উৎপাদনের আওতা বা পরিধি | Scope of Production

উৎপাদন বলতে উপযোগ সৃষ্টি করাকে বুঝায়। উপযোগ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এসকল উপযোগ সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত কার্যক্রমই উৎপাদনের আওতা বা পরিধি হিসেবে গণ্য হয়। তাই বলা যায়, উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে যে সকল কার্যক্রম সম্পাদন করতে হয় তাদের সমষ্টিকে উৎপাদনের আওতা বলে। উৎপাদনের আওতা বা পরিধি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. উপযোগ সৃষ্টি (Creation of utility): মানুষ কোনো কিছু সৃষ্টি বা ধ্বংস করতে পারে না। তারা শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদকে ব্যবহার উপযোগী পণ্যে রূপান্তর করে মাত্র। এরূপ রূপান্তরের মাধ্যমে মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্য সৃষ্টি করাকেই উৎপাদন বলে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের উপযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যাদের অন্যতম হলো- রূপগত উপযোগ, সময়গত উপযোগ, স্থানগত উপযোগ, স্বগত উপযোগ, সেবাগত উপযোগ ইত্যাদি। এভাবে সৃষ্ট সকল প্রকার উপযোগই উৎপাদনের আওতাভুক্ত।

২. কারখানা পরিকল্পনা (Factory planning): উৎপাদন কার্যক্রম কোনো না কোনো কারখানায় সম্পাদিত হয়। তাই উৎপাদনের পূর্বে কারখানা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা আবশ্যক। কাঙ্ক্ষিত পণ্য যে কারখানায় উৎপাদিত হবে- তার প্রকৃতি, অবস্থান, ডিজাইন ইত্যাদি সম্পর্কিত পরিকল্পনাকে কারখানা পরিকল্পনা বলে। উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত কারখানা পরিকল্পনাও উৎপাদন কার্যক্রমের আওতাভুক্ত।

৩. উৎপাদন পরিকল্পনা (Production planning): ভোক্তাদের সন্তুষ্টিবিধানে যে পণ্য উৎপাদন করা হবে, তা কিভাবে উৎপাদন করা হবে, কখন উৎপাদন করা হবে, কত পরিমাণ উৎপাদন করা হবে ইত্যাদি বিষয়ে আগাম চিন্তা-ভাবনাকে উৎপাদন পরিকল্পনা বলে। এ পরিকল্পনা ছাড়া উৎপাদন কার্য পরিচালনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় । তাই উৎপাদন কার্য পরিচালনার পূর্বে উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা আবশ্যক। এরূপ উৎপাদন পরিকল্পনাও উৎপাদনের অন্যতম আওতাভুক্ত বিষয়।

৪. যন্ত্রপাতি নির্বাচন ও রক্ষণাবেক্ষণ (Selection and maintaining of equipment): উৎপাদনে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি নির্বাচন ও তা রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কার্যাবলিও উৎপাদনের আওতাভুক্ত। উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নির্বাচন, সংগ্রহ, স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে না হলে উৎপাদনকার্য দারুণভাবে ব্যাহত হয়। এ কারণে উৎপাদনের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের এ বিষয়টির দিকে অত্যাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হয়।

৫. উপকরণ সংগ্রহ (Collection of elements): অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ হতে উৎপাদনের উপকরণ চারটি। এগুলো হলো- ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন। এ সকল উপাদান সংগ্রহ সংক্রান্ত কার্যাবলিও উৎপাদনের আওতাভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। তাছাড়া সাধারণ দৃষ্টিকোণ হতে কাঁচামাল, শ্রমিক, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উপকরণগুলোও উৎপাদনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য হয়। এসকল উপাদান যথাসময়ে সংগৃহীত না হলে, উৎপাদন কার্য পরিচালনা করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।

৬. রূপান্তর প্রক্রিয়া (Convertion process): প্রকৃতি প্রদত্ত কাঁচামালকে রূপাত্তরের মাধ্যমেই পণ্য উৎপাদন করা হয়। এরূপ রূপান্তর প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত যাবতীয় কাজ উৎপাদনের আওতাভুক্ত। ঘনি হতে পণ্য উত্তোলন, সমূদ্র হতে মৎস ও অন্যান্য সামগ্রী উত্তোলন, বন হতে কাঠ ও মধু আহরণ ষ, কৃষি খামার হতে কাঁচামাল হিসেবে কৃষি পণ্য সংগ্রহ ইত্যাদি সকল বিষয় উৎপাদনের আওতাভুক্ত। 
উৎপাদনের পরিধি
৭. পণ্য নকশাকরণ (Product design): পণ্য নকশাকরণ পণ্য পরিকল্পনার একটি অংশ। পণ্যের আকার, ওজন, রং, মোড়ক ইত্যাদি বিষয় উৎপাদনের পূর্বেই ঠিক করাকে পণ্য নকশাকরণ বলে। পণ্যের প্রণীত নকশা অনুসারেই পণ্য উৎপাদন করা হয়। বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশে ভোক্তাদের আকৃষ্টকরণের ক্ষেত্রে পণ্যের নকশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পণ্য উৎপাদনের পূর্বেই নকশাকরণের কাজ সম্পাদিত হলেও তা উৎপাদনের আওতাভুক্ত।

৮. উৎপাদন পদ্ধতি নির্বাচন (Selection of production method): পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। এসকল পদ্ধতি হতে কোন পদ্ধতিতে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে সেটি নির্বাচন সংক্রান্ত কাজও উৎপাদনের আওতাধীন। সকল পণ্য একই পদ্ধতিতে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। পণ্যের প্রকৃতি স্থানের সংকুলান, প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি নানান কারণে উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। একারণে প্রতিষ্ঠানের সকল দিক বিবেচনায় সর্বোত্তম উৎপাদন পদ্ধতি নির্বাচন করা উচিত।

৯. মান নিয়ন্ত্রণ (Quality control): উৎপাদিত পণ্য পূর্বনির্ধারিত মান অনুযায়ী হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, বিচ্যুতি নির্ধারণ করা এবং প্রয়োজনে সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রমকেই মান নিয়ন্ত্রণ বলে। উৎপাদিত পণ্য যদি মানসম্মত না হয় তাহলে তা ক্রেতাদের মাঝে আস্থা অর্জন করতে পারে না। তখন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। তাই উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ উৎপাদনের আওধীন।

১০. উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ (Production control): মান নিয়ন্ত্রণের ন্যায় উৎপাদন নিয়ন্ত্রণও উৎপাদনের আওতাধীন। মান নিয়ন্ত্রণ পণ্য মানের সাথে সম্পর্কিত, অন্যদিকে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ পণ্য উৎপাদন কার্যক্রমের সাথে জড়িত। পূর্ব নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী সঠিক সংখ্যক পণ্য সঠিক সময়ে উৎপাদিত হচ্ছে কিনা তা দেখা এবং প্রয়োজনে সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হলো উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ। উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও উৎপাদনের আওতাধীন।

১১. মওজুদ নিয়ন্ত্রণ (Inventory control): উৎপাদনের জন্য কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী মওজুদ সংক্রান্ত কার্যাবলিও উৎপাদনের আওতাধীন। উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য দ্রব্য সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহারের কার্যক্রমকে মওজুদ নিয়ন্ত্রণ বলে। উৎপাদন কাজে ব্যবহার্য্য দ্রব্য-সামগ্রী সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় মুহূর্তে উপাদানসমূহের ঘটতি পড়তে পারে অন্যদিকে আবার অতিরিক্ত মওজুদের কারণে খরচও বৃদ্ধি পেতে পারে। 

১২. গবেষণা ও উন্নয়ন (Research & development): বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। প্রতিযোগিতার এ যুগে উন্নতমানের পণ্য ও সেবাদানের জন্য ব্যাপক গবেষণা ও উন্নয়নের প্রয়োজন। গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করা যায়, যা প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। পণ্য, পণ্য উৎপাদন পদ্ধতি, প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমও উৎপাদনের অন্তর্ভুক্ত।

১৩. কারখানা বিন্যাস (Factory layout): কারখানার অভ্যন্তরে যন্ত্রপাতি, পণ্য -সামগ্রী, কর্মীদের চলাচল ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিন্যাস করাকে কারখানা বিন্যাস বলে। কারখানা বিন্যাস সঠিক ও কাম্যমাত্রায় না হলে উৎপাদনকার্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এ কারণে উৎপাদনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাকে কারখানা বিন্যাসের দিকে কঠোরভাবে মনোনিবেশ করতে হয় । তাই বলা যায়, কারখানা বিন্যাসও উৎপাদন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।

১৪. উত্তম কারখানা পরিবেশ রক্ষা (Keeping proper factory environment): যে পরিবেশে উৎপাদন কার্য সঠিকভাবে সম্পাদিত হয় তাকে উত্তম কারখানা পরিবেশ বলে। কারখানার পরিবেশ যদি উৎপাদনবান্ধব না হয়, তাহলে সে পরিবেশ হতে কাঙ্ক্ষিতমানের পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই উৎপাদনের ক্ষেত্রে উত্তম কারখানা পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরূপ পরিবেশ রক্ষা করাও উৎপাদন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।

১৫. উৎপাদনকর্মীদের প্রশিক্ষণ (Training to the production workers): প্রশিক্ষণ যে কোনো কর্মীকে দক্ষ করে তোলে। দক্ষকর্মীদের উৎপাদশীলতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়, অন্যদিকে তেমনি পণ্যের মানও বৃদ্ধি পায়। এ কারণে উৎপাদনে নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষ করে তোলার জন্য প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এরূপ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও উৎপাদনের আওতাভুক্ত।

পরিশেষে বলা যায়, সাধারণ দৃষ্টিকোণ হতে উৎপাদন বলতে শুধুমাত্র রূপান্তর কার্যক্রমকে বুঝানো হলেও এর সাথে জড়িত অন্যান্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিষয়গুলোও উৎপাদনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় বলে বিবেচিত হয়। এ সকল বিষয় উৎপাদনের আওতাভুক্ত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url