বাংলাদেশে শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা | Problems and prospects of industry in Bangladesh

বাংলাদেশে শিল্পের উন্নয়নে সমস্যা | Problems in the development of Industry in Bangladesh

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে শিল্পনির্ভর হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে বড় আয়তনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে। তবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে এখনো পৌছায়নি। বাংলাদেশে শিল্পের উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হলো:

১. উন্নত প্রযুক্তির অভাব (Lack of modern technology): অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে এখনো পুরোনো যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ফলে বিদেশি প্রতিযোগীদের মতো মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয় না।

২. অদক্ষ ব্যবস্থাপনা (Inefficient management): দক্ষ ব্যবস্থাপনা হলো আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়ে লক্ষ্য অর্জনের প্রধান উপায়। ব্যবসায়ীকে সফল হতে হলে এ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু কিছু শিল্পে ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতায় ঘাটতি দেখা যায়। এজন্য এখনো অনেক শিল্প পিছিয়ে আছে।

৩. মূলধনজনিত সমস্যা (Capital related problem): যেকোনো ব্যবসায়েই প্রয়োজনমতো মূলধনের সংস্থান করা না গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা যায় না। বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তাদের চাহিদামতো অনেক সময় ঋণ দিতে পারে না। ফলে ব্যবসায়ীরা মূলধন সংকটে ভোগেন।

৪. দক্ষ উদ্যোক্টার অভাব (Lack of efficient entrepreneur): দেশের সব পর্যায়েই দক্ষ ও যোগ্য উদ্যোক্তা বা সংগঠকের অভাব আছে। অথচ উদ্যোক্তা হলেন ব্যবসায়ের নেতা। উদ্যোক্তাশ্রেণি গড়ে না ওঠায় এদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও ব্যবসায় সংগঠনগুলো সেগুলো কাজে লাগাতে পারছে না।

৫. ঝুঁকি গ্রহণে অনীহ্য (Uninterested to take risk): আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কাই হলো ঝুঁকি। শিল্প স্থাপন ও পরিচালনা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অসতর্ক বা অদক্ষতার কারণে লোকসানের আশঙ্কা থাকে। এ কারণে সহজে কেউ শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসে না।

৬. কাঁচামালের অভাব (Lack of raw materials): পণ্য উৎপাদনের মৌলিক উপাদানকে কাঁচামাল বলা হয়। বাংলাদেশে শিল্পের কাঁচামাল বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। যেমন- গার্মেন্টস শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান তুলা আমদানিকারক দেশ। এ শিল্পের অন্যান্য উপকরণের বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। তাই দেখা যায়, কাঁচামালের অভাব বাংলাদেশের শিল্পের জন্য বড় সমস্যা।

৭. রাজনৈতিক অবস্থা (Political condition): দেশের শিল্প-বাণিজ্য রাজনৈতিক অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকারি নীতির বারবার পরিবর্তন, শ্রম অসন্তোষ, ধর্মঘট প্রভৃতি দেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশে এই অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তবে অতীত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগছে।

৮. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা (Bureaucratic problem): সরকারি কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত বহু স্তরের শাসন ব্যবস্থাকে আমলাতন্ত্র বলা হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনায় সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও সহায়তা নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এসব কাজ সঠিকভাবে করা কঠিন হয়ে যায়।

৯. অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা (Infrastructural limitations): বর্তমানে দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। দেশে শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজন আরও প্রশস্ত ও অধিক পরিমাণে রাস্তাঘাট, বন্দর, সেতু প্রভৃতি।

পরিশেষে বলা যায়, উন্নত দেশগুলো শিল্পে উন্নতির মাধ্যমেই তাদের জাতীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করেছে। তবে উপরিউক্ত সমস্যার কারণে বাংলাদেশে এখনো শিল্প ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে শিল্পের সম্ভাবনা| Prospects of Industry in Bangladesh


অতীতে বাংলাদেশ শিল্পে খুব বেশি উন্নতি করতে না পারলেও বর্তমানে বিপুল সম্ভাবনা আছে। এর ক্ষেত্রগুলো হলো:

১. সরকারি নীতি (Government policy): সরকার শিল্পের পরিবেশবান্ধব বিকাশ ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের শিল্পায়নের গতিকে বেগবান করতে 'শিল্পনীতি ২০১৬' ঘোষণা করা হয়েছে। এ পদক্ষেপগুলোর ফলে দেশে দ্রুত বিভিন্ন ধরনের শিল্পের বিকাশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

২. সরকারি উদ্যোগ (Government initiative): দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ২০২১ সাল নাগাদ জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান ৪০ শতাংশে উন্নীত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এজন্য বিসিক এ বিটাক এর মাধ্যমে ব্যাপক হারে যুবক ও যুবমহিলাদের হাতে-কলমে বিভিন্ন ট্রেডে আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত ও শিল্পসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে শিল্প মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।

৩. বিশেষ খাতের উন্নয়ন (Development of special sectors): শিল্প খাতে উদ্যোক্তাবান্ধব নীতির ফলে নতুন নতুন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। চামড়া শিল্পের আধুনিকায়ন ও ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী নদীগুলো দূষণমুক্ত রাখতে সব ট্যানারি সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তর করা হয়েছে। জুতা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৬০ টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। উচ্চ অগ্রাধিকার খাতের শিল্প বিকাশ তথা সার, কাগজ, সিমেন্ট, চিনি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনে শিল্প মন্ত্রণালয় সর্বদা তৎপর।

৪. মূলধনের যোগান (Supply of capital): দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। সরকার এগুলোর প্রসারে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিল্প ঋণ বিতরণের চেষ্টা করছে। এছাড়া ব্যাংক সুদের হার ১ অঙ্কে নিয়ে আসছে। এতে শিল্প ক্ষেত্রে মূলধনের অভাব অনেকটাই কমে যাবে বলে আশা করা যায়।

৫. অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা (Establishing economic zone): সরকার আগামী ১৫ বছরে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চাচ্ছে। এসব অঞ্চল গড়ে উঠলে অন্তত ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া এসব এলাকায় শিল্প-কারখানা স্থাপন ও পরিচালনা অনেক সহজ হবে।

৬. ইপিজেড উন্নয়ন (Development of EPZs): দেশে রপ্তানিমুখী শিল্প স্থাপনে দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে ইপিজেড স্থাপন করা হয়েছে। এগুলোতে বিনিয়োগ এবং শিল্প স্থাপন ও পরিচালনায় বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। এসব ইপিজেড এ দিন দিন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে।

৭. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন (Development of communication system): দেশে নদীপথ, রেলপথ ও সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা দিন দিন উন্নত হচ্ছে। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে দক্ষিণ বঙ্গের সাথে যোগাযোগ আরও সহজ ও দ্রুত হবে। এতে সারাদেশে শিল্পের সুষম উন্নয়ন হবে বলে আশা করা যায়।

৮. শিল্পের অবদান বৃদ্ধি (Increasing the contribution of industry): বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে । শিল্পবিপ্লবের ৮০ বছরে ইংল্যান্ড জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করেছিল। সেই আলোকে বলা যায়, বাংলাদেশেও একটি ছোটখাটো শিল্পবিপ্লব হয়েছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে শিল্প খাতের অবদান ছিল ৬.০৬%। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান হচ্ছে ৩৪.৯৯%।

৯. শ্রমের উন্নয়ন (Development of labour): বাংলাদেশে সবক্ষেত্রেই বেশ সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায়। অপরদিকে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সুবাদে শ্রমিকরা বেশ দক্ষ হয়ে উঠছে। এই দক্ষ শ্রমিকদের বিভিন্ন শিল্পে নিয়োগ করা গেলে উৎপাদনের পরিমাণ ও মান আরও বাড়বে। এভাবে শিল্পে উন্নয়নের সম্ভাবনা বাড়ছে।

সুতরাং, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। এদেশে আছে বিপুল জনগোষ্ঠী ও সম্ভা শ্রম। বিপুল জনগোষ্ঠী পণ্যের বাজারে এবং সস্তা শ্রম উৎপাদনে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Anonymous
    Anonymous 01 February, 2024

    সন্তোষজনক

Add Comment
comment url