ব্যাংক ঋণের ধারণা | Concept Bank Loan

ব্যাংক ঋণ কি | What is Bank's Loan or Credit?


সাধারণ অর্থে ব্যাংক তার গ্রাহকদেরকে আর্থিকভাবে যে ঋণ দিয়ে থাকে তাকেই ব্যাংক ঋণ বলে। ব্যাংক শুধুমাত্র নগদ অর্থেই ঋণ দেয় না। বিভিন্ন দলিলের মাধ্যমে তার সুনাম, সুখ্যাতি ও বিশ্বাস গ্রাহকদেরকে ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েও ঋণ দেয়। তাই ব্যাপক অর্থে বলা যায় যে, মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যাংক তার নগদ অর্থ এবং দলিলের মাধ্যমে সুনাম, বিশ্বাস ও সেবা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার দিয়ে গ্রাহকদেরকে যে সহযোগিতা প্রদান করে তাকে ব্যাংক ঋণ বা ব্যাংকের ঋণদান বলে।

উপরোক্ত আলোচনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ব্যাংক নিম্নোক্ত তিন ধরনের খাতে ঋণ দিয়ে থাকে:

১. নগদ অর্থে প্রদত্ত ঋণ বা অগ্রীম (Loan paid in cash or advance): ব্যাংক নগদ অর্থে গ্রাহকদেরকে যে ঋণ মঞ্জুর করে তাকে নগদ অর্থে প্রদত্ত ঋণ বলে। সাধারণভাবে ব্যাংকের ঋণদান বলতে নগদ অর্থে প্রদত্ত ঋণকেই বুঝায়। একে ব্যাংকের অগ্রিম (Advance) ও বলা হয়ে থাকে।

২. দলিলের মাধ্যমে প্রদত্ত ঋণ (Sanctioning Loan by documents): ব্যাংক তার সুনামের বিপরীতে গ্রাহকের পক্ষে তৃতীয় পক্ষ বরাবর কোনো দলিল ইস্যুর মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর করলে তাকে দলিলের মাধ্যমে প্রদত্ত ঋণ বলে। প্রত্যয়পত্র, ব্যাংক গ্যারান্টিপত্র ইত্যাদি এর উদাহরণ।

৩. দলিলপত্র ক্রয়ের মাধ্যমে প্রদত্ত ঋণ (Sanctioning Loan by purchasing documents): ব্যাংক সরকারি বা বেসরকারি ঋণপত্র ক্রয় করেও ঋণ প্রদান করতে পারে। এ ছাড়া বিনিময় বিল, হুন্ডি ইত্যাদি ক্রয় বা বাট্টা করেও ঋণ মঞ্জুর করা যায়।
ব্যাংক ঋণের ধারণা

ব্যাংক ঋণের গুরুত্ব| Importance of Bank Loan 


প্রাচীনকালে থেকেই ব্যবসায়ের সাথে ঋণের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানকালে এ প্রভাব আরও ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। ঋণ ব্যতীত এখন আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ভাবাই যায় না। নিম্নে এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:

১. ধারে ব্যবসায় পরিচালনা (Managing business on loan): ব্যাংক ফণ দ্বারা ব্যবসায়ীরা জাতি সহজে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে। ব্যাংকারের সুনাম কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বাকিতে ব্যবসার চালানোর সুযোগ পায়।

২. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার (Extension of international trade): আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাংক ঋণের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। ঋণের দলিল, বিশেষ করে প্রত্যয়পত্র ব্যবহার না করে বর্তমান যুগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব বললে অত্যুক্তি হবে না। বৈদেশিক বাণিজ্য ধারে জয় বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল বিধায় ঋণ বিশেষত ঋণের দলিলের ব্যবহার সেক্ষেত্রে অপরিহার্য গণ্য হয়।

৩. শিল্পের প্রসার (Extension of industry): ব্যাংক ঋণ দেশের শিল্পোন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করে। শিল্পপতিরা ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া শিল্প মালিকদের প্রয়োজনে চলতি মূলধনও ব্যাংক সংস্থান করে থাকে। বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সংগ্রহে ব্যাংক সহায়তা দেয়। ফলে সহজেই শিল্পের প্রসার ঘটে।

৪. কৃষি উন্নয়ন (Development of agriculture): ব্যাংক ঋণ কৃষি উন্নয়নেও সহায়তা করে। ব্যাংক হতে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যম মেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে কৃষিপণ্যের উৎপাদকেরা কৃষি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম ও উপকরণ ক্রয় করতে পারে।

৫. গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি (Increasing the purchase power of the clients): ব্যাংক ঋণ গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। অর্থনীতিতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তা ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. নগদ অর্থের বিকল্প (Alternative of cash money): ব্যাংক ঋণের দলিলসমূহ ব্যবসায়ী ও অন্যদের নগদ অর্থের প্রয়োজন মিটিয়ে তাদের আপন আপন চলার পথ সুগম করে। ব্যাংক ড্রাফট, ট্রাভেলার্স চেক, ভ্রাম্যমান নোট ইত্যাদি দলিল বর্তমানকালে অর্থ সংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

৭. ভ্রমণের সহায়ক (Helping journey): যারা দেশে- বিদেশে পরিভ্রমণ করতে চায় তাদের জন্যও ব্যাংক ঋণের দলিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটকের প্রত্যয়পত্র, ভ্রমণকারীর চেক, ভ্রাম্যমাণ নোট ইত্যাদি ভ্রমণকারীদের নগদ অর্থ নিয়ে ঘোরাফেরার ঝুঁকি হতে অব্যাহতি দেয়। ভ্রমণের সহায়ক হিসেবে ঋণের দলিল বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

৮. সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ (Assuring the proper use of wealth): অর্থের অভাবে প্রায়শই উদ্যোক্তারা দেশের অভ্যন্তরে প্রাপ্তব্য সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে না ষ। ব্যাংকগুলো তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ প্রদান করে সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এতে দেশের মোট উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়ে।

৯. অর্থায়ন সরবরাহ (Providing finance): ব্যাংক প্রদত্ত ঋণ ফার্মসমূহের জন্য বাহ্যিক অর্থায়নের সর্ববৃহৎ উৎস। ব্যাংকসমূহ আমানত হিসাবে সংগৃহীত অর্থকে বিভিন্ন ধরনের ঋণ পণ্যে পরিণত করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বণ্টন করে। ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী স্বল্প, মধ্য অথবা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ হিসাবে তা গ্রহণ করে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে। অর্থাৎ তাদের উৎপাদন, বণ্টন, বিনিয়োগ প্রভৃতি ব্যবসায়িক কার্যক্রম অর্থায়নে ব্যাংক ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১০. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন (Development of small & cottage industry): বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহে বৃহদায়তন শিল্প গড়ে তোলা বা দ্রুত বিকাশ সাধন অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। সেজন্য এসব দেশে ছোটো ছোটো শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে গুরুত্বারোপ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রধানত বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহ এ ধরনের শিল্পে ঋণদান করে অনেকক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এ ধরনের শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখে।

১১. ভোগ বৃদ্ধি (Increase in consumption): ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে ব্যাংকসমূহ ভোক্তা ঋণ (Consumer credit) সরবরাহের মাধ্যমে ক্রেতাদের ক্রয়-ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে পরোক্ষভাবে উৎপাদনের পরিমাণও বৃদ্ধি পায় এবং কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পায়।

১২. গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন (Development rural economy): ব্যাংকসমূহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও শাখা স্থাপনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ব্যাংকিং পরিসেবা সম্প্রসারণ করছে। এতে বৃহত্তর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষকে যেমনি সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নও ত্বরান্বিত হচ্ছে।

১৩. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি (Enhancement of employment opportunity): ব্যাংক ঋণ পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে। ব্যাংক ঋণের সহায়তায় শিল্প -বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। তাছাড়া বেকার তরুণেরা উদ্যোক্তা হয়ে ব্যবসায়িক কর্মকান্ড সূচনারও সুযোগ পায়। স্বাভাবিকভাগেই এতে কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।

১৪. আয় বৃদ্ধি (Increase in income): ব্যাংক ঋণ কমসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করে বলে মাথাপিছু ও জাতীয় আয়ও বৃদ্ধি পায়।

১৫. সম্পদের দক্ষ ব্যবহার (Efficient utilization of resources): ব্যাংক ঋণের সহায়তায় শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় বলে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঁচামাল ও অন্যান্য সম্পদাদির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়। তাছাড়া কর্মসংস্থানের বর্ধিত সুযোগ মানব সম্পদেরও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে।

১৬. জীবনযাত্রার মনোন্নয়ন (Improvement in living condition): ব্যাংক ঋণ শিল্প-কারখানার, ব্যবসায়- বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটায়, মাথাপিছু ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি করে। স্থানীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে যা সার্বিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অবদান রাখে। পরিশেষে বলা যায়, ব্যাংক ব্যবসায়- বণিজ্যে তহবিলের প্রধান ও সর্ববৃহৎ যোগানদাতা। ব্যাংক সরবরাহকৃত ঋণ তহবিল, উৎপাদন, বিনিয়োগ, বণ্টনসহ অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে অবদান রাখে। 

উপসংহারে বলা যায়, বর্তমান বৃহদায়তন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জগতে ঋণ ছাড়া ব্যবসায়-বাণিজ্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গঠন ও পরিচালনা সম্ভব নয় । তাই সকল দেশেই ঋণদানের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কমরত রয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া উন্নত বা অনুন্নত কোনো দেশেই কার্যকর মানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা একেবারেই অসম্ভব।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url