খাজনার ধারণা | Concept of Rent

খাজনা কি |What is Rent?


খাজনা বলতে সাধারণত জমি, বাড়ি, দোকানপাট ইত্যাদি ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তে চুক্তি মোতাবেক এসবের মালিককে যে অর্থ প্রদান করা হয় তাকে বোঝায়। তবে অর্থনীতিতে খাজনার অর্থ ভিন্নতর। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদগণ খাজনাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে, অস্থিতিস্থাপক যোগান বিশিষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন- জমি, খনি, মৎস্য সম্পদ, প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য এসবের মালিককে যে অর্থ দেওয়া হয় তাকে খাজনা বলে।

ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে,
জমির ব্যবহারের জন্য যে অর্থ তার মালিককে দেওয়া হয় তাকে খাজনা বলে।

আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ খাজনাকে একটু ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাদের মতে, সীমাবদ্ধ যোগান বিশিষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়াও যেকোনো সম্পদ যদি তার ন্যূনতম দাম থেকে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করে তাকে খাজনা বলে।

জায়ান রবিনসন এর মতে,
কোনো উপাদানকে যে ন্যূনতম দামে কাজে নিযুক্ত করানো যায় তা অপেক্ষা যে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পায় তাকে খাজনা বলে।

Oxford Dictionary of Economics অনুযায়ী,
জমি অথবা বিল্ডিং ব্যবহারের জন্য যে অর্থ প্রদান করা হয় তাকে খাজনা বলে।

জমির উৎপাদন শক্তি এবং অবস্থানের কারণে মালিক যে অতিরিক্ত আয় করেন, যার জন্য তিনি কোনো ব্যয় করেননি তাকে প্রকৃত খাজনা (pure rent) বলা হয়। আর জমি বা বিল্ডিং এর উন্নয়নের জন্য (যেমন- জমির উন্নয়ন, সেচ ব্যবস্থার উন্নতি) যে অর্থ প্রদান করা হয় তাকে নিম খাজনা (quasi rent) বলে।

আধুনিক অর্থনীতিবিদ এস ফিশার, আর ডনবুশ এবং স্যামুয়েলসন বলেন, একটি উপকরণ সর্বনিম্ন যে মূল্য পেলে নির্দিষ্ট পরিমাণ সেবা যোগান দিতে সম্মত ছিল তার চেয়ে বেশি মূল্য প্রদত্ত হলে সে খাজনা অর্জন করে। যেমন একজন খেলোয়াড় সর্বনিম্ন এক লক্ষ ডলার পেলে এক বছর ভাড়াতে খেলতে রাজি ছিল। কিন্তু তাকে দশ লক্ষ ওপার দেওয়া হলো। সুতরাং তার খাজনা হলো: (১০ লক্ষ – ১ লক্ষ) ডলার = ৯ লক্ষ ডলার। এক্ষেত্রে উপকরণের যোগান রেখা সম্পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক হওয়া শর্ত নয়। তাই দ্রব্য বাজারে যা উৎপাদনকারীর উদ্বৃত্ত (producer's surplus), তাই হলো উপকরণের ক্ষেত্রে খাজনা। যে অতিরিক্ত দাম দেওয়া হয় তা কে খাজনা বলে। সুতরাং, ভূমি ও অন্যান্য উপকরণ যার যোগান সাময়িকভাবে সীমাবদ্ধ সে সকল সম্পদের ন্যূনতম যোগান দামের চেয়ে যে অতিরিক্ত দাম দেওয়া হয় তাকে খাজনা বলে।
খাজনা কি

খাজনার বৈশিষ্ট্য|Characteristics of Rent


১. খাজনা হলো ভূমি ও অন্যান্য সীমাবদ্ধ যোগান সম্পন্ন সম্পদের মালিকানার আয়।

২. সম্পদের যোগান রেখা সম্পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক হবে এমন শর্ত অর্থনৈতিক খাজনায় নাও থাকতে পারে।

৩. খাজনা সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থ মূল্যে প্রকাশিত হয়।

৪. উৎপাদন শক্তি এবং অবস্থানের কারণে খাজনার পার্থক্য ঘটে।

৫. প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের জন্য প্রদেয় অর্থকে 'প্রকৃত খাজনা' (pure rent) এবং অন্যান্য সম্পদের ব্যবহারের জন্য প্রদেয় অর্থকে 'নিম খাজনা' বলে।

খাজনার প্রকারভেদ|Types of Rent


ক. উপকরণের দৃষ্টিকোণ থেকে খাজনা দুই প্রকার। যথা:
১. বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক খাজনা (pure economic rent)
২. অর্থনৈতিক খাজনা (economic rent)

১. বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক খাজনা: জমির জন্য চুক্তি অনুসারে জমির মালিক যে আয় লাভ করে তাকে বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক খাজনা বলে। এর শর্ত হলো:

ক. সম্পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক যোগান
খ. উক্ত উপাদান অন্য দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যাবে না।

২. অর্থনৈতিক খাজনা: অপরিবর্তনীয় এবং সীমিত যোগান বিশিষ্ট যেকোনো উপাদানের ক্ষেত্রে উপকরণ যোগানের পূর্ণ অস্থিতিস্থাপকতার কারণে উক্ত উপাদানের মালিক যে পরিতোষিক লাভ করে তাকে অর্থনৈতিক খাজনা বলে।

খ. আয় এর দৃষ্টিকোণ থেকে খাজনা তিন প্রকার। যথা:

১. মোট খাজনা: ভূমি ব্যবহারকারী ভূমির মালিককে একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তে চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ দেয় তাকে মোট খাজনা বা চুক্তিবদ্ধ খাজনা (contract rent) বলে।

২. নিট খাজনা: শুধু ভূমি ব্যবহারের জন্য ভূমির মালিককে যে অর্থ দেওয়া হয় তাকে নিট খাজনা বলে।

৩. নিম খাজনা: স্বয়কালে পূর্ণ ও অস্থিতিস্থাপকতার কারণে স্বাভাবিক আয় অপেক্ষা অধিক আয় লাভ করতে সক্ষম হলে এ অতিরিক্ত আয়কে নিম খাজনা বলে।

খাজনা কেন দেওয়া হয়|Why Rent is Paid?


খাজনার সংজ্ঞা থেকেই খাজনার উদ্ভবের কারণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে খাজনা দেওয়া হয়। এগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:

১. অস্থিতিস্থাপক যোগান: অস্থিতিস্থাপক যোগান হলো, যে উপকরণের যোগান বৃদ্ধি পায় না। ফলে চাহিদা বাড়লে, কোনো উপকরণের যোগান অস্থিতিস্থাপক হলে সর্বনিম্ন যোগান দামের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করে। যেমন- জমির যোগান অস্থিতিস্থাপক বা সীমাবদ্ধ। এজন্য জমির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জমির মালিককে জমি ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়।

২. জমির উর্বরতার পার্থক্য: রিকার্ডোর মতে, জমির উর্বরা শক্তির পার্থক্যের কারণে খাজনার উদ্ভব হয়। তার মতে, প্রান্তিক জমির কোনো খাজনা নেই। উৎকৃষ্ট জমিতে উৎপাদন খরচের চেয়ে আয় বেশি বলে তার মালিককে খাজনা দিতে হয়।

৩. জমির অবস্থানগত পার্থক্য: জমির অবস্থানগত পার্থক্যের কারণেও খাজনার উদ্ভব হয়। শহর, নগর, বন্দর বা বাজারের নিকটবর্তী জমির খাজনা দূরবর্তী জমি অপেক্ষা খাজনার পরিমাণ বেশি হয়। কেননা শহরের নিকটবর্তী জমির চাহিদা বেশি বলে দূরবর্তী জমি অপেক্ষা অতিরিক্ত আয় অর্জন করে।

৪. সীমাবদ্ধ যোগান: যে সকল উপকরণের যোগান সাময়িকভাবে সীমাবদ্ধ সে সকল উপকরণের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত খাজনা দিতে হয়।

৫. ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির কার্যকারিতা: একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে অধিক পরিমাণে শ্রম ও মূলধনের নিয়োগ বাড়াতে থাকলে, প্রাথমিক অবস্থায় মোট উৎপাদন ক্রমবর্ধমান হারে বাড়লেও পরবর্তীতে ক্রমহ্রাসমান হারে কমে। অপরদিকে, জমির পরিমাণ বাড়ানো যায় না বলে অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য জমির চাহিদা বাড়ে। ফলে জমির খাজনা দিতে হয়।

৬. জমির বিকল্প ব্যবহার: একই জমি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়। কোনো জমিতে ধান চাষের পরিবর্তে সবজি চাষ করলে উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি উদ্বৃত্ত থাকে। এক্ষেত্রে সবজি চাষের জন্য খাজনা দিতে হয়। সুতরাং জমির সীমাবদ্ধ যোগান, অবস্থানগত পার্থক্য এবং উর্বরা শক্তির পার্থক্যের কারণে খাজনার উদ্ভব হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url