ব্যাংকের প্রকারভেদ| Types of Bank

বর্তমান বিশেষায়ণের যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কাজ-কর্মে এবং এভাবে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যাপক বিভাজন ঘটেছে। শুধুমাত্র মস্তিষ্কের বিভিন্ন দিকের ওপরই আজকাল ডাক্তারগণ বিভিন্ন ডিগ্রি পাচ্ছেন। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান একেকটা কাজকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং কার্যক্রম তা থেকে পিছিয়ে নেই।

মালিকানা ভিত্তিতে ব্যাংকের শ্রেণীবিভাগ | Classification on Bank on the basis ownership


১. সরকারি ব্যাংক (State owned bank): যে ব্যাংকের সংগঠক, নিয়ন্ত্রক, পরিচালক ও মালিক সরকার তাকে সরকারি ব্যাংক বলে। এরূপ ব্যাংক সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে অথবা পরবর্তী সময়ে জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি মালিকানায় আনা হতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ইত্যাদি আমাদের দেশে এ ধরনের ব্যাংকের উদাহরণ।

২. বেসরকারি ব্যাংক (Private ownership bank): ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যাংককে বেসরকারি ব্যাংক বলে। তবে বেসরকারি ব্যাংক হলেও তালিকাভুক্তির প্রয়োজনেই এ সকল ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় থেকে সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ইত্যাদি এ ধরনের ব্যাংক।

৩. সরকারি ও বেসরকারি যৌথ মালিকানাধীন ব্যাংক (Govt. and private joint ownership bank): যে ব্যাংক সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ মালিকানাধীন ব্যাংক বলে। বাংলাদেশে আই.এফ.আই.সি ব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম এরূপ ব্যাংকের উদাহরণ।

৪. স্বায়ত্তশাসিত ব্যাংক (Autonomous bank): যে ব্যাংক সরকারের বিশেষ আইনবলে ও সংবিধানের বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে গঠিত হয় এবং যা স্বনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে স্বায়ত্তশাসিত ব্যাংক বলে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদি এরূপ ব্যাংকের উদাহরণ।
ব্যাংকের প্রকারভেদ

কার্যভিত্তিক ব্যাংকের শ্রেণিবিভাগ |Classification on Bank on the basis of function


১. কেন্দ্ৰীয় ব্যাংক (Central bank): যে ব্যাংক সরকারি মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে থেকে সরকার ও অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংকার, দেশের মুদ্রাবাজারের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক এবং সর্বোপরি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের আর্থিক নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে। এ ব্যাংক দেশের একক ও অনন্য ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। প্রতিটা স্বাধীন দেশে একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ এ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২. বাণিজ্যিক ব্যাংক (Commercial bank): মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে ব্যাংক স্বল্পসুদে জনগণের অর্থ আমানত হিসাবে জমা রাখে, অধিক সুদে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়, গ্রাহকদের পক্ষে অর্থ আদায়, পরিশোধ, স্থানান্তরসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদান করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। সাধারণভাবে ব্যাংক বলতে বাণিজ্যিক ব্যাংককেই বুঝায়। সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড আমাদের দেশে এ জাতীয় ব্যাংকের উদাহরণ।

৩. বিশেষায়িত ব্যাংক (Specialised bank): যে সকল ব্যাংক গ্রাহকদের প্রয়োজন ও অর্থনীতির বিশেষ কোনো দিকে নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে বিশেষায়িত ব্যাংক বলে। নিম্নে এ ধরনের ব্যাংকসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

i. কৃষি ব্যাংক (Agricultural bank): দেশের কৃষিখাত উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষকদের অর্থসংস্থানের জন্য যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে কৃষি ব্যাংক বলে। এটি একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার কাজ হলো কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ ইত্যাদি ক্রয়ে প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করা। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এ লক্ষ্যেই গঠিত ও পরিচালিত এ দেশের দু'টি উল্লেখযোগ্য ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। 

. শিল্প ব্যাংক (Industrial bank): শিল্প ব্যাংকও একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। দেশের শিল্পখাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংককে শিল্প ব্যাংক বলে। এ ব্যাংকের মূল কাজ হলো শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি ও সেই সাথে প্রয়োজনীয় স্বল্পমেয়াদি ঋণদান, শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয়ে সহযোগিতা ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করা। বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক লিমিটেড (BDBL) বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংকের উদাহরণ।

৩. সঞ্চয়ী বা আমানত ব্যাংক (Savings or desposit bank): জনগণের নিকট পড়ে থাকা বিক্ষিপ্ত সঞ্চয়গুলোকে আমানত হিসেবে সংগ্রহ করে মূলধন গঠনের লক্ষ্যে যে ব্যাংক কাজ করে তাকে সঞ্চয়ী বা আমানত ব্যাংক বলে। এ ধরনের ব্যাংক জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে এবং বিভিন্ন আকর্ষণীয় আমানত প্রকল্প গ্রহণ করে তাতে অর্থ জমা করতে উৎসাহ দেয়। আমাদের দেশে ‘ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক’ এরূপ উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি ব্যাংক।

iv. বিনিয়োগ ব্যাংক (Investment bank): দেশের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সরবরাহের লক্ষ্যে যে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে বিনিয়োগ ব্যাংক বলে। এরূপ ব্যাংক ঋণদান ছাড়াও নতুন কোম্পানি বা শিল্প প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতার উদ্দেশ্যে অবলেখক ও দায়গ্রাহকের ভূমিকা পালন করে। এ জন্য শেয়ার বিক্রয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পাশাপাশি প্রয়োজনে নিজেও প্রচুর শেয়ার ক্রয় করতে পারে। ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (ICB) এদেশে এরূপ প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ।

v. মিশ্র ব্যাংক (Mixed bank): যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একই সাথে জনগণের আমানত গ্রহণ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর ও বিভিন্ন লাভজনক খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হয় তাকে মিশ্র ব্যাংকিং বলে। মিশ্র ব্যাংকিং মূলত আমানত ব্যাংকিং এবং বিনিয়োগ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সম্মিলিত রূপ। বাংলাদেশে বর্তমানে জনগণের বিভিন্নমুখী ব্যাংকিং চাহিদা পূরণের জন্য কার্যত মিশ্র ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে।

vi. সমবায় ব্যাংক (Co-operative bank): সমবায়ের ভিত্তিতে সমবায় আইনের আওতায় গঠিত ও পরিচালিত যে ব্যাংক সমিতির সদস্যদের অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য তাদেরকে স্বল্পসুদে ঋণ দেয় এবং সদস্যদের বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় আমানতস্বরূপ গ্রহণ করে মূলধন গঠন করে তাকে সমবায় ব্যাংক বলে। এ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো সদস্যদের আর্থিক কল্যাণ; মুনাফা অর্জন নয়। এরূপ ব্যাংক সাধারণত অতালিকাভুক্ত হয়। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লি : এ দেশে এরূপ ব্যাংকের উদাহরণ।

৪. অন্যান্য ব্যাংক (Other banks): উপরোক্ত বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক ছাড়াও এমন কিছু ব্যাংক রয়েছে যারা বিভিন্ন পরিসরে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। নিম্নে সংক্ষেপে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

i. দেশীয় ব্যাংক (Indigenous bank): আধুনিক ব্যাংক ব্যবসায় শুরুর পূর্বে পৃথিবীর দেশে দেশে মহাজন শ্রেণি ও বেনিয়াগোষ্ঠী চড়াসুদে ঋণের ব্যবসায়ে নিয়োজিত থাকতো। বর্তমানেও কম-বেশি এ ধরনের গোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। যাদেরকে দেশীয় ব্যাংক নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এরা সাধারণত আমানত সংগ্রহ করে না তবে নিজস্ব তহবিল হতে চড়া সুদে ঋণ দেয়।

ii. আঞ্চলিক ব্যাংক (Regional bank): বিশ্বের বিশেষ কোনো অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আঞ্চলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংককে আঞ্চলিক ব্যাংক বলে। এ ব্যাংক সদস্য দেশগুলোর বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থের সংস্থান করে থাকে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) এ ধরনের ব্যাংকের উদাহরণ।

iii. গোষ্ঠী উন্নয়ন ব্যাংক (Community development bank): যে ব্যাংক কোনো সমাজ, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত হয় তাকে গোষ্ঠী উন্নয়ন ব্যাংক বলে। আনসার-ভিডিপি ব্যাংক ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (IDB) এর উদাহরণ।

iv. আন্তর্জাতিক ব্যাংক (International bank): জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আঞ্চলিক সংস্থা কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে আন্তর্জাতিক ব্যাংক বলে। বিশ্বব্যাংক (World Bank) এ ধরনের একটি ব্যাংক।

সংগঠন কাঠামো ভিত্তিক ব্যাংকের শ্রেণিবিভাগ |Classification of Bank on the basis of organisation structure


১. একক ব্যাংক (Unit bank): যে ব্যাংক কেবলমাত্র একটি অফিসের মাধ্যমে তার সকল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে একক ব্যাংক বলে। এ ব্যাংকের একটি অফিস ছাড়া অন্য কোথাও কোনো শাখা থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ ব্যাংক একক ব্যাংক। তাই একে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থাও বলে । তবে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ব্যাংক নেই।

২. শাখা ব্যাংক (Branch bank): যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি কেন্দ্রীয় অফিসের অধীনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে একই নামে অনেকগুলো শাখা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয় তাকে শাখা ব্যাংক বা ব্যাংকিং বলে। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে শাখা ব্যাংক ব্যবস্থার আওতাধীন।

৩. চেইন ব্যাংক (Chain bank): যে ব্যাংক ব্যবস্থায় একই শ্রেণিভুক্ত কতিপয় ব্যাংক তাদের স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে চেইন ব্যাংক বলে। এ ব্যবস্থায় সমজাতীয় কতকগুলো ব্যাংক একই পরিবার, ব্যক্তিবর্গ বা সমমনা ব্যক্তিবর্গের অধীনে পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এরূপ ব্যাংক ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

৪. গ্রুপ ব্যাংক (Group bank): যে ব্যাংক ব্যবস্থায় কোনো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান একই ধরনের কতকগুলো ছোট ব্যাংক গঠন করে বা একাধিক ব্যাংকের অধিকাংশ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে সমন্বিত ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে গ্রুপ ব্যাংক বা ব্যাংকিং বলে। এ ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে হোল্ডিং কোম্পানি এবং যাদের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করা হয় তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলে।

তালিকাভুক্তির ভিত্তিতে ব্যাংকের শ্রেণিবিভাগ |Classification of Bank on the basis of scheduling


১. তালিকাভুক্ত ব্যাংক (Scheduled bank): দেশের অভ্যন্তরে কর্মরত যে সকল ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংরক্ষিত তালিকার অন্তর্ভুক্ত থেকে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলে। এরূপ তালিকাভুক্তির জন্য সদস্য ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশিত শর্তাবলি পূরণ ও তা অনুসরণ করতে হয় । সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড ইত্যাদি এ দেশের তালিকাভুক্ত ব্যাংকের উদাহরণ।

২. অতালিকাভুক্ত ব্যাংক (Non-scheduled bank): যে ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত না হয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে অতালিকাভুক্ত ব্যাংক বলে। এ ধরনের ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত কোন সুবিধা পায় না। অধুনা বাংলাদেশে সমবায়ভিত্তিক এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নামের সাথে ‘ব্যাংক' শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড, আনাসার ভিডিপি ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংক।

গ্রাহক সেবার ভিত্তিতে ব্যাংকের শ্রেণিবিভাগ| Classification on the basis of customer service Bank 


আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার গ্রাহক সেবা প্রদানে ভিন্নতার সৃষ্টি করেছে। এর ভিত্তিতে ব্যাংক নিম্নোক্ত দু'ধরনের:

১. পাইকারি ব্যাংক (Wholesale bank): বড় ধরনের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহকে অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য ও উচ্চপ্রযুক্তির ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য যে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাকে পাইকারি ব্যাংক বলে। বৃহদায়তন সরকারি সংস্থা এবং দেশি-বিদেশি ও বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ব্যাংকের গ্রাহক। এ সকল প্রতিষ্ঠানের নগদান ব্যবস্থাপনা, দ্রুত দেনা-পাওনা নিষ্পত্তি, অর্থ আদায় ও পরিশোধ এবং তথ্য সরবরাহ এরূপ ব্যাংকের কাজ। আমাদের দেশে এ ধরনের ব্যাংক নেই।

২. খুচরা ব্যাংক (Retail bank): খুচরা গ্রাহক অর্থাৎ ব্যক্তি গ্রাহক এবং বিভিন্ন সাধারণ ব্যবসায়ী ও অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে যে সকল ব্যাংক ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে তাকে খুচরা ব্যাংক বলে। আমানত সংগ্রহ, অর্থ উত্তোলনের সুযোগ প্রদান, অর্থ সংগ্রহ, অর্থ পরিশোধ, ঋণদান, ক্রেডিট কার্ড সরবরাহ ইত্যাদি ধরনের ব্যাংকের কাজ। বাংলাদেশে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকই কার্যত এ ধরনের ব্যাংক হিসেবে গণ্য।

vii. বিনিময় ব্যাংক (Exchange bank): বৈদেশিক ব্যবসায়ে অর্থসংস্থান এবং বৈদেশিক বিনিময় ও লেনদেন নিষ্পত্তিতে সহায়তা করার জন্য যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে বিনিময় ব্যাংক বলে। এরূপ ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসায়ে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়, প্রত্যয়পত্র ইস্যু করে ও বিনিময় হার নির্ধারণপূর্বক বৈদেশিক দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে পৃথক কোনো বিনিময় ব্যাংক নেই । তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বিনিময় শাখা এ দায়িত্ব পালন করে।

viii. মার্চেন্ট ব্যাংক (Merchant bank): বিনিময় ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ ব্যাংকিং এর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা ব্যাংককেই মার্চেন্ট ব্যাংক বলে। বৈদেশিক বাণিজ্যে এরা গ্রাহকদের পক্ষে প্রত্যয়পত্র ইস্যু, রপ্তানিকারক কর্তৃক উত্থাপিত বিলে স্বীকৃতি দান ও বিলের অর্থ পরিশোধ করে। এরূপ ব্যাংক বিদেশ হতে পণ্য বা যন্ত্রপাতি ক্রয় করে ভাড়া ক্রয় বা কিস্তিবন্দিতে ক্রয় পদ্ধতিতে তা গ্রাহকদের সরবরাহ করে। এরূপ ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয়, যৌথ উদ্যোগে অর্থ বিনিয়োগ করে এবং অবলেখকের দায়িত্ব পালন করে থাকে।

ix. আমদানি-রপ্তানি ব্যাংক (Import-export bank): বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান ও সহায়তার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত ব্যাংককে আমদানি-রপ্তানি ব্যাংক বলে। এই ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানিধর্মী প্রতিষ্ঠানে ঋণদান, বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রত্যয়পত্র ইস্যু, বৈদেশিক বিনিময় বিলে স্বীকৃতি প্রদান এবং লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে। আমাদের দেশে কার্যত এ ধরনের ব্যাংক নেই তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ অনেকাংশে এ দায়িত পালন করে।

x. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যাংক (Small and cottage industries bank): দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে আর্থিক সাহায্য ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য গঠিত বিশেষায়িত ব্যাংককে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যংক বলে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য প্রোফাইল তৈরি, মূল্যায়ন এবং দীর্ঘ ও মধ্যম মেয়াদে ঋণ মঞ্জুর করা এ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যাংক (BASIC) এরূপ ব্যাংকের উদাহরণ।

xi. কর্মসংস্থান ব্যাংক (Employment bank): বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ঋণ সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত ব্যাংককে কর্মসংস্থান ব্যাংক বলে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও বেকার সমস্যা দূর করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এরূপ ব্যাংকের উদ্দেশ্য। 'কর্মসংস্থান ব্যাংক' বাংলাদেশে এ ধরনের একটা বিশেষায়িত ব্যাংক।

xii. গৃহসংস্থান ব্যাংক (Housing bank): শহর এলাকায় যে প্রকট আবাসন সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তা দূর করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে গৃহসংস্থান ব্যাংক বলে। বাড়ি নির্মাণ, সংস্কার, ফ্ল্যাট ক্রয় ইত্যাদি খাতে এ ধরনের ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করে এবং মাসিক কিস্তিতে উক্ত অর্থ আদায় করে থাকে। বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (HBFC) আমাদের দেশে এ ধরনের একটা প্রতিষ্ঠান।

xiii. ভোক্তা ব্যাংক (Consumer bank): ভোক্তা সাধারণকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ে সাহায্য করার জন্য গঠিত বিশেষায়িত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে ভোক্তা ব্যাংক বলে। এরূপ ব্যাংক ক্রেতাসাধারণের সুবিধার্থে ক্রেডিট কার্ড (Credit card) ইস্যু করে। যার মাধ্যমে সহজে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করা যায়। এ ছাড়া এরূপ ব্যাংক বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য; যেমন, ফ্রিজ, টিভি, গাড়ি ইত্যাদি সামগ্রী কিস্তির ভিত্তিতে সরবরাহ করে। বাংলাদেশ বিশেষায়িত এরূপ ব্যাংক নেই।

xiv. পরিবহন ব্যাংক (Transportation bank): দেশের পরিবহন খাতকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকই হলো পরিবহন ব্যাংক। যানবাহন নির্মাণ, আমদানি, ক্রয়, মেরামত, খুচরা যন্ত্রপাতি ক্রয় ইত্যাদি খাতে ঋণ দেয়ার জন্য এ ধরনের ব্যাংক গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের বিশেষায়িত ব্যাংক নেই৷

xv. বন্ধকী ব্যাংক (Mortgage bank): ভূমি অথবা স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে যে ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে ঋণ প্রদান করে তাকে বন্ধকী ব্যাংক বলে। যে ব্যাংক শুধুমাত্র ভূমি বন্ধক রেখে ঋণ দেয় তাকে ভূমি বন্ধকী ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। এরূপ ব্যাংক সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয় । তবে অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে স্বল্পমেয়াদি ঋণও দিতে পারে।

xvi. গ্রামীণ ব্যাংক (Grameen bank): গ্রামের জনগণকে ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে এক মহতী উদ্যোগই হলো গ্রামীণ ব্যাংক। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিক ড. মো. ইউনূস এরূপ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এরূপ ব্যাংক গ্রাম পর্যায়ে সদস্যদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি এবং তাদের নিকট থেকে সাপ্তাহিক সঞ্চয় সংগ্রহ করে। জমা একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছলে কোনো বৈষয়িক জামানত ছাড়াই সদস্যদের ঋণ দেয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url