ব্যাংক ঋণ মঞ্জুরে বিবেচ্য বিষয়সমূহ
ব্যাংক বিভিন্ন খাতে তার তহবিল বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করার প্রয়াস পায়। এরূপ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণ বা আগামই মুখ্য। যথাযথ খাত বিবেচনা করে ঋণ মঞ্জুর করতে পারার ওপরই ব্যাংকের সাফল্য নির্ভরশীল। এ লক্ষ্যেই ব্যাংক ঋণ বা আগাম মঞ্জুরকালে রেখাচিত্রে উল্লেখ নিম্নোক্ত বিষয়াবলি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে:
১. কোম্পানি বিবেচনার বিষয়সমূহ
২. গ্ৰাহক বিবেচনা বিষয়সমূহ
কোম্পানি বিবেচনা (Company consideration)
ঋণ বা অগ্রিম মঞ্জুরকালে ব্যাংক তার নিজস্ব কতকগুলো নীতি বা বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে; যা নিম্নরূপ:
১. তারল্য (Liquidity): তারল্য বলতে চেকের প্রাপককে চাহিবামাত্র নগদে অর্থ প্রদান করার ক্ষমতাকে বুঝায়। ব্যাংক পরের অর্থে ব্যবসায় করে এবং উক্ত অর্থ কার্যত চাহিবামাত্র পরিশোধ্য। তাই ব্যাংককে অবশ্যই সতর্ক বিবেচনার মধ্য দিয়ে আমানতের একটা অংশ নগদে বা তরল সম্পদ আকারে সংরক্ষণ করতে হয়।
২. নিরাপত্তা (Safety): 'Safety first' এ কথাটি অগ্রিম প্রদানকালে ব্যাংককে অবশ্যই সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হয়। কারণ ব্যাংক অগ্রীমের অর্থ নিরাপদে আয়সমেত যথাসময়ে ফেরৎ না আসলে ব্যাংক এ অর্থ পুনরায় ঋণ দিতে পারে না। এটি ব্যাংকের ব্যবসায় ও সুনামের জন্য ক্ষতিকারক হয়।
৩. লাভজনকতা (Prfitability): আমানতের উপর ব্যাংক সাধারণভাবে সুদ বা লাভ প্রদান করে। তাই অর্থ যাতে অধিক আয় উপার্জনে কাজে লাগানো যায় অগ্রীম মঞ্জুরকালে ব্যাংককে তা অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এজন্য ব্যাংককে কম ঝুঁকিতে অধিক লাভ এমন খাত খুঁজে নিতে হয়।
৪. বৈচিত্র্যতা (Diversity): ঋণ বা অগ্রিম যদি মুষ্টিমেয় কয়েকটি খাতে এবং কতিপয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে তাহলে উক্ত খাত মার খেলে বা প্রতিষ্ঠান লোকসান করলে ব্যাংকের ঝুঁকির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ জন্য প্রদত্ত ঋণ বিভিন্ন খাতে, বহুসংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রদান করা উচিত।
৫. মেয়াদ মিশ্রণ (Period mix): অগ্রিম মঞ্জুরকালে একই মেয়াদে যেনো অতিরিক্ত ঋণ প্রদান না হয় সেদিকেও ব্যাংকের খেয়াল রাখা আবশ্যক। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হলে তারল্য সুরক্ষা সহজ হয় ও ঋণদানে গতিশীলতা বজায় থাকে। স্বল্পমেয়াদি ঋণকেও নানান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
৬. জামানত (Security): প্রদত্ত ঋণের অর্থ যথাসময়ে ফেরৎ পাওয়ার রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যাংক যা কিছু সংরক্ষণ করে তাকেই জামানত বলে। ব্যাংক এক্ষেত্রে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিকে জামিনদার হিসেবে গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়সমূহ প্রধানত নিম্নরূপ:
ক. অব্যক্তিক জামানতের ক্ষেত্রে:
i. জামানতের গ্রহণযোগ্যতা
ii. বিক্রয়যোগ্যতা
iii. সম্পত্তির মূল্য
iv. মূল্যের স্থিতিশীলতা
v. মালিকানার বৈধতা
vi. সম্পত্তির দায়মুক্ততা ইত্যাদি।
খ. ব্যক্তিক জামানতের ক্ষেত্রে:
i. জামিনদারের আর্থিক সামর্থ্য
ii. সততা
iii. সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি।
গ্রাহক বিবেচনা (Customer consideration)
একটা অগ্রীম আবেদন মঞ্জুরকালে ব্যাংক গ্রাহক সংক্রান্ত যে সকল বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তা নিম্নরূপ:
১. গ্রাহকের চরিত্র (Character of client): চরিত্র বলতে ঋণ আবেদনকারীর অতীত লেনদেনের রেকর্ড, ঋণ ফেরৎ দানের আগ্রহ নির্ভরশীলতার গুণ ও তার জবাবদিহিতার মানসিকতাকে বুঝায়। আবেদনকারীর এরূপ গুণ সম্পর্কে জানতে যেয়ে ব্যাংক তার অতীত আচরণের রেকর্ড সম্বলিত তথ্য ও মতামত বিশ্লেষণ করে।
২. গ্রাহকের যোগ্যতা (Capacity of client): এক্ষেত্রে আবেদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ ব্যবহারের ক্ষমতা আছে কি না তা বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক দক্ষতা ও যোগ্যতা, মুনাফাযোগ্যতা, ব্যবস্থাপনার মান, ব্যবস্থাপকের আন্তরিকতা, প্রতিষ্ঠানের ধরন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়।
৩. গ্রাহকের সম্পদ (Resources of client): ভাবী ঋণগ্রহীতার মূলধন বা সম্পদের পরিমাণও ঋণদানে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। ঋণ বিশ্লেষণে আবেদনকারীর নিজস্ব মূলধন ও ঋণের অনুপাত, ঋণ ও সম্পত্তির অনুপাত ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়। ঋণের তুলনায় মূলধন বা সম্পদ যথেষ্ট বেশি হলে তা ঋণ ফেরৎ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়।
৪. ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য (Purpose of taking advance): ঋণ মঞ্জুরকালে প্রার্থিত ঋণের উদ্দেশ্য বিবেচনা করা প্রয়োজন। উৎপাদনশীল ও লাভজনক খাতে ঋণ দেয়া উচিত। আবেদনকারী ব্যবসায়ের সুযোগ-সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য না ব্যবসায়ের পতন ঠেকানোর জন্য ঋণ নিচ্ছে তা বিবেচনা করা প্রয়োজন।
৫. ঋণ ফেরতের উৎস (Source of repayment): ঋণের অর্থ কিভাবে কোন উৎস থেকে ফেরৎ আসবে সেটিও ঋণদানকালে বিশেষভাবে বিবেচনাযোগ্য। ভোগ্যপণ্যের ঋণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের মাসিক আয়, শিল্প ঋণের ক্ষেত্রে আয় সম্ভবনা, বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে পণ্য বা সেবা বিক্রয় সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা আবশ্যক।
উপসংহারে বলা যায়, ঋণ বা আগাম প্রদান বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়ায় যথাযথ খাতে তা মঞ্জুর করতে পারার ওপর ব্যাংকের সাফল্য নির্ভর করে। এক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়াদি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে ঋণ দিলেই ব্যাংকের তা ফেরৎ পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়।