাবদ্ধতা ও অসহযোগিতার কারণে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, যা ব্যবসায়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৮. আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা (Bureaucratic system): বহু সাংগঠনিক স্তর বিশিষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আমলাতন্ত্র বলা হয়। এর কারণে নতুন ব্যবসায় স্থাপনে অনেক নিয়ম- ষকানুন ও বহু সাংগঠনিক স্তরবিশিষ্ট আইনগত আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। এজন্য ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা অফিসের দ্বারস্থ হতে হয় ষ। এই সুযোগে অনেক অসাধু কর্মচারী উদ্যোক্তাকে নানাভাবে হয়রানি করে। এতে ব্যবসায়ীর অনেক সময়ও অপচয় হয়।
৯. প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব (Lack of technological knowledge and awareness): প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে ক্রমেই বাড়ছে। তারপরও প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কারিগর পাওয়া যাচ্ছে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রমও কাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়ছে না। এক্ষেত্রে, আমরা অনেকাংশেই বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও দেশের বেশিরভাগ জনগণ পরিবেশ সংরক্ষণ ও নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন নয়। ফলে ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
তাই বলা যায়, বাংলাদেশে ব্যবসায়ের জন্য এর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনগত, প্রযুক্তিগত, সামাজিক প্রভৃতি পরিবেশ সবক্ষেত্রে অনুকূলে নয়। এসব ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নের সমস্যা সমাধানের উপায় |Ways to Solve the Problems to Develop Business Environment in Bangladesh
ভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত থাকায় উন্নত বিশ্বের সাথে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
১. মানবসম্পদ উন্নয়ন (Development of human resource): মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো। মানুষকে দক্ষ ও শিক্ষিত করে তুলতে পারলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে দেশে মূলধন গঠন ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হবে। সর্বোপরি ব্যবসায় পরিবেশেরও উন্নতি হবে এবং নতুন নতুন ব্যবসায়ের দ্বার উন্মোচিত হবে।
২. অবকাঠামোগত উন্নয়ন (Infrastructural development): একটি শিল্প-বাণিজ্য সহায়ক অবকাঠামো নিশ্চিত করতে না পারলে ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট, বন্দর ব্যবস্থা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। এতে শিল্প -বাণিজ্যের প্রসার সহজ হবে।
৩. সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা (Governmental patronisation): অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের উদার বিনিয়োগ নীতি, স্থিতিশীল পুঁজিবাজার, অর্থ ও ব্যাংক ব্যবস্থা প্রভৃতির দ্রুত উন্নয়ন করা দরকার। নতুন উদ্যোক্তাদের প্রেষণা দেওয়ার পাশাপাশি বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের সমস্যা দূরীকরণের পদক্ষেপও নেওয়া জরুরি।
৪. লালফিতার দৌরাত্ম্য ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ (Removing red tapism and bureaucratic complexity): সনাতন রীতি অনুযায়ী অফিসে তথ্যাবলি পালফিতায় নথিবন্দি করে রাখাকে লালফিতার দৌরাত্ম্য বলে। আর, সরকারি কর্মচারীদের অতিরিক্ত নিয়ম-নীতি মেনে চলার কারণে কাজের ধীরগতিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বলা হয়। নতুন ব্যবসায় স্থাপনে সহজ প্রক্রিয়া অনুসরণ ও সালফিতার দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত করে সহজে ব্যবসায়ের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
৫. আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন (Developing law and order): রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নয়নের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় - এ নীতি শুধু কথায় না রেখে এর বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবেশের দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসহ সমাজের সুশীল শ্রেণিকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে।
৬. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন (Technological development): প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য দেশে ব্যাপক গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মসূচি তৈরি করা উচিত। অন্যদিকে, উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি ও প্রসার ঘটাতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত ও কারিগরি জ্ঞানের প্রসারের মাধ্যমে জনশক্তির প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করতে হবে। এভাবে দেশের প্রযুক্তিগত পরিবেশের উন্নয়ন করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসায়িক পরিবেশগত উন্নতির জন্য সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা অপরিহার্য। তাই সরকার, রাজনৈতিক দল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, প্রশাসন, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ সব স্তরের জনগণকে বসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।