রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ধারণা, বৈশিষ্ট্য উদ্দেশ্য, সুবিধা এবং অসুবিধা
রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও উদ্যোগে গঠিত হয়। আবার, ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে পরবর্তী সময়ে আংশিক বা সম্পূর্ণ জাতীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অন্যান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মতো মুনাফা অর্জন এ ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য নয়। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ, জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন ও জনগণের কল্যাণসাধন এ ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায়ও অনেক শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা-ভাবনা থেকে ব্যাংক, বিমাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করে। কিন্তু, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও ত্রুটির কারণে ইতোমধ্যে আবার অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিচে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:
সি. বি. গুপ্ত বলেন,
রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলতে ঐসব শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে বোঝায়, যেগুলোর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকা।
প্রফেসর এই হ্যানসন বলেন,
রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালনায় শিল্প-কৃষি আর্থিক ও বাণিজ্যিক কাজকে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে।
ওপরের আলোচনা ও সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করা যায়—
১. জনকল্যাণ রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মূল লক্ষ্য।
২. এ ব্যবসায় রাষ্ট্রের উদ্যোগে গঠিত হয়ে থাকে।
৩. ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো ব্যবসায় অধিগ্রহণ বা জাতীয়করণের মাধ্যমেও এ ব্যবসায় গঠিত হতে পারে।
৪. এ ব্যবসায় রাষ্ট্রের আংশিক বা সম্পূর্ণ মালিকানা থাকতে পারে।
৫. এ ব্যবসায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
৬. এ ব্যবসায়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য | Characteristics of State Enterprise
সরকার জনকল্যাণের লক্ষ্যে কিছু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গড়ে তোলে। তাই সব দেশেই রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যা নিচে আলোচনা করা হলো দেখা যায়। পৃথক ও ভিন্নধর্মী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে এরূপ ব্যবসায় দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। এ ব্যবসায় বৈশিষ্ট্য সমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:
১. রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত (Formed by the state): সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জাতীয়করণ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করার মাধ্যমেও রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় কোনো সংস্থা, শিল্প বা সম্পদ গঠিত হতে পারে। সরকারের বিশেষ আদেশ, রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ অথবা জাতীয় ব্যক্তি মালিকানা থেকে সরকারি সংসদে বিশেষ আইন পাসের দ্বারা এ ব্যবসায় গড়ে ওঠে। আবার, সরকারি ও মালিকানা নিরূপে নিয়ে আশ বেসরকারি যৌথ উদ্যোগেও এটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
২. রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ (Controlled by the state): এ ব্যবসায় পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হয়। সাধারণত রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ১০০% মালিকানা সরকারের হয়ে থাকে। তবে যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ে কমপক্ষে ৫১% শেয়ার সরকারের এবং সর্বোচ্চ ৪৯% শেয়ার বেসরকারি মালিকানায় থাকতে পারে। এক্ষেত্রে, ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণ আনুপাতিক হারে সরকারের হাতে থাকে। আর দায়ও একই হারে সরকার বহন করে।
৩. স্বায়তশাসন (Autonomous): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত হয়ে থাকে। বিশেষ অধ্যাদেশ ও আইনের মাধ্যমে এগুলো পরিচালিত হয় বলে এগুলোর স্বাধীন আইনগত পর্যায় থাকে।
৪. জনকল্যাণ (Public welfare): অধিকাংশ ব্যবসায়ের প্রধান লক্ষ্য মুনাফা অর্জন। তবে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মূল লক্ষ্য জনকল্যাগ। এ ব্যবসায়ের মাধ্যমে জনসাধারণের কল্যাণ ও সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ন্যায্যমূল্যে উন্নতমানের পণ্য ও সেবা সরবরাহ করাও এর অন্যতম লক্ষ্য।
৫. রাষ্ট্রীয় পরিচালনা (Operated by the state): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ভার সরকারের হাতে থাকে। এ ব্যবসায়ের ধরন অনুযায়ী সরকারি বিভাগীয় সংগঠনগুলো মন্ত্রণালয় বা সরকারি বিভাগের অধীনে থাকে। আবার, বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোও সরকার কর্তৃক নিযুক্ত নির্বাহী ও পরিচালনা পর্ষদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিচালক সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন ।
৬. বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান (Large scale organization): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সাধারণত বড় আকারের হয়ে থাকে। যেসব ক্ষেত্রে মুনাফার পরিমাণ কম অথবা বৃহৎ আকারের পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়, সেসব ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা সাধারণত বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেন না। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই বেশি দেখা যায়। যেমন: কেন্দ্রীয় ব্যাংক , বিমান সংস্থা, পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, রেলওয়ে, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রভৃতি।
৭. মূলধন সরবরাহ ও মুনাফা বণ্টন (Capital supply and profit distribution): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মোট পুঁজিকে সমান মূল্যের শেয়ারে ভাগ করা হয়। এসব শেয়ারের দায় লিখিত মূল্য (Face Value) দ্বারা সীমাবদ্ধ। সম্পূর্ণ শেয়ার সরকার কিনে নেওয়ায় জনগণকে কোনো দায় বহন করতে হয় না। এ ব্যবসায়ে অর্জিত মুনাফা সরকারি কোষাগারে জমা হয়। ক্ষতি হলেও তা সরকারকেই বহন করতে হয়।
৮. আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা (Bureaucratic management): আমলাতন্ত্র এমন এক শাসন ব্যবস্থা যাতে স্থায়ী সরকারি কর্মকর্তারা কয়েকটি স্তরে দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনার তার সরকারি কর্মকর্তা ও পরিচালিত কয়েক স্তর বিশিষ্ট কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত থাকে। সাধারণত সরকারি কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব শাসন ব্যবস্থ এর ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলে।
৯. চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual entity): এ ব্যবসায় পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মতো চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী। অনেক সময় জনগণের কল্যাণের দিক বিবেচনা করে লোকসান হওয়া সত্ত্বেও সরকার এ ব্যবসায় বন্ধ করে না। তাছাড়া, বড় আকারের ব্যবসায় হওয়ায় এগুলো বন্ধ করাও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।
অতএব, অন্যান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মতো রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়েরও কিছু ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ফলে ভিন্ন প্রকৃতির ব্যবসায় হিসেবে এটি অনেক ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয়।
রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের সুবিধাসমূহ | Advantages of State Enterprise
জাতীয় ব্যবসায়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন এবং জনগণের কল্যাণ। নিচে এর সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. আয়ের সুষম বণ্টন (Equitable distribution of income): ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত ব্যবসায়ে অর্জিত মুনাফা ব্যবসায়ীদের কাছে জমা হয়। এতে কিছু লোকের হাতে অধিকাংশ সম্পদ চলে যায়। ফলে সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় আয়ের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
২. জনকল্যাণ (Public welfare): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় মূলত জনকল্যাণের উদ্দেশ্যেই গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। জনকল্যাণমুখী বিভিন্ন খাত যেমন: ওয়াসা, রেলওয়ে, ডাক ও তার (বিটিসিএল) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। আর এরূপ ব্যবসায় সর্বদাই জনগণের কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
৩. একচেটিয়া ব্যবসায় রোধ (Prevention of monopoly business): একচেটিয়া ব্যবসায় চলতে থাকলে সাধারণ জনগণের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় ও ভোগান্তি বেড়ে যায়। এরূপ অবস্থা রোধে সরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে বাজারে প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ফলে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা পায়।
৪. জাতীয় নিরাপত্তা (National security): জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার লক্ষ্যে দেশরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মাধ্যমে প্রস্তুত ও বণ্টন করা হয়। এতে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় থাকে। এগুলো ব্যক্তি মালিকানায় থাকলে দেশ হুমকির মুখে পড়তে পারে।
৫. মূল্য স্তরের স্থিতিশীলতা (Stability in price level): পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতার ওপর দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে। এজন্য চাহিদা ও সরবরাহে সমতা বিধান, ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ এবং পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানায় টিসিবি - এর মতো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
৬. নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ (Continuous supply): অনেক অসাধু ব্যবসায়ীরা কখনো কখনো স্বেচ্ছায় পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এতে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় এক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করে। যেমন: টিসিবি - এর মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ সরবরাহ।
৭. কর্মসংস্থান সৃষ্টি (Creating employment): রাষ্ট্রীয়ভাবে নতুন নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়োগ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এ ব্যবসায়ে সামান্য কারণে কর্মী ছাঁটাই বা লে-অফ করা হয় না। এখানে কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
৮. ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ (Control of business): জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্টসহ কিছু ব্যবসায়ের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা একান্ত জরুরি। রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং এ সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করে সরকার এক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। এতে দেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় থাকে।
৯. প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা (Protection of natural resources): বেসরকারি খাতে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ছেড়ে দেওয়া হলে, সেগুলোর অপব্যবহারের আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই জনস্বার্থে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করা হয়। এতে দেশের সব মানুষ এর সুবিধা পায়। এভাবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
১০. ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য নিয়ন্ত্রণ (Control of risky product): এমন অনেক পণ্য আছে, যা ক্ষতিকারক অথচ ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজন হয়। যেমন: অ্যালকোহল, আফিম, প্যাথিড্রিন ইনজেকশন প্রভৃতি। এগুলো উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ জাতীয় স্বার্থেই অপরিহার্থ। রাষ্ট্রীয়ভাবে এরূপ পণ্য উৎপাদন ও বণ্টন করা হলে এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
১১. জাতীয় আয় বৃদ্ধি (Growth of national income): এ ধরনের ব্যবসায়ে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা থাকে না। এছাড়া এর অর্জিত মুনাফা সরাসরি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। আর জনগণের প্রয়োজনেই তা ব্যবহার করা হয়। ফলে জাতীয় আয় বাড়ে ও জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
১২. সংকট মোকাবেলা (Handling crisis): অর্থনৈতিক মন্দার সময় দেশের বেসরকারি খাতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা যায়। বিশেষত কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, বেকার সমস্যা বেড়ে যায়। এতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাজারে পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় এ ধরনের সংকট সহজে মোকাবেলা করতে পারে। প্রয়োজনে সরকার ভতুর্কি দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখে। এতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
১৩. গোপনীয়তা রক্ষা (Maintaining secrecy): ক্ষেত্রবিশেষে উৎপাদনে গোপনীয়তা রক্ষা জাতীয় স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। যেমন: বোর্ড / বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা, সমরাস্ত্র তৈরি প্রভৃতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ কাজগুলো করা হলে তাতে বেশি গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব হয়।
১৪. গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and development): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বড় আকারে গড়ে ওঠে এবং এর আর্থিক সামর্থ্য ভালো থাকে। ফলে এর গবেষণা ও উন্নয়নের সুযোগ বেশি থাকে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই এরূপ ব্যবসায়ের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।
সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় হলো রাষ্ট্র কর্তৃক গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। সরকারি বিভিন্ন সহায়তার কারণে এ ধরনের ব্যবসায় থেকে ওপরের সুবিধাগুলো পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের অসুবিধা | Disadvantages of State Enterprise
বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই ব্যবসায়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এরূপ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের প্রয়োজন সর্বত্র আছে কি না, তা প্রশ্নের বিষয়। এ ব্যবসায় যেসব সীমাবদ্ধতার কারণে সমালোচিত হচ্ছে তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. অদক্ষ ব্যবস্থাপনা (Inefficient management): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় পরিচালনার ভার অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ব্যক্তিদের ওপর ন্যস্ত থাকে। তাদের মানসিকতা, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প ব্যবস্থাপনার উপযোগী হয় না। ফলে এর ব্যবস্থাপনায় অনেক সময় অদক্ষতা দেখা দেয়।
২. লালফিতার দৌরাত্ম্য (Red tapism): এ ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তারা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে থাকেন। ফলে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনে সব কাজ আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে লালফিতার দৌরাত্ম্য বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হয়। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। এতে প্রাতিষ্ঠানিক কাজের গতি কমতে থাকে।
৩. অনবরত লোকসান (Continuous loss): এ ব্যবসায় অনেক ক্ষেত্রে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি বা সাহায্যে টিকে থাকে। অনবরত লোকসানের ফলে এ ব্যবসায় সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্মে।
৪. একচেটিয়া ব্যবসায় (Monopoly business): রাষ্ট্রীয় সহায়তায় এ ব্যবসায় কিছু ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ না থাকায় এর পণ্য ও সেবার মান সাধারণত নিম্নমুখী হয়। এতে উৎপাদন ব্যয় এবং পণ্যমূল্য বাড়ে। ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পাশাপাশি ভোক্তাদেরও ব্যয় বেড়ে যায়।
৫. নমনীয়তার অভাব (Lack of flexibility): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সরকারি নিয়ম-নীতিতে আবদ্ধ থাকে। তাই, পরিবর্তনশীল ব্যবসায় পরিবেশ এবং নতুন নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। এরূপ নমনীয়তার অভাবে এ ব্যবসায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না।
৬. দুর্নীতির আশঙ্কা (Fear of corruption): এ ব্যবসায়ের সাফল্যে নির্বাহীদের নিজস্ব কোনো স্বার্থ থাকে না। তাই কারো মধ্যে অনৈতিকভাবে স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা দেখা দিতে পারে। ফলে দুর্নীতির আশঙ্কা তৈরি হয়। এছাড়া, এ ব্যবসায় সরকারি আমলা ও নেতৃবৃন্দের স্বজনপ্রীতির ক্ষেত্র এমনকি রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হতে পারে।
৭. গোপনীয়তা ফাঁস (Leak of secrecy): আইনের অধীনে এরূপ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয় বলে সংসদে এর কার্যক্রম নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা হয়। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন সব সরকারি সংগঠনের কাজ নিয়েও সরাসরি আলোচনা করতে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ের গোপনীয়তা বজায় থাকে না।
৮. জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি (Increasing national liability): অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অপচয়, কর্তব্যে অবহেলা প্রভৃতি কারণে এরূপ ব্যবসায়ে ক্রমাগত লোকসান হতে থাকে। ফলে জাতীয় ঋণ রেড়ে যায়। এতে দেশ বেশি মাত্রায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যার দায় জনগণের ওপর বর্তায়। এজন্য করের হার ও করের ক্ষেত্র বাড়াতে হয়।
৯. নীতির পরিবর্তন (Change of policy): সরকার বা ঊর্ধ্বতন নির্বাহীর পরিবর্তনের সাথে সাথে এ ব্যবসায়ের নীতিরও পরিবর্তন হয়। ব্যবসায়ের নীতির এরূপ ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে এর অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় । ফলে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা ক্ষতি বাড়ে।
১০. অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ (Excessive control): কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ ব্যবসায়ের স্বার্থে অনেক সময় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা তাদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এতে সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
১১. বিলোপসাধনে সমস্যা (Problem of dissolution): রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বিলোপের সময় সংসদে ও জনসাধারণের মাঝে নানা কথা ওঠে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা হতে থাকে। এতে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক আন্দোলনের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে অলাভজনক ক্ষেত্রেও এটি বিলুপ্ত করা যায় না।
সুতরাং বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ে বিভিন্ন প্রকার অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে জনকল্যাণের স্বার্থে এবং দেশের সুষম উন্নয়নে এরূপ ব্যবসায় স্থাপন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালাতে হবে।
Too good