তালিকাভুক্ত ব্যাংকের ধারণা|Concept of Scheduled Bank

তালিকাভুক্ত ব্যাংক কি?

ইংরেজি সিডিউল (Schedule) শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ তালিকা বা ফর্ম। তালিকাভুক্ত বলতে ফর্মভুক্ত বা তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ বুঝায়। তাই তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলতে কোনো নির্দিষ্ট বা সংরক্ষিত তালিকার অন্তর্ভুক্ত ব্যাংকসমূহকে বুঝানো হয়ে থাকে। ব্যাংকিং পরিভাষায় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকার অন্তর্ভুক্ত ব্যাংকসমূহকে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলে।

১. ডঃ এ. আর. খান এর মতে,
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে কোনো ব্যাংক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করে তখন তাকে তফসিলি বা তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলে।

২. The Bangladesh bank order, 1972 এর ২ (j) ধারায় বলা হয়েছে যে,
তালিকাভুক্ত ব্যাংক হলো আর্টিকেল ৩৭ এর ২ (ক) ধারার অধীনে সংরক্ষিত (বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক) তালিকায় বর্তমানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন ব্যাংক। 
তালিকাভুক্ত ব্যাংকের ধারণা

তালিকাভুক্ত ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য | Features of Scheduled Bank


১. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য: তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ব্যাংকসমূহকে বুঝায়। তাই তালিকাভুক্ত সব ব্যাংকই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদস্য হিসেবে গণ্য। অর্থবাজারের সদস্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের মুদ্রাবাজারের অভিভাবক। তাই এর তালিকার অন্তর্ভুক্ত ব্যাংকসমূহ অবশ্যই দেশের অর্থবাজারের সম্মানিত সদস্য হিসেবে গণ্য হয়।

২. আইনানুগ অস্তিত্ব: তালিকাভুক্ত সব ব্যাংককেই দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং আইনের আওতায় অনুমোদিত ও নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হতে হয়। তাই এরূপ প্রতিষ্ঠান অবশ্যই পৃথক আইনগত অস্তিত্ব বা সত্তার অধিকারী হয়ে থাকে।

৩. ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ও সংরক্ষিত তহবিল: তালিকাভুক্ত সব ব্যাংকেরই একটা ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ও সংরক্ষিত তহবিল থাকে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে বিবৃত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সাথে পরামর্শক্রমে সময়ে সময়ে এরূপ পরিমাণ নির্ধারণ করে। ১২ আগস্ট, ২০০৮ থেকে এ পরিমাণ মোট ৪০০ কোটি টাকা নির্ধারিত রয়েছে।

৫. কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ: প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ব্যাংকই তার সংগৃহীত আমানতের একটা অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। একে নগদ জমা সংরক্ষণ আবশ্যকতা (CRR) বলে। আমাদের দেশে এরূপ জমার হার হলো বর্তমানে সাপ্তাহিক গড় ভিত্তিতে শতকরা ৪%। কিন্তু কোনো দিনই তা ৩.৫ % এর নিচে আসবে না। 

৬. তারল্য সংরক্ষণ: প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ব্যাংককেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিত নিয়মানুযায়ী আমানতের একটা ন্যূনতম অংশ বন্ড কিনে তরল সম্পদ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। যাকে SLR (Statutory Liquidity Ratio) বলে। বর্তমানে এ হার ১৩%। তবে ইসলামী শরিয়াহ এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ হার ৫.৫%।

৭. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসরণ: সারা বিশ্বজুড়েই তালিকাভুক্ত ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে হয়। তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি অনুসরণের বিষয়ে ব্যাংকগুলো এরূপ প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। তাই এরূপ অনুসরণে কোনো তালিকাভুক্ত ব্যাংক ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার জন্য শাস্তির নির্দেশ দিতে পারে।

৮. সহযোগিতার সম্পর্ক: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের একটা সহযোগিতার সম্পর্কও লক্ষণীয়। তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো বিপদে-আপদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেমনি সহযোগিতা পায় তেমনি তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসরণ করে তাকে সহযোগিতা দেয়।

তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের তত্ত্বাবধান |Supervision of Scheduled Bank

কেন্দ্রীয় ব্যংকের নিয়ম-নির্দেশনা মেনে তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহ পরিচালিত হচ্ছে কি না তা দেখা ও প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তা মান্য করার বিষয়টি নিশ্চিত করার কাজকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের তত্ত্বাবধান বলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশিত নিয়ম-নীতি মেনে চলার অঙ্গীকার প্রদানপূর্বক এর সদস্য তালিকায় তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহ অন্তর্ভুক্ত হয় বিধায় তা মেনে চলতে ব্যাংকসমূহ বাধ্য থাকে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও অন্যান্য বিশেষায়িত ব্যাংকের অধিকাংশই তালিকাভুক্ত ব্যাংক। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্তির জন্য যে সকল শর্ত পালন আবশ্যক তা নিম্নরূপ:

১. নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিশোধিত মূলধন ও সংরক্ষিত তহবিল: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্তির জন্য কোনো ব্যাংকের একটি ন্যূনতম নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিশোধিত মূলধন এবং সংরক্ষিত তহবিল থাকতে হয়। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা।

২. নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ: প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ব্যাংককে তার চলতি, সঞ্চয়ী ও স্থায়ী আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। বিভিন্ন দেশে এর পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এর পরিমাণ হলো বর্তমানে মোট আমানতের ৫.৫%। ৯.৪.২০২০ তারিখে ইস্যুকৃত সার্কুলার অনুযায়ী ১৫.৪.২০২০ থেকে প্রবর্তিত। ১০৪ থেকে সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (Liquid assets) সংরক্ষণ এর পরিমাণ হার (SLR) নগদ জমা সংরক্ষণ যা অপরিবর্তিত রয়েছে।

৩. নির্দিষ্ট পরিমাণ তরল সম্পদ সংরক্ষণ: প্রতিটি তালিকাভুক্ত ব্যাংককে তার মোট আমানতের নির্দিষ্ট অংশ সহজে বিনিময়যোগ্য তরল সম্পত্তি হিসেবে বন্ড কিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে এ হার বর্তমানে ১৩ %। তবে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ হার ৫.৫ %। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংককে কোনো তরল সম্পদ রাখতে পক্ষান্তরে হয় না।

৪. ব্যাংকিং কোম্পানি অথবা সংস্থা: কোম্পানি আইন মোতাবেক প্রতিটি তালিকাভুক্ত ব্যাংককে একটি ব্যাংকিং কোম্পানি কিংবা একটি সমবায় ব্যাংক কিংবা একটি সংস্থা কিংবা দেশের প্রচলিত কোনো আইন অনুযায়ী নিবন্ধনকৃত কোম্পানি হতে হয়।

৫. সাপ্তাহিক প্রতিবেদন দাখিল: তালিকাভুক্ত ব্যাংক যেসব আর্থিক কার্যাবলি সম্পাদন করে তার একটি সাপ্তাহিক বিবরণী বা প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট দাখিল করতে হয়। প্রত্যেক সপ্তাহের শেষ দিনে এই প্রতিবেদন দাখিল করা প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক।

৬. সততার নিশ্চয়তা প্রদান: প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এরূপ নিশ্চয়তা প্রদান করতে হয় যে, তারা তাদের সব কাজে সততা রক্ষা করে চলবে এবং তাদের কার্যক্রম আমানতকারীদের স্বার্থের প্রতিকূলে পরিচালিত হবে না।

৭. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ পালন: প্রতিটি তালিকাভুক্ত ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যাবতীয় নিয়ম কানুন মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হয়। যদি তালিকাভুক্ত ব্যাংক এ নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হয় তবে তার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের তত্ত্বাবধানের বিষয়|Subject to supervision of Scheduled banks


দেশের স্বার্থে তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহ যাতে সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে ও পরিচালিত হতে পারে তা তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই সক্রিয় থাকে। সেই সাথে এরূপ ব্যাংকসমূহ আমানতকারীদের স্বার্থের বিপক্ষে যেয়ে কোনো লেনদেন করে যেনো তাদের স্বার্থকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে না পারে তা নিশ্চিত করাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধরনের তত্ত্বাবধানের উদ্দেশ্য। ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আমানতকারী ও সংশ্লিষ্টদের আস্থা ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের কার্যক্রম মনিটরিং করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিম্নরূপ:

১. তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে নীতি-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

২. নিরীক্ষা ও পরিদর্শন বিভাগ পরিচালনার মাধ্যমে বাংকসমূহের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান।

৩. এরূপ ব্যাংকসমূহ নগদ জমা সঞ্চিতি ও বিধিবদ্ধ তারল্য সঞ্চিতি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করছে কি না তা দেখা ও নিশ্চিতকরণ।

৪. ব্যাংকসমূহ প্রদত্ত ঋণমানের ভিত্তিতে শ্রেণিভুক্ত করে খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ ও তার বিপক্ষে প্রভিশন রাখতে বাধ্যকরণ।

৫. ব্যাসেল ২ অনুযায়ী ব্যাংকসমূহের ঝুঁকিমুক্ত মূলধন পর্যাপ্ততা রয়েছে কি না তা তত্ত্বাবধান।

৬. ব্যাংকসমূহ নির্দেশনার বাইরে যেয়ে স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয় বা শেয়ার মার্কেটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করছে কি না তা তত্ত্বাবধান।

৭. এরূপ ব্যাংকসমূহ ঋণদানের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়ছে কি না বা সমস্যা সৃষ্টি করছে কি না তা পরিবীক্ষণ।

৮. ঋণদানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলা হচ্ছে কি না তার তত্ত্বাবধান।

৯. সুদ বা সার্ভিস চার্জ আদায় ও সুদ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকসমূহ কোনো অনিয়ম করছে কি না তা দেখা।

১০. বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানতে বাধ্যকরণ।

১১. বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক, এমডি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচন ও নিয়োগ তত্ত্বাবধান।

১২. ব্যাংকসমূহ সঠিকভাবে তাদের হিসাব ও খাতাপত্র সংরক্ষণ করছে কি না তা দেখা।

১৩. বার্ষিক লাভ-ক্ষতি উদ্বৃত্ত পত্র সঠিকভাবে প্রস্তুত ও নিরীক্ষা করছে কি না তা তত্ত্বাবধান।

১৪. ব্যাংকসমূহ তাদের বিভিন্ন সভাসমূহ সঠিকভাবে অনুষ্ঠান করছে কি না তা দেখা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের কার্যাবলি তত্ত্বাবধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময়ই সতর্ক থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ চালু রয়েছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url