কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
প্রাচীনকাল হতে এই ব্যাংক ব্যবস্থার প্রচলন ঘটলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচলন বাণিজ্যিক ব্যাংকের উৎপত্তির অনেক পরে হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের পরে বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবস্থাকে একটি সুষম কাঠামোতে নিয়ে আসার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্ভব ঘটে। এর পূর্বে বিশ্বের অনেক দেশের বিখ্যাত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কিছু কার্যাবলি সম্পাদন করত। যেমন— নোট ইস্যু ও মুদ্রার প্রচলন।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে ‘“রিকস ব্যাংক অব সুইডেন”। ১৬৫৬ সালে বেসরকারি মালিকানায় ব্যাংকটি স্থাপিত হয়। ১৬৬৮ সালে ব্যাংকটি সরকারিকরণ করা হয়।
অতঃপর, ১৬৯৪ সালে যুক্তরাজ্যে “ব্যাংক অব ইংল্যান্ড” বিশ্বের দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিকে বিশ্বের প্রথম আধুনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রধর বলা হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এটি সরকারি ঋণ প্রদান ও সীমিত আকারে নোট প্রচলনের দায়িত্ব পালন করত। অতঃপর, ১৮৪৪ সালে সরকারি আইনের বলে এটি পূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মর্যাদা লাভ করে। এর দীর্ঘদিন পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থাপিত হয় ফ্রান্স ও জাপানে। ১৮০০ সালে ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক “দি ব্যাংক অব ফ্রান্স” প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই ব্যাংকটি ১৮৪৮ সালে সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় মর্যাদা লাভ করে এবং এককভাবে নোট ইস্যু করার অধিকার পায়। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক “ব্যাংক অব জাপান”। বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচলন শুরু হয়। যেমন- ১৮১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় “ব্যাংক অব নেদারল্যান্ডস” ১৮১৭ সালে “ন্যাশনাল ব্যাংক অব অস্ট্রিয়া” ও “ব্যাংক অব নরওয়ে” প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ১৮১৮ সালে “ন্যাশনাল ব্যাংক অব কোপেনহেগেন” (ন্যাশনাল ব্যাংক অব ডেনমার্ক) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫০ সালে “ব্যাংক অব বেলজিয়াম” ১৮৫৬ সালে “ব্যাংক অব স্পেন” এবং ১৮৬০ সালে “দি গস ব্যাংক” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শতাব্দীকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণযুগও বলে। এ সময়কালেই অধিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ আইন পাশ করে ১২ টি ব্যাংকের সমন্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এই সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য এবং অর্থনৈতিক অবস্থার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রায় সকল দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রাসেলস - এ “International finance conference” অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে যেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছিল না সেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলার সুপারিশ করা হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠনের সাড়া পড়ে।
পরবর্তী তিন দশকে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠিত হয়। অর্থাৎ ১৯২১ সাল হতে ১৯৪০ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১ সালে “সাউথ আফ্রিকান রিজার্ভ ব্যাংক” ১৯২৪ সালে “ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ হাঙ্গেরি” ব্যাংক অব পোলান্ড” গঠিত হয় এবং ১৯২৮ সালে “সেন্ট্রাল ব্যাংক অফ চায়না” এবং ১৯৩৫ সালে ব্যাংক অব কানাডা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় কালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মর্যাদা “Bank of Issue” হতে নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত হয়। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতীক বলে বিবেচিত হয়।
প্রতিটি দেশেই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি বড় নিয়ন্ত্রককারী সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পাক ভারতীয় উপমহাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূচনা হয় ঐ সময়কালেই। ১৯২০ সালে “দি ইমপেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া” আইন পাশ করে তিনটি প্রেসিডেন্সি ব্যাংকের সংযুক্তির মাধ্যমে ইমপেরিয়াল ব্যাংক সৃষ্টি করা হয়।
১৯২১ সালের ২৭ জানুয়ারি ইমপেরিয়াল ব্যাংকের জন্ম হয়। সে সময় একে সরকারি অর্থ জমা রাখার এক নিকাশ ঘর হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। অতঃপর ১৯২০ সালে দি ইমপেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া আইন সংশোধন করে ১৯৩৪ সালে “দি রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া আইন” পাশ করা হয়। এ আইন মোতাবেক ১৯৩৫ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংক “দি রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া” প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে, ১৯৩৫ সালের ১ এপ্রিল হতে ব্যাংকটি কাজ শুরু করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হবার পরে ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই তারিখে “দি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান” আইন পাশ করার মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে “স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান” প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হবার পরে রাষ্ট্রপতির ১২৭ আদেশ বলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রধান ব্যাংক “স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান” আঞ্চলিক অফিসের দায় ও সম্পদসমূহ নিয়ে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক “বাংলাদেশ ব্যাংক” গঠিত হয়।