বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণ|Causes of inflation in Bangladesh
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। অজস্র সমস্যার মধ্যে মুদ্রাস্ফীতিও অন্যতম একটি সমস্যা। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় প্রায় প্রতিটি দ্রব্যের দাম ২০/২৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫.৩৫ %। বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮ অনুযায়ী দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৮৩ %।
ফলে দেশের জনগণের দুঃখ - দুর্দশা বেড়েছে অনেক। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয় প্রতি বছর। আবার, অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে। এছাড়া আরও অনেক কারণে এদেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
১. অর্থের যোগান বৃদ্ধি: বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ হলো অর্থের যোগান বৃদ্ধি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা -২০১৮ অনুসারে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এর আওতায় ২৮,৪৪৫.৩৩ কোটি টাকা লেনদেন হয় এবং গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১,০১৫.৯০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। ইন্টারনেট ব্যাংকিং এ প্রতিদিন গড়ে ৭৪.৫২ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে এবং ই-কমার্স - এর ক্ষেত্রে প্রতিদিন গড়ে ১.৮৮ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ লেনদেন ৩১.৪৬ কোটি টাকা বৈদেশিক লেনদেন হয়। এছাড়া ফেব্রুয়ারি ২০১৮ হিসাব অনুযায়ী, জনসাধারণের হাতে থাকা কারেন্সি নোট ও মুদ্রা ১২৮৩৩৮.১ কোটি টাকা হওয়ায় বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
২. উৎপাদন হ্রাস: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, স্বাধীনতা উত্তর উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা, ব্যাপক দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনাসহ প্রভৃতি কারণে দেশে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ফলে প্রচলিত অর্থের তুলনায় দ্রব্যসামগ্রী কম উৎপাদন হওয়ায় দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
৩. উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি: প্রতি বছর জ্বালানিসহ উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিচ্ছে।
৪. অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ: চাহিদার তুলনায় দেশে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, ঘনঘন লোডশেডিং - এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে দ্রব্যের যোগান সংকট তৈরি হয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হচ্ছে।
৫. ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাব: বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন খুব শক্তিশালী। শ্রমিক কল্যাণের কথা চিন্তা - ভাবনা করে ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য মালিকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অনেক সময় মালিক - শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করে। ফলে শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। ফলে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।
৭. যাতায়াত ও পরিবহন: বাংলাদেশের যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা মোটেও উন্নত নয়। দেশের সর্বত্র দ্রব্যসামগ্রী যথাসময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
৮. মজুদদার ও চোরাকারবারি: মজুদদার ও চোরাকারবারিরা দেশের অভ্যন্তরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাময়িক / কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করে।
৯. জনসংখ্যা বৃদ্ধি: বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় খাদ্য উৎপাদন সে তুলনায় বাড়েনি। ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
১০. উদার ঋণনীতি: বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদার ঋণনীতিও আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতির আর একটি কারণ। তাছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন, অপ্রত্যাশিত জরুরি অবস্থা মোকাবিলা, ঘাটতি বাজেট পূরণ ইত্যাদি কারণে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস হতে ক্রমান্বয়ে অধিক হারে ঋণ গ্রহণ করছে। অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক ঋণ গ্রহণের ফলে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হচ্ছে।
১১. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: স্বাধীনতার চার দশক পরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। ঘনঘন হরতাল, ধর্মঘট প্রভৃতি কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানেও মুদ্রাস্ফীতির চাপ বিদ্যমান। তবে সরকারের সতর্ক মুদ্রানীতি ও নিয়ন্ত্রিত ঋণ সরবরাহ নীতির ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিম্ন পর্যায়ে সীমিত করার চেষ্টা চলছে। তবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং নিরাপদ খাদ্য মজুদ রাখা সম্ভব হলে মুদ্রাস্ফীতির তীব্র প্রভাব হ্রাস পাবে।