ঝুঁকির ধারণা| Concept of Risk
ঝুঁকি বলতে কী বুঝায়|What is meant by Risk?
সাধারণভাবে ঝুঁকি হলো আর্থিকভাবে পরিমাপযোগ্য ক্ষতি সংঘটনের সম্ভাবনা। মানুষের জীবন ও সম্পত্তিকে ঘিরে সবসময়ই অনিশ্চয়তা বা ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমান। এই ক্ষতির সম্ভাবনা অনিশ্চয়তার ফসল। অনিশ্চয়তা বলতে যা নিশ্চিত নয় বা সন্দেহ-সংশয় রয়েছে এমন কিছুকে বুঝায়। মানুষ যেকোন সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে, অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, রাস্তায় চলতে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে, বাড়ি পুড়ে যেতে পারে, জাহাজডুবি হতে পারে, ব্যবসায়ে লাভ না হতে পারে, জিনিসের দাম কমে যেতে পারে এভাবে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সন্দেহ-সংশয় কম-বেশি বিরাজ করে। এই সন্দেহ-সংশয় বা অনিশ্চয়তা থেকেই ঝুঁকির উৎপত্তি।
Prof. Mark R. Greene বলেন,
ঝুঁকি হলো কোনো একটা আর্থিক ক্ষতি সংঘটনের অনিশ্চয়তা।
John J. Hampton এর মতে,
কোনো বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা প্রকৃত আয় কম হওয়ার সম্ভাবনাকেই ঝুঁকি বলে আখ্যায়িত করা যায়।
M.N. Mishra বলেন,
কোনো আর্থিক ক্ষতির অনিশ্চয়তাই হলো ঝুঁকি।
মি. মিশ্র কোনো ক্ষতির কারণ বা বিপদকে ঝুঁকি না বলে ক্ষতি হওয়ার শংকাকে ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উপরের আলোচনা ও সংজ্ঞা বিশ্লেষণে ঝুঁকির নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি লক্ষণীয়:
ঝুঁকির বৈশিষ্ট্যা Features of Risk
১. অনিশ্চয়তা বা শংকাকে ঘিরে ঝুঁকি আবর্তিত হয়। এরূপ শংকা বেশি হলে ঝুঁকিও বেশি হয়।
২. আর্থিক ক্ষতির শংকা বা অনিশ্চয়তাই বিমার ক্ষেত্রে ঝুঁকি হিসেবে গণ্য।
৩. সম্ভাবনা তত্ত্বের ব্যবহার করে ঝুঁকির আর্থিক পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব এবং
৪. ঝুঁকিকে সরাসরি প্রতিরোধ করা যায় না; তবে একই ঝুঁকির সম্মুখীন অনেক ব্যক্তিদের মধ্যে তা বণ্টন করে আর্থিক প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা যায়।
উপসংহারে বলা যায়, মানুষের জীবন ও সম্পত্তিকে ঘিরে যে ক্ষতির সম্ভাবনা, শংকা বা অনিশ্চয়তা বিদ্যমান তার যেই অংশ অর্থ দ্বারা পরিমাপযোগ্য তাকেই ঝুঁকি বলে। এরূপ অনিশ্চয়তা প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক নানান কারণেই উদ্ভূত হতে পারে। বীমা ব্যবস্থার অধীনে ক্ষতির সম্মুখীন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকি সহজেই বণ্টনযোগ্য।
ঝুঁকির প্রকারভেদ|Variours Types of Risk
ঝুঁকি হলো আর্থিকভাবে পরিমাপযোগ্য ক্ষতি সংঘটনের সম্ভাবনা। এরূপ সম্ভাবনা নানান বিপদজনক বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, কার্যক্রম বা ঘটনা হতে উদ্ভূত হয়। মানুষের জীবন ও সম্পত্তি নানান ধরনের অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি দ্বারা পরিবেষ্টিত বিধায় এবং ঝুঁকির মাত্রাও ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নতর হওয়ায় একে সুস্পষ্টভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা কষ্টকর। এছাড়াও পরিবর্তনের ধারাতে নতুন নতুন ঝুঁকির সৃষ্টি হওয়ায় এর স্থির বিন্যাস অসম্ভব।
১. আর্থিক ঝুঁকি (Financial risk): কোনো বিপদজনক বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, কার্যক্রম বা দুর্ঘটনা থেকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা লক্ষ করা যায় তাকে আর্থিক ঝুঁকি বলে। জাহাজডুবি, কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, মালামাল চুরি যাওয়া ইত্যাদির ঝুঁকি পরিমাপযোগ্য বিধায় এগুলো আর্থিক ঝুঁকি হিসেবে গণ্য। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত দুর্ঘটনার ঝুঁকিও আদালতের রায়ে বা বীমাকারী ও বীমাকৃত ব্যক্তির উভয় পক্ষের আইনজীবীগণের পারস্পরিক সমঝোতায় নিরূপণযোগ্য । ফলে তাও আর্থিক ঝুঁকি। এরূপ ঝুঁকি সাধারণভাবে বীমাযোগ্য।
২. অনার্থিক ঝুঁকি (Non-financial risk): যে ঝুঁকির ফলাফল আর্থিকভাবে পরিমাপ করা যায় না তাকে অনার্থিক ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা বলে। ফাস্টফুডের দোকানে নতুন আইটেমে কেউ প্রত্যাশিত স্বাদ না পাওয়ায় মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে যার ঝুঁকি আর্থিকভাবে পরিমাপযোগ্য নয়। কোনো পেশাকে ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ, বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া ইত্যাদিতে ঝুঁকি আছে। কিন্তু তা আর্থিকভাবে পরিমাপ করা যায় না। যা অনার্থিক ঝুঁকি হিসেবে গণ্য। এরূপ ঝুঁকি বিমাযোগ্য নয়।
৩. বিশুদ্ধ ঝুঁকি (Pure risk): যে সকল সম্ভাব্য বিপদজনক বা ঝুঁকিগত অবস্থায় অথবা কোনো দুর্ঘটনায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিশ্চিতভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাকে বিশুদ্ধ ঝুঁকি বলে। মালামাল পুড়ে গেলে, চুরি হলে, ব্যক্তি মারা গেলে, দুর্ঘটনায় পঙ্গু হলে প্রকৃত পক্ষেই ক্ষতি হয়ে যায়। এ ধরনের সকল ঝুঁকিই বিশুদ্ধ ঝুঁকি। আগুনে প্রতিষ্ঠান পুড়ে গেলে বা মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠান যে মুনাফা ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাও বিশুদ্ধ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
৪. দুরকল্পনামূলক ঝুঁকি (Speculative risk): যে ধরনের ঘটনা বা অনিশ্চয়তার ফলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশিত ফলাফলের বাইরে লাভ বা ক্ষতি উভয়েরই সম্ভাবনা থাকে তাকে ফটকা বা দুরকল্পনামূলক ঝুঁকি বলে। শেয়ারে অর্থ বিনিয়োগে লাভ বা ক্ষতি উভয়েরই সম্ভাবনা থাকে। যা ফটকা ঝুঁকি হিসেবে গণ্য।
৫. মৌলিক ঝুঁকি (Fundamental risk): যে ঝুঁকি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য কোনো কারণে উদ্ভূত হয় এবং এর ফলাফল সবাইকে সাধারণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাকে মৌলিক ঝুঁকি বলে। এ ধরনের ঝুঁকি প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক উভয়বিধ কারণেই সৃষ্ট হতে পারে। ভূমিকম্প, বন্যা, অগ্নুৎপাত, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধ, মন্দাবস্থা ইত্যাদি অপ্রাকৃতিক কারণে এ ধরনের ঝুঁকি উদ্ভূত হয়। এ ধরনের ক্ষতি সাধারণভাবে বিমাযোগ্য নয়। তবে নৌবিমার ক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড় বিমাযোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকে।
৬. নির্দিষ্ট ঝুঁকি (Particular risk): যে ঝুঁকি ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক বা কোনো কারণে উদ্ভূত হয় এবং ফলাফলও কোনো বিশেষ ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠানের ওপর আপতিত হয় তাকে নির্দিষ্ট ঝুঁকি বলে। আগুন লাগা, চুরি, ডাকাতি, ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা, যানবাহন দুর্ঘটনা ইত্যাদি নির্দিষ্ট ঝুঁকির উদাহরণ। এ ধরনের ঝুঁকি সবসময়ই বীমাযোগ্য।
৭. বীমাযোগ্য ঝুঁকি (Insurable risk): যে ঝুঁকির বিপক্ষে বিমা করে আর্থিক প্রতিরক্ষার সুযোগ নেয়া যায় তাকে বিমাযোগ্য ঝুঁকি বলে। মানুষের জীবন ও সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঝুঁকি বিমাযোগ্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দৈব দুর্বিপাক (Acr of God), দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ইত্যাদির ঝুঁকি বাদ দিলে অবশিষ্ট সকল ঝুঁকিই বিমাযোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকে। গ্রহণযোগ্যতার বিচারে এরূপ ঝুঁকি নিম্নোক্ত ধরনের হতে পারে:
i. উত্তম আদর্শিক ঝুঁকি (Super-standard risk): যে ঝুঁকির ক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাকে উত্তম আদর্শিক ঝুঁকি বলে। বীমা কোম্পানির পোর্টফলিওতে যদি এ ধরনের ঝুঁকির বিপক্ষে বিমা পলিসির সংখ্যা বেশি হয় তবে তা বীমা কোম্পানির কম ঝুঁকির নির্দেশ করে।
ii. আদর্শিক ঝুঁকি (Standard risk): স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য মাত্রার ঝুঁকিকে আদর্শিক ঝুঁকি বলে। এ ধরনের ঝুঁকি গ্রহণে বিমা কোম্পানিকে বেশি দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হয় না। কোনো বিশেষ অস্বাভাবিক অবস্থা না ঘটলে এ ধরনের ঝুঁকি কোম্পানির সহাসীমার মধ্যে থাকে।±২৫ ধরে ৭৫ থেকে ১২৫ মাত্রার ঝুঁকিকে আদর্শিক ঝুঁকি বলে।
iii. উপ-আদর্শিক ঝুঁকি (Sub-standard risk): স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অধিক ঝুঁকি সম্বলিত ঝুঁকিকে উপ-আদর্শিক ঝুঁকি বলে। বিভিন্ন দিক বিবেচনায় পয়েন্ট বিচারে ঝুঁকির মাত্রা ১০০ কে স্বাভাবিক গণ্য করা হয়। এখন (±) ২৫ ধরে ৭৫ থেকে ১২৫ মাত্রার ঝুঁকির উপরে কিন্তু ৫০০ এর নিচের ঝুঁকিকে উপ-আদর্শিক ঝুঁকি গণ্য করা হয়। এর অধিক মাত্রার ঝুঁকি বিমযোগ্য হলেও তা বিমা করা বিমা কোম্পানির পক্ষে উচিত নয়।
৮. অবীমাযোগ্য ঝুঁকি (Uninsurable risk): যে ঝুঁকির বিপক্ষে বীমা সুবিধা লাভ করা যায় না তাকে অবিমাযোগ্য ঝুঁকি বলে। যে ঝুঁকির ফলাফল সাধারণ এবং এর উপর মানুষের কোনো কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ নেই তা সাধারণভাবে অবিমাযোগ্য ঝুঁকি হিসেবে গণ্য। ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ঝুঁকির অধিকাংশই অবিমাযোগ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।