মূলধনের ধারণা || Concept of Capital
অর্থনীতিতে মূলধন কাকে বলে?
সাধারণ অর্থে, মূলধন বলতে আমরা অর্থকে বুঝে থাকি। কিন্তু অর্থনীতিতে মূলধন বলতে মানুষের শ্রমের মাধ্যমে তৈরি সে সব দ্রব্যসামগ্রীকে বোঝায় যা বর্তমানে ভোগে ব্যবহৃত না হয়ে ভবিষ্যৎ উৎপাদনে সহায়তা করে। যেমন- ভ্যানগাড়ি, আসবাব, অফিস ব্লুম ইত্যাদি। তাই বলা যায়, উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় বা উৎপাদন কাজে সহায়তা করে এ ধরনের উপাদান যা আবার প্রকৃতির দান নয়, তাকে মূলধন হিসেবে গণ্য করা হয়। মূলধনকে উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান বলা হয়। অর্থাৎ মূলধন ছাড়া উৎপাদন করা সম্ভব নয়। উৎপাদনের তৃতীয় উপকরণ হলো মূল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মূলধন বলতে ব্যবসায়ে নিয়োজিত অর্থকে বোঝায়। কিন্তু মানুষের উৎপাদিত সম্পদের যে অংশ সরাসরি ভোগের জন্য ব্যবহার না হয়ে পুনরায় অধিকতর উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয় তাকেই অর্থনীতিতে মূলধন বলে।
মূলধন হলো উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান।
সুইডেনের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোহান গুস্তাভ উইকসেলের (১৮৫১-১৯২৬) মতে,
সঞ্চিত শ্রম ও সঞ্চিত প্রাকৃতিক সম্পদের যুক্ত ফলই মূলধন।
ইংরেজ অর্থনীতিবিদ স্যার সিডনি জন চ্যাপম্যানের (১৮৭১-১৯৫১) মতে,
যে সমস্ত সম্পদ কোনো আয় সৃষ্টি করে অথবা আয় উপার্জনে সহায়তা করে তাকে মূলধন বলে।
মলধনের যথার্থ সংজ্ঞা সম্পর্কে যে বিভ্রান্তি দেখা দেয় তা নিরসনের জন্য ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আলেকজান্ডার কেয়ার্নস (Caimcross) মূলধনের তিনটি রূপ উল্লেখ করেন-
১. বস্তুগত মূলধন: যেমন- উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি;
২. অর্থকরা মূলধন: যেমন- ব্যবসায় বাণিজ্যে নিয়োজিত অর্থ,
৩. ঋণ মূলধন যেমন- শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য, ভোগ্যদ্রব্য ও উৎপাদক দ্রব্যের মধ্যে কোনোরূপ গুণগত পার্থক্য নেই। একটি দালানকে বাসগৃহ হিসেবে ব্যবহার করা হলে তা ভোগ্যপণ্য, কিন্তু সেখানে যদি কোনো কারখানা স্থাপন করা হয়, তবে সেটি মূলধন হিসেবে গণ্য হবে।
উপরের আলোচনা এবং মনীষীদের মতামত থেকে মূলধন সম্পর্কে যে ধারণাসমূহ পাওয়া যায় তা হলো—
১. মূলধন পুনরুৎপাদনে ব্যবহৃত মানবসৃষ্ট উপাদান
২. মূলধন উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান,
৩. উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় কিন্তু যা প্রকৃতির দান, তা মূলধন হিসেবে বিবেচিত হয় না (জমি, খনি, বন, সমুদ্র প্রভৃতি মূলধন নয়)।
৪. উৎপাদিত দ্রব্য যা বর্তমানে ভোগে ব্যবহৃত হয় তা মূলধন নয় নিজের বা পরিবারের জন্য কাপড়, খাদ্য, বসতবাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি মূলধন নয়)।
বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে যেসব দ্রব্য মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত হয়ে আবার অধিক উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় তাকে মূলধন বলে। এ অর্থে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কলকারখানা, গুদামঘর প্রভৃতি হলো মূলধন। আধুনিককালে অর্থ অধিক উৎপাদনে সহায়তা করে। মূলধন বলতে উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীসহ অর্থের ঐ অংশ মূলধন হিসেবে বিবেচিত হয়, যা অধিক উৎপাদনের জন্য উৎপাদনে নিয়োজিত হয়। এজন্য সরাসরি উৎপাদনে নিয়োজিত অর্থসহ শেয়ার, ডিবেঞ্চার ও বিভিন্ন ঋণপত্রে নিয়োজিত অর্থও মূলধন হিসেবে গণ্য হয়।
মূলধন এক প্রকার সম্পদ, যা অধিক উপার্জনে বা আয় সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, অনেক সম্পদ আছে যা মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় কিন্তু আয় উপার্জন করে না কিংবা অধিক আয় সৃষ্টি করে না। যে সম্পদ শুধু ভোক্তার জন্য ব্যবহার হয়, তা মূলধন নয়। আবার ব্যবহারভেদে কোনো জিনিসও মূলধন হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে গৃহে ব্যবহারের জন্য টেবিল এবং চেয়ার শুধুই সম্পদ। কিন্তু একজন ব্যবসায়ী যদি তার ব্যবসায়ের কাজে অফিসে ব্যবহারের জন্য চেয়ার, টেবিল ক্রয় করেন, তখন তা একই সাথে মূলধন এবং সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। কারখানা, যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামাল হলো মূলধন। তাই সকল মূলধন সম্পদ কিন্তু সকল সম্পদ মূলধন নয়।
সুতরাং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মানুষের শ্রম ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে যেসব দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হয় তা যদি পুনরুৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং আয় সৃষ্টিতে সহায়তা করে, তবে তাকে মূলধন বলে। এ প্রসঙ্গে Marshall মূলধনকে আয়ের উৎস বলে অভিহিত করে বলেছেন Capital is a fund and income is it's flow অর্থাৎ, মূলধন হলো একটি তহবিল এবং আয় হালা তার একটি প্রবাহমান ধারা।
মূলধনের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Capital
মূলধন হলো মানুষ কর্তৃক উৎপাদিত একমাত্র উৎপাদনের উপকরণ। এই উৎপাদিত উপকরণ মানুষ ভোগ না করে নতুন দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহার করে। মূলধনের কতগুলো লক্ষণীয় দিক বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মূলধনের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
১. উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান : উৎপাদনে জমি ও শ্রমিক মৌলিক উপাদান হিসেবে গণ্য হয়। মূলধন উৎপাদনের নিরেট মৌলিক উপাদান নয়। তবে মূলধন উৎপাদনক্ষেত্র থেকেই সৃষ্টি হয় । উৎপাদিত দ্রব্য পুনরায় উৎপাদন কাজে ব্যবহার হলে তা মূলধন হিসেবে বিবেচিত হয়। কাজেই প্রকৃতির প্রাথমিক দান হিসেবে মূলধন গণ্য হয় না।
২. সঞ্চয়ের ফল: মানুষ আয়ের একটি অংশ ভোগের জন্য ব্যয় করে এবং অবশিষ্ট অংশ সঞ্চয় করে। এই সঞ্চিত অর্থ উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হলে তা মূলধন হিসেবে বিবেচিত হয়। সুতরাং মূলধন সৃষ্টি হতে হলে মানুষকে তার আয়ের একটি অংশকে বর্তমান ভোগের জন্য ব্যয় না করে সঞ্চয় করতে হয়। সুতরাং সঞ্চয় দ্বারা মূলধন সৃষ্টি হয়।
৩. অস্থায়ী উপাদান : মূলধন ব্যবহারের মাধ্যমে নিঃশেষ হয় । উৎপাদন কাজে বারবার ব্যবহারের ফলে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল , বাড়িঘর সবই ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সুতরাং, মূলধনকে অস্থায়ী উপাদান বলা যায়।
৪. উৎপাদন ব্যয়; অনেক সময় ভূমির যোগান দাম ধরা হয় না। তাই ভূমির কোনো উৎপাদন ব্যয় নেই মনে করা হয়। কিন্তু মূলধন মানুষের দ্বারা উৎপাদিত এবং পুনরায় উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হয়। তাই মূলধনের উৎপাদন খরচ অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। মূলধন প্রকৃতির দান নয়। মূলধন পাওয়ার জন্য কিছু না কিছু ব্যয় করতে হয়।
৫. গতিশীল : উৎপাদনের অন্যান্য উপাদান অপেক্ষা মূলধন তুলনামূলকভাবে গতিশীল। কারণ মূলধন বিভিন্ন খাতে ব্যবহারযোগ্য এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থানান্তরযোগ্য।
৬. বিভিন্ন বস্তুর জটিল সমষ্টি: মূলধনকে সমজাতীয় দ্রব্য হিসাবে গণ্য করা যায় না। বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়া থেকে মূলধন সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন উৎপাদিত বস্তু একত্র করে যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। কাজেই বিভিন্ন বস্তুর জটিল সমষ্টিকরণের মাধ্যমে মূলধন পাওয়া যায়।
৭. ভবিষ্যৎ আয়ের উৎস : মূলধন ভবিষ্যৎ আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। মূলধন ব্যবহারের ফলে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে তা ভবিষ্যতে অধিক আয়ের পথ সৃষ্টি করে।
৮. নিষ্ক্রিয় উপাদান: মূলধন নিজে কোনো কিছু উৎপাদন করতে পারে না। যেমন— যন্ত্রপাতি, কল - কারখানা কিছু উৎপাদন করে না, যদি এর সাথে শ্রমিক যুক্ত হয় তখনই উৎপাদন সম্ভব হয়। তাই মূলধন হলো নিষ্ক্রিয় উপাদান।
৯. অতীত শ্রমের ফল : মূলধন হলো অতীত শ্রমের ফল। এটি প্রকৃতি প্রদত্ত ভূমির মতো কোনো উপকরণ নয়। কলকারখানা যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল প্রভৃতি যা মূলধন হিসেবে বিবেচিত তা অতীত শ্রম দ্বারা সৃষ্ট।
১০. সমজাতীয় নয় : মূলধনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, সকল মূলধন সমজাতীয় নয়। বাস্তবে মূলধন হলো স্বতন্ত্র ক্রিয়াসম্পন্ন বিবিধ বস্তুর একটি জটিল সমষ্টি। তাই বিভিন্ন মূলধনের মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে এবং তাদের উৎপাদনশীলতাও এক রকম নয়।