ট্রেডমার্ক আইনের ধারণা ও সুবিধা| Trademarks Act concept advantages
ট্রেডমার্ক আইনের ধারণা | Concept of Trademark Act
আমরা বিভিন্ন পণ্যের ওপর বা পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন বা লোগো দেখতে পাই। অনেক সময় লোগো বা নামের পাশে ‘TM’ বা ‘R’ লেখা দেখা যায়। মোবাইল প্রতিষ্ঠান বা এর পণ্যের সাতমা ফোন সেবার কথাই ধরা যাক। তিন পাখাওয়ালা আকাশি রঙের লোগো, যা গ্রামীণফোনের প্রকাশে ব্যবহৃত বিশেষ ঠিক, প্রতীক, শব্দ বা লোগো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কয়েকটি রঙের সমন্বয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রঙের ধাঁচে তৈরি লোগো, যা বাংলালিংক ব্যবহার করে।
আবার, পণ্যের মধ্যে ধরা যাক কোমল পানীয় এর বিষয়। কোকাকোলা, স্প্রাইট প্রভৃতি লেখার ধরন একটু ভিন্ন স্টাইলের। এগুলোর বোতলের গঠনেও (Shape) অন্য বোতলের তুলনায় ভিন্নতা দেখা যায়। উক্ত বিভিন্ন লোগো, লেখার ধরন, গঠন প্রভৃতি হলো ট্রেডমার্কের বহিঃপ্রকাশ।
ইংরেজি ‘Trademark’ শব্দটির বাংলা অর্থ হলো পণ্যদ্রব্যের ওপর এর উৎপাদকের পরিচয়সূচক সংকেত বা চিহ্ন। ট্রেডমার্ক বা ব্যবসায় স্বত্ব হলো একটি চিহ্ন বা প্রতীক। এটি দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবাকে এর সমজাতীয় পণ্য বা সেবা থেকে পৃথক করা যায়।
সাধারণত পণ্যের মোড়কের গায়ে বা অন্যান্য কাগজপত্রে ট্রেডমার্ক অধিকত থাকে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায়ও এটি দেখা যায়। ট্রেডমার্ক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেওয়া হয়, যা নবায়নযোগ্য। ট্রেডমার্ক প্রকাশ করার জন্য সাধারণত নিচের প্রতীকগুলো ব্যবহার করা হয়:
১. ® একটি বৃত্তের মাঝে R, যার অর্থ হলো এটি যথাযথ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত ও নিবন্ধিত ট্রেডমার্ক।
২. TM ইংরেজি অক্ষর TM বা Trade Mark হলো অনিবন্ধিত (রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি এমন) ট্রেডমার্ক - এর প্রতীক। এটি কোনো পণ্য বা ব্র্যান্ডকে মানুষের সাথে পরিচিত করানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
৩. SM ইংরেজি SM বা ‘Service Mark’। সেবা সংশ্লিষ্ট কোনো পণ্য বা ব্র্যান্ডকে মানুষের সাথে পরিচিত করানোর কাজে এটি ব্যবহৃত হয়। সার্ভিস মার্ক নিবন্ধিত হয়ে গেলে সেটিকেও ® চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়।
ট্রেডমার্ক সাধারণত কোনো ছবি, বর্ণ, অক্ষর অথবা প্রতীক হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, উইন্ডোজ লোগো মার্কিন সফটওয়্যার নির্মাতা মাইক্রোসফটের ট্রেডমার্ক। বিশ্বে সর্বপ্রথম ইতালিতে রোমান রাজা ট্রেডমার্ক ব্যবহার করেন বলে মনে করা হয়।
১৮৫৭ সালে সর্বপ্রথম ফ্রান্সে ও ১৮৬২ সালে যুক্তরাজ্যে ট্রেডমার্ক আইন পাস হয়। উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৪০ সালে ট্রেডমার্ক আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ট্রেডমার্ক আইন -২০০১’। ট্রেডমার্ক বলতে ডিভাইস (Device), ব্র্যান্ড (Brand), শিরোনাম (Heading), লেবেল (Label), টিকেট, নাম, স্বাক্ষর, শব্দ, অক্ষর, সংখ্যাযুক্ত উপাদান, রঙের সমন্বয় বা এগুলোর যেকোনো রূপ সমন্বয়কে বোঝায়। তবে পণ্য মোড়ক ট্রেডমার্কের অন্তর্ভুক্ত নয়। রেজিস্ট্রিকৃত ট্রেডমার্কের অধিকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উক্ত ট্রেডমার্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র বা একচেটিয়া অধিকার লাভ করে।
অতএব, কোনো প্রতিষ্ঠান বা এর পণ্যের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করার জন্য যে বিশেষ চিহ্ন, প্রতীক, শব্দ বা লোগো ব্যবহার করা হয়, তাকে ট্রেডমার্ক বলে।
ট্রেডমার্ক এর সুবিধা | Advantages of Trademark
ট্রেডমার্ক মূলত সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবাকে আলাদা করে বোঝানোর জন্যই ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মালিক, ক্রেতা ও বিক্রেতা সবাই নিম্নোক্ত বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ও সুবিধা পেয়ে থাকে:
১. ব্র্যান্ড আনুগত্য সৃষ্টি (Creating brand loyalty): কোনো পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে ট্রেডমার্ক বা পণ্য প্রতীক ব্যবহার করা হলে তা দ্রুত ক্রেতা ও ভোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা উক্ত প্রতীক তথা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাশীল হন । ফলে উক্ত ট্রেডমার্ক সংবলিত অন্যান্য পণ্যও তারা নির্দ্বিধায় কিনে থাকেন । যেমন : স্কয়ার, প্রাণ, কিশোয়ান, বনফুল, ফ্রেশ, তীর, এসিআই, আরএফএল, ওয়ালটন প্রভৃতি কোম্পানির প্রতি আস্থার কারণে এদের যেকোনো পণ্য গ্রাহকরা সহজেই কিনে থাকেন।
২. সহজ পরিচিতি (Easy to introduce): আকর্ষণীয় বা নজরকাড়া ডিজাইনের ট্রেডমার্ক ব্যবহার করতে পারলে তা সহজেই পরিচিতি লাভ করে। সকল শ্রেণির ক্রেতা ও ভোক্তাগণ একে মনে রাখে এবং পণ্যের গায়ে এটি দেখে। সহজেই তা চিনতে পারে। এভাবে পণ্যের সহজ পরিচিতি অর্জন সম্ভব হয়।
৩. একচেটিয়া অধিকার (Monopoly right): ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের সুবাদে মালিক বা ব্যবসায়ী কোনো নাম ব্যবহারে একচেটিয়া অধিকার লাভ করতে পারে। যেমন- প্রাণ জুস, প্রাণ চানাচুর, প্রাণ গুঁড়া মশলা, প্রাণ গুঁড়া দুধ প্রভৃতি তাদের প্রাণ নামের সুবাদে সহজে পরিচিতি লাভ করছে এবং ব্যবসায়িকভাবে সফলও হয়েছে । এসব নামে অন্য কেউ নিবন্ধন করতে পারবে না।
৪. স্বাতন্ত্র্য ও সুনাম সৃষ্টি (Creating uniqueness and goodwill): ট্রেডমার্ক - এর সুবাদে সমজাতীয় বহুসংখ্যক পণ্য হতে ভোক্তা বা ক্রেতা খুব সহজেই তার পছন্দের পণ্য বাছাই করতে পারেন। এভাবে পণ্য পৃথককরণ কাজ অনেক সহজ হয় ও পণ্যের স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হয়। এতে উক্ত পণ্যের ব্যবসায়িক সুনাম বাড়ে।
৫. ক্রয় - বিক্রয়ে সহায়তা (Assistance to purchase and sales): ট্রেডমার্ক - এর কারণে জনসাধারণের মনে ব্র্যান্ড আনুগত্য (Brand loyalty) তৈরি হয়। ফলে উক্ত পণ্য বিক্রেতা সহজেই নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রি করতে পারেন। এক্ষেত্রে ক্রেতাসাধারণকে বেশি বোঝানো বা অনুপ্রাণিত করতে হয় না। ক্রেতাগণ কোনো ব্র্যান্ডের লোগো তথা ট্রেডমার্ক দেখে তা ভালো ও মানসম্মত পণ্য মনে করে সহজেই তা কিনতে পারেন।
৬. ক্রেতার স্বার্থরক্ষা (Protect the right of buyer): ট্রেডমার্কযুক্ত পণ্য ব্যবহারে ক্রেতার সুরক্ষা বা স্বার্থরক্ষা হয়ে থাকে। ক্রয়কৃত ট্রেডমার্কযুক্ত কোনো পণ্য নষ্ট বা খারাপ বা ব্যবহারের অযোগ্য হলে ক্রেতা আইনি সুবিধা পেতে পারে। তাছাড়া ওয়ারেন্টি / গ্যারান্টির সুবাদে পণ্য পরিবর্তন বা মেরামতের সুযোগও ক্রেতা পেয়ে থাকেন।
৭. নকল প্রতিরোধ (Protect piracy): ট্রেডমার্ক প্রতিষ্ঠিত হলে এবং তা রেজিস্ট্রেশন করা থাকলে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী উক্ত পণ্য বা লোগো ব্যবহার করে ব্যবসায়িক সুবিধা নিতে পারে না। এক্ষেত্রে মূল মালিক আইনি সহায়তা নিতে পারে। এভাবে ট্রেডমার্ক - এর সুবাদে পণ্যের নকল প্রতিরোধ করা যায়।
৮. প্রচারগত সুবিধা (Advantages in publicity): প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করে ট্রেডমার্ক। এটি দেখে ক্রেতারা এর প্রতিষ্ঠান ও উক্ত প্রতিষ্ঠানের পণ্যের কথা মনে করে সহজেই কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এভাবে ট্রেডমার্ক এর মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ও প্রতিষ্ঠানের সহজেই প্রচারণা চালানো যায়।
তাই বলা যায়, ট্রেডমার্ক - এর মাধ্যমে আইনগত সুবিধাসহ বহুবিধ সুবিধা অর্জন করা যায়। এজন্য সব প্রতিষ্ঠানই এটি তৈরি ও পরিচিত করানোর ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে থাকে।