যৌথ মূলধনী কারবারের সুবিধা ও অসুবিধা
ব্রিটেনে সতেরশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম যৌথ মূলধনী কারবার চালু হয়। বর্তমানে সকল দেশে এ কারবার প্রচলিত আছে। এক মালিকানা কারবার ও অংশীদারি কারবারের অসুবিধাসমূহ উত্তরণের জন্য যৌথ মূলধনী কারবারের উদ্ভব হয়েছে। কয়েকজন ব্যক্তি যৌথভাবে মূলধন সংগ্রহ করে কারবার পরিচালনা করলে তাকে যৌথ মূলধনী কারবার বলে। যৌথ মূলধনী কারবারে বৃহদায়তন উৎপাদন করা যায়।
যৌথ মূলধনী কারবারের সুবিধা| Advantages of Joint Stock Company
১. উৎপাদন সুবিধা: অধিক উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ কম হয়। তাছাড়া বৃহদায়তন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে দক্ষ শ্রমিকের সমাবেশ ঘটে। যৌথ মূলধনী কারবারে এই সুবিধা পাওয়া যায়।
২. মূলধন সংগ্রহ: যৌথ মূলধনী কারবারে পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহ করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে শেয়ার হস্তান্তর, বিক্রি করে মূলধনের পরিমাণ বাড়াতে পারে। ফলে উৎপাদন কাজ পরিচালনায় অসুবিধা হয় না।
৩. স্থায়িত্ব: এসব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব বেশি হয়। এখানে কোনো সদস্য মারা গেলে বা দেউলিয়া হলে যৌথ মূলধনী কারবারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় না। ফলে এ কারবার একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়।
৪. সীমাবদ্ধ ব্যয় ও শেয়ার হস্তান্তর: প্রত্যেক শেয়ার হোল্ডার তার অংশীদারি অনুসারে কোম্পানির দায় বহন করেন। ফলে সীমাবদ্ধ খরচ হয়। যেকোনো বিনিয়োগকারী তার প্রয়োজনে শেয়ার বিক্রি করে নগদ টাকা সংগ্রহ করতে পারেন।
৫. অধিক ঝুঁকি বহন: অধিক ঝুঁকি নিয়ে যৌথ মূলধনী কারবার ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে। ফলস্বরূপ, নতুন নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
৬. দক্ষ পরিচালনা: যৌথ মূলধনী কারবারে দক্ষ পরিচালকের সাথে সাথে দক্ষ কর্মচারীদের সমাবেশ ঘটে। ফলে অধিকতর দক্ষতার ভিত্তিতে কারবার পরিচালিত হয়ে থাকে।
৭. জনগণের আস্থা: সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও যৌথ মূলধনী কারবারের মৌলিক নীতিমালা দেশের আইন অনুযায়ী এ কারবার পরিচালিত হয় বলে জনগণের আস্থা থাকে।
৮. উন্নত কলাকৌশল প্রয়োগ: ভারি যন্ত্রপাতি ও উন্নতমানের কলাকৌশল এ শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা যায়। ফলে উন্নতমানের দ্রব্য ও সেবা উৎপাদিত হয়।
৯. বিস্তৃত বাজার: এ কারবারে বৃহদায়তনে উৎপাদন পরিচালিত হয়। ফলে উৎপাদন খরচ ও দ্রব্য সেবার মূল্য কম হয়। এর প্রেক্ষিতে বাজার বিস্তৃত হয়। ফলে প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল ক্রয় এবং বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবা বিক্রি করা হয়। ফলে ক্রয়ের ক্ষেত্রে সুবিধা ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কম খরচ পড়ে।
যৌথ মূলধনী কারবারের অসুবিধা|Disadvantages of Joint Stock Company
১. পরিচালক ও অংশীদারদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি: অসংখ্য শেয়ার হোল্ডার বিরাজমান থাকায় পরিচালকদের সাথে শেয়ার হোল্ডারদের যোগাযোগ থাকে না। ফলে ব্যবসার উন্নতি ঘটে না।
২. অগণতান্ত্রিক চর্চা বৃদ্ধি: যারা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন তারা প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। ফলে সকলের জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৩. শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক: শ্রমিকদের সাথে মালিকদের প্রায়ই ভুল বোঝাবুঝি হয়। এজন্য শ্রমিকরা প্রায়ই ধর্মঘট, হরতাল ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়।
৪. সাংগঠনিক জটিলতা: সরকারি নীতিমালা মেনে যৌথ মূলধনী কারবার পরিচালনা করতে হয়। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ সাংগঠনিক জটিলতা লক্ষ করা যায়।
৫. দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: ব্যবসায় পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে। অনেক সময় নিজের আত্মীয় স্বজন কর্মচারীদের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। ফলে মুনাফা হ্রাস পেয়ে এ ব্যবসা ধ্বংস হয়। পরিচালকগণ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। প্রায়ই তাদের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। ফলে এ কারবারে ক্ষতি হয়।
৬. সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ: যৌথ মূলধনী কারবারের মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তি অনেক টাকার মালিক হয়। যা সমাজে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য সৃষ্টি করে। ফলে এ কারবারের মাধ্যমে সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়।
৭. অপচয় বৃদ্ধি পায়: দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অবহেলার কারণে ও কর্মচারীদের আন্তরিকতার অভাবে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অপচয় বৃদ্ধি পায়। ফলে কারবারে ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেয়।
৮. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: কতিপয় ক্রেতা বিভিন্নভাবে ও ভিন্ন নামে অধিকাংশ শেয়ার ক্রয় করে প্রতিষ্ঠানের আসল নিয়ামক হয়ে ওঠেন। তারা নিজেদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেন। ফলে সাধারণ অংশীদারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়।
উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, আইন প্রণয়ন এবং সুচিন্তিত সরকারি নীতির মাধ্যমে যৌথ মূলধনী কারবারের অসুবিধাগুলোর অধিকাংশ দূর করা যায়। আধুনিক যুগে উন্নত দেশগুলোতে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে এ ধরনের কারবারের মূল্যবান অবদান।