প্রত্যক্ষ সেবার ধারণা, বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ| Direct Service concept, types and features

প্রত্যক্ষ সেবার ধারণা | Concept of Direct Service


আমাদের অভিভাবক ও পরিচিতজনরা বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিয়োজিত। অনেকের বাবা চিকিৎসক, মা আইনজীবী। আবার, কারো ভাই বা চাচার পরিবহন বা প্রকাশনীর ব্যবসায় আছে। এছাড়া অনেকের লন্ড্রি, সেলুন ও বিউটি পার্লারের দোকান থাকতে পারে। এ ধরনের পেশাগুলো সরাসরি সেবা দেওয়ার সাথে জড়িত। এগুলো বৈধ অর্থনৈতিক কাজ। এগুলোর মাধ্যমে মুনাফা লাভের আশায় সরাসরি সেবা দেওয়া হয়। তাই এ কাজগুলোকে প্রত্যক্ষ সেবা বলা হয়।

এক ব্যক্তি ৭০ টাকা দিয়ে সেলুনে গিয়ে চুল কাটালো। সে এই ৭০ টাকার বিনিময়ে কী পেয়েছে? নিশ্চয় উপকার বা সুবিধা। এভাবে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে গ্রাহকদের সরাসরি কোনো কাজ করে দেওয়া, সুবিধা বা সন্তুষ্টি দেওয়ার সাথে জড়িত বৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে প্রত্যক্ষ সেবা বলে। বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করা, সন্তান লালন-পালন করার মতো সেবাকে ব্যবসায়িক কাজ বলা যায় না। কারণ এগুলো কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম নয়। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে অর্থ উপার্জনের আশা করা হয় না এবং এগুলো অর্থের মূল্যে পরিমাপযোগ্যও নয়। প্রত্যক্ষ সেবা হতে হলে তাতে অবশ্যই অর্থ উপার্জনের লক্ষ্য থাকতে হয় এবং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ক্ষেত্রের কাজ সম্পন্ন করতে হয়। ক্লিনিক ব্যবসায়, আইন ব্যবসায়, হিসাব বৃত্তি, প্রকৌশল ফার্ম প্রভৃতি প্রত্যক্ষ সেবার অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যক্ষ সেবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. প্রত্যক্ষ সেবা ব্যক্তি একা বা দলবদ্ধভাবে দিতে পারে।
২. এ ধরনের সেবার একটি থেকে অন্যটিকে সহজেই আলাদা করা যায়।
৩. এটি পরিবর্তনশীল এবং এর বিনিময় যোগ্যতা আছে।
৪. এটি অদৃশ্যমান ও অস্পর্শনীয় যা ধরা, ছোঁয়া বা দেখা যায় না।
৫. সেবাদানকারী থেকে এরূপ সেবা আলাদা করা যায় না।
৬. এতে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়।
৭. সাধারণত এটি একটি স্বাধীন পেশা।

প্রত্যক্ষ সেবা কাকে বলে?

অতএব, অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে ভোক্তা বা গ্রাহকের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণে সক্ষম কোনো কাজ, সুবিধা বা তৃপ্তি সরাসরি দেওয়াকে প্রত্যক্ষ সেবা বলে।
প্রত্যক্ষ সেবার ধারণা, বৈশিষ্ট্য প্রকারভেদ

প্রত্যক্ষ সেবার বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Direct Service


ভোক্তা বা গ্রাহকদের প্রয়োজন পূরণে সক্ষম এমন কাজ, সুবিধা বা তৃপ্তি সরাসরি দেওয়াকে প্রত্যক্ষ সেবা বলে । ব্যবসায়ের প্রত্যক্ষ সেবার যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা নিম্নরূপ:

১. অস্পর্শনীয় (Intangible): সেবা ধরা ছোঁয়া বা স্পর্শ করা যায় না। এর সুবিধা শুধু অনুভব করা যায়। গ্রহীতা এই সুবিধা পেলে উপকৃত হয়। যেমন: আমরা অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যাই। চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করে ব্যবস্থাপন দেন। চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে আমরা আরোগ্য লাভ করি। চিকিৎসকের দেওয়া। স্পর্শ করতে পারি না।

২. মালিকানা হস্তান্তরযোগ্য নয় (Non transferable ownership): সেবা বাস্তব বা দৃশ্যমান কোনো বস্তু না হওয়ায় এর মালিকানা হস্তান্তরের প্রশ্ন আসে না। যে ব্যক্তি সেবা নিয়ে সন্তুষ্টি লাভ করে, তা সে অন্যের কাছে বিক্রি করতে পারে না। তাই সেবার মালিকানা কখনো হস্তান্তর করা যায় না।

৩. সংরক্ষণযোগ্য নয় (Not storable): সেবা যখন প্রয়োজন হয় গ্রাহক ঐ সময় তা সেবাদানকারীর কাছ থেকে নিয়ে থাকেন। প্রয়োজনের আগে নিয়ে তা সংরক্ষণ করা যায় না। চিকিৎসকগণ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য সব ব্যবস্থা নিয়ে প্রস্তুত থাকেন। একজন রোগী যাওয়ার পর চিকিৎসকদের সেবা দেওয়ার সুযোগ আসে। রোগী কখনোই এ সেবা চিকিৎসকের কাছে থেকে নিয়ে জমা রাখতে পারেন না। 

৪. গ্রাহকের কাছাকাছি অবস্থান (Nearer to customer): বেশি সংখ্যক গ্রাহকের অবস্থান আছে এমন জায়গায় প্রত্যক্ষ সেবাকেন্দ্রগুলো গড়ে ওঠে। যেমন: আবাসিক এলাকায় সেলুন বা ক্লিনিক এবং বাণিজ্যিক এলাকায় কনসালটেন্সি ফার্ম বা অডিট ফার্ম গড়ে ওঠে।

৫. অবিচ্ছিন্নতা (Inseparable): সেবাকে সেবা প্রদানকারী থেকে আলাদা করা যায় না। অর্থাৎ, সেবা দেওয়ার সময় সেবাদানকারীকে উপস্থিত থাকতেই হয়। যেমন : রোগীকে সেবা দিতে হলে চিকিৎসকের উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। একইভাবে আইনি লড়াইয়ের জন্য আইনজীবীর উপস্থিতি আবশ্যক।

৬. দৃশ্যমান বস্তু সম্পৃক্ততা (Involvement of visible elements): সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃশ্যমান বস্তুর প্রয়োজন হতে পারে। যেমন- চিকিৎসা সেবার জন্য চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, তথ্য সেবার জন্য কম্পিউটার ও টেলিফোন, বণ্টন সংক্রান্ত সেবার জন্য যানবাহন প্রভৃতি।

৭. পরিবর্তনশীলতা (Variability): একজন সেবাদানকারীর প্রদত্ত সেবা সব সময় একই মানের না ও হতে পারে। যেমন- একজন চিকিৎসকের চিকিৎসা সেবা সকল রোগীর ক্ষেত্রে সমান হয় না। সেবাদানকারী ব্যক্তির মন মানসিকতা ও বিভিন্ন পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রত্যক্ষ সেবায় ভিন্নতা দেখা যায়।

প্রত্যক্ষ সেবার প্রকারভেদ | Classifications of Direct Service


মুনাফা লাভের আশায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব সম্পৃক্ততায় কোনো সেবা সরবরাহ বা বিক্রি করলে, তা প্রত্যক্ষ সেবা হিসেবে গণ্য হয় । এই সেবা অনেক ধরনের হতে পারে। যথা-

১. পেশাগত সেবা (Professional service): পৃথিবীতে অনেক পেশা আছে যেগুলোতে সরাসরি সেবা দেওয়া হয়। এসব ব্যবসায়ে কিছু পেশাগত নিয়ম-নীতি পালন করতে হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও এসব ব্যবসায় পরিচালনায় ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন ও সরকারের অনুমতি নিতে হয়। দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পেশাগত সেবার গুণগত মান উন্নত হয়। এক্ষেত্রে সেবাদানকারীর মানসিক অবস্থা ও যোগ্যতার ভিন্নতার কারণে সেবার মানেও পার্থক্য হয়ে থাকে। ডাক্তারি, শিক্ষকতা, কনসালটেন্সি, হিসাববৃত্তি বা অডিট ফার্ম, ওকালতি বা অ্যাটর্নি ফার্ম, প্রকৌশলী বা প্রকৌশল (Engineering) ফার্ম প্রভৃতি পেশাগত সেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত।

২. ব্যক্তিগত সেবা (Personal service): ব্যক্তিগতভাবে যে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করা হয়, তাকে ব্যক্তিগত সেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায় বলে। এ সেবা ব্যক্তির দক্ষতা এবং কৌশলের ওপর নির্ভরশীল। এতে ব্যক্তি যত বেশি যোগ্য ও দক্ষ হবেন, পেশার মানও তত উন্নত হবে। আমাদের দেশে এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক না হলেও কর্মদক্ষতা ও কাজের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। স্বর্ণকার, পেইন্টার, কার্পেন্টার, টেইলর, কামার, কুমার, নাপিত, মেরামতকর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান প্রভৃতি ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত সেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত।

৩. বণ্টন সংক্রান্ত সেবা (Distributive service): পণ্যদ্রব্য বণ্টনের মাধ্যমে বন্টন সংক্রান্ত সেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ের সেবা দেওয়া হয়। এক জায়গায় উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য পরিবহনের মাধ্যমে অন্য জায়গায় নেওয়া হয়। অর্থাৎ, ভোক্তারা যেখানে বসবাস করে, সেখানে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে সেবা দেয় বণ্টনসম্ভ্রান্ত সেবাদানকারী ব্যবসায়। খুচরা ব্যবসায়ী, পাইকার, এজেন্ট, ডিলার, পরিবেশক এ ধরনের ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। এছাড়া জলযান, সড়ক পরিবহন, আকাশ পরিবহন, রেল পরিবহন প্রভৃতি বণ্টন সংক্রান্ত সেবার আওতায় পড়ে। এরূপ ব্যবসায়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ী চূড়ান্ত ভোক্তা বা ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিয়ে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করেন।

৪. পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত সেবা (Merchandising service): এক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্য উৎপাদক বা আমদানিকারকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে চূড়ান্ত ভোক্তা বা সর্বশেষ ক্রেতার কাছে সরবরাহ করা হয়। মধ্যস্থব্যবসায়ীরা এরূপ পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত সেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। পণ্য সরবরাহকারীরা নির্দিষ্ট বাজারে ভোস্তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ ও সরবরাহের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করেন।

৫. তথ্য সংক্রান্ত সেবা (Informational service): দৈনন্দিন জীবনে অনেক বিষয়ে তথ্যের দরকার হয়। ব্যক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী বাজার, পণ্য, চাহিদা, ধর্ম, পরিবেশ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত তথ্য জানতে হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান তথ্য সরবরাহসংক্রান্ত সেবা দেয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, ই কমার্স, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ওয়েবসাইট, মাল্টিমিডিয়া প্রভৃতি এ ধরনের সেবা দেওয়ার সাথে জড়িত।

৬. শিক্ষা সেবা (Education service): প্রতিটি দেশেই শিক্ষা সেবা প্রত্যক্ষ সেবার একটি বড় খাত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ভর্তি কোচিং, একাডেমিক কোচিং, উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনে IELTS, TOEFL, GMAT প্রভৃতি বিষয়ের কোচিং এর মাধ্যমে শিক্ষা সেবা দেওয়া হচ্ছে।

৭. স্বাস্থ্য সেবা (Healthcare service): জনসাধারণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, প্যাথলোজিক্যাল সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল প্রভৃতির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

৮. ভোক্তা সেবা (Consumer service): ভোক্তাদেরকে সরাসরি এ ধরনের সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। যানবাহন, হোটেল-মোটেল, বিনোদনধর্মী প্রতিষ্ঠান, পর্যটন কেন্দ্র, নিরাপত্তা দানকারী প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন অপারেটর প্রভৃতিকে এ ধরনের প্রত্যক্ষ সেবাদানকারীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

সুতরাং, উল্লিখিত ব্যবসায়গুলো প্রত্যক্ষ সেবাধর্মী ব্যবসায়। সব ধরনের সেবামূলক ব্যবসায়ই কোনো না কোনোভাবে এগুলোর আওতায় পড়ে।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Anonymous
    Anonymous 02 May, 2023

    It was helpful for me

Add Comment
comment url