চাহিদার ধারণা || Concept of Demand
চাহিদা কাকে বলে? What is Demand
সাধারণত কোনো কিছু পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষাকে চাহিদা বলে। কিন্তু অর্থনীতিতে কোনো দ্রব্য পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা চাহিদা হিসেবে গণ্য হয় না।
ধরা যাক, একজন ভিক্ষুক মোটর সাইকেল ক্রয় করতে চায়। কেননা সে মোটর সাইকেলে অধিক সংখ্যক বাড়িতে যেয়ে ভিক্ষা করতে পারবে। কিন্তু তার এ মোটর সাইকেল ক্রয়ের ইচ্ছা কখনই চাহিদা নয়। কারণ তার মোটর সাইকেল ক্রয়ের সামর্থ্য নেই।
আবার, একজন ধনী অথচ কৃপণ ব্যক্তি অনেক দামি গাড়ি কিনতে চাইলেও সে ক্রয় করে না। কারণ সে ঐ দামে গাড়ি কিনতে রাজি নয়। অর্থাৎ অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য থাকলেও তার অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা নেই।
সুতরাং, ঐ গাড়ি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা চাহিদা নয়। অতএব, চাহিদার সংজ্ঞায় বলা যায়, উপযুক্ত ক্রয় ক্ষমতা ও অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা সম্পর্কিত মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে চাহিদা বলে।
অর্থনীতিতে কোনো আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছাকে চাহিদা বলে গণ্য করতে হলে নিম্নোক্ত শর্ত পালন করতে হয়। যথা—
ক. কোনো দ্রব্য বা সেবা পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা (Willingness)
খ. আকাঙ্ক্ষার পিছনে ক্রয়ের সামর্থ্য বা ক্রয়ক্ষমতা (Ability of Purchasing Power)
গ. অর্থ ব্যয় করে ক্রয়ের ইচ্ছা (Willingness to Spend Money)।
অর্থনীতিবিদ বেনহাম (Benham) বলেন,
কোনো নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতা বিভিন্ন দামে একটি দ্রব্যের যে বিভিন্ন পরিমাণ ক্রয় করতে প্রস্তুত থাকে তাই হলো ঐ দ্রব্যের চাহিদা।
অধ্যাপক পেনসন (Penson) বলেন,
কোনো দ্রব্য পাওয়ার ইচ্ছার পশ্চাতে অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য ও অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা থাকলে তখন তাকে চাহিদা বলে।
চাহিদা বিধি|Law of Demand
সকল দ্রব্যের চাহিদা দামের ওপর নির্ভরশীল। অন্যান্য অবস্থা স্থির থেকে দ্রব্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমে এবং দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। দাম ও চাহিদার মধ্যে এ বিপরীত সম্পর্ক যখন কোনো বিধির মাধ্যমে দেখানো হয় তখন তাকে চাহিদা বিধি বলে।
অপেক্ষকের মাধ্যমে চাহিদা বিধির প্রকাশ: Qa = f (P) যেখানে, Q = চাহিদার পরিমাণ (Quantity of Demand), f = অপেক্ষক (Function), P = দাম (Price)
অধ্যাপক ডোমেনিক স্যালভেটর (Dominick Salvatore) - এর মতে,
দাম ও চাহিদার পরিমাণের মধ্যে বিপরীত সম্পর্ক হলো চাহিদা বিধি, যা চাহিদা রেখার ঋণাত্মক ঢালের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। চাহিদা বিধিতে অন্যান্য অবস্থা স্থির (Ceteris Paribus) বলতে
ক. ভোক্তার আয়, রুচি ও অভ্যাস অপরিবর্তিত
খ. ভোক্তার যুক্তিশীল আচরণ
গ. বিবেচিত দ্রব্যের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য দ্রব্যের দাম স্থির ঘ . ভোক্তার সংখ্যা স্প্রির
ঙ. সময় স্থির ইত্যাদিকে বোঝায়।
উপরের শর্তাবলির ভিত্তিতে চাহিদা বিধিকে চাহিদা সূচি ও চাহিদা রেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়।
চাহিদা বিধির ব্যতিক্রম|Exceptions to the Law of Demand
চাহিদা বিধি সর্বত্র প্রযোজ্য হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। নিচে ব্যতিক্রমগুলো আলোচনা
১. রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন: মানুষের রুচিবোধ অভ্যাসকে পরিচালিত করে। মানুষ অভ্যাসের দাস, তাই যেকোনে কারণেই বুচি ও অভ্যাস পরিবর্তিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে চাহিদা বিধি কার্যকর হবে না।
২. আয়ের পরিবর্তন: ভোক্তার আয়ের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ বিধি কার্যকর হয় না। কারণ আয় বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ে। ফলে চাহিদাও বাড়ে, তাই চাহিদা বিধি কার্যকর হয় না।
৩. বিকল্প ও পরিপূরক পণ্য: বিকল্প ও পরিপূরক পণ্যের দাম পরিবর্তিত হলে চাহিদা বিধির ব্যতিক্রম ঘটে। যেমন চায়ের দাম ঠিক থেকে কফির দাম কমলে চায়ের চাহিদা কমে, কফির চাহিদা বাড়তে পারে। আবার, পরিপূরক পণ্য হিসেবে তেলের দাম কমলে গাড়ির চাহিদা বাড়বে, ফলে চাহিদা বিধি কার্যকর হয় না।
৪. জাকজমক বা ভেবলেন (Veblen) পণ্য: জাঁকজমক পণ্যের ক্ষেত্রে চাহিদা বিধি কার্যকর নয়। মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে এমন পণ্য পেতে সকলেই আগ্রহী। এজন্য এ ধরনের পণ্যের দাম বাড়লেও চাহিদা কমে না। ঊনবিংশ শতকের মার্কিন অর্থনীতিবিদ থর্সটেইন ভেবলেন এরূপ ভোগকে জাঁকজমক ভোগ (Conspicuous Consumption) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এজন্য তার নামানুসারে এসব জাকজমকপূর্ণ দ্রব্যকে ভেবলেন দ্রব্য বলা হয়। যেমন— দামি গাড়ি, দামি অলঙ্কার ইত্যাদি।
৫. গিফেন দ্রব্য: মানুষের নিত্য ব্যবহার্য এমন কিছু দ্রব্য রয়েছে, যা ব্যবহার না করলে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। যেমন— চাল, কাপড়, তৈল, আলু ইত্যাদি। এসব দ্রব্যের দাম বাড়লে ক্রয়ের পরিমাণ অনেক সময় বেড়ে যায়। এ ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কথা প্রথমে স্যার রবার্ট গিফেন প্রকাশ করেন বলে তার নামানুসারে এসব দ্রব্যের নাম হয় গিফেন দ্রব্য।
স্যার রবার্ট গিফেন ১৮৪০ সালে আইরিশ কৃষকদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, অত্যন্ত নিম্ন আয় সম্পন্ন পরিবারের মৌলিক খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে দাম ও চাহিদার মধ্যে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান অর্থাৎ এসব দ্রব্যের ক্ষেত্রে দাম বাড়লে চাহিদা বাড়ে এবং দাম কমলে চাহিদা কমে।
এ ধরনের চাহিদা রেখা ডানদিকে ঊর্ধ্বগামী হয়। যেমন- বাংলাদেশের জনগণের প্রধান খাবার ভাত। তাই সাম্প্রতিককালে চালের উচ্চমূল্য সত্ত্বেও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো পূর্বের চেয়ে বেশি করে চাল ক্রয় করেছে।
৬. ভবিষ্যৎ আশঙ্কা: সম্পদের যোগান সীমিত হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদক এবং বাজারজাতকারীরা পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ক্রেতা কখনও যদি মনে করে যে, ভবিষ্যতে পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে তবে বর্তমান দাম বেশি হলেও তার চাহিদা বাড়বে।
৭. ঋতু বা সময়: শীতকালে গরম কাপড়ের দাম বাড়লেও তার চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এ সময় বরফের দাম কমলেও চাহিদা বাড়ে না।
৮. নিত্যপ্রয়োজনীয় বা অত্যাবশ্যক দ্রব্যের ভোগ: লবণ, দিয়াশলাই, জীবনরক্ষাকারী বা রোগযন্ত্রণা উপশমকারী ওষুধ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যক দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস হলেও এগুলোর চাহিদা বিশেষ হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে
৯. ক্রেতার অজ্ঞতা: কোনো কোনো ক্রেতা দ্রব্যের দামকেই দ্রব্যের গুণগত মানের মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করে। ফলে ক্রেতার অজ্ঞতার কারণে সে অধিক অর্থদণ্ড দিয়ে থাকে।
চাহিদা রেখা ডানদিকে নিম্নগামী হওয়ার কারণ
চাহিদা রেখা বামদিক থেকে ডানদিকে নিম্নগামী হওয়ার কারণসমূহ: চাহিদা রেখা বামদিক থেকে ডানদিকে নিম্নগামী হওয়ার মূল কারণ হলো চাহিদা বিধি। চাহিদা বিধিতে অন্যান্য অবস্থা স্থির থেকে দ্রব্য ও সেবার দামের সাথে চাহিদার পরিমাণের বিপরীত সম্পর্ক নির্দেশ করে। এ সম্পর্কের কারণেই চাহিদা রেখা বাম থেকে ডানদিকে নিম্নগামী হয়। তবে এ সম্পর্কে যেসব কারণ রয়েছে, তা হলো:
১. ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি: এ বিধি অনুযায়ী কোনো দ্রব্যের ভোগ বাড়লে ভোক্তার নিকট তার প্রান্তিক উপযোগ কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে দ্রব্যটির প্রান্তিক উপযোগ দামের সমান হয়। অর্থাৎ দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ বা দাম হ্রাস পাওয়ার কারণে তার ভোগ বা চাহিদা বাড়ে। আবার দাম বা প্রান্তিক উপযোগ বেশি হলে দ্রব্যের ভোগ বা চাহিদা কম হয়। এজন্য চাহিদা রেখা ডানে নিম্নগামী হয়।
২. আয়ের প্রভাব: দ্রব্যের দাম কমলে ক্রেতা একই পরিমাণ দ্রব্য ক্রয়ের জন্য আগের চেয়ে কম অর্থ ব্যয় করে। ফলে ক্রেতা তার উদ্বৃত্ত অর্থ দ্বারা অতিরিক্ত দ্রব্য ক্রয় করে। পক্ষান্তরে, দাম বাড়লে ক্রেতার প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় তার চাহিদাও কমে যায়।
৩. পরিবর্তক প্রভাব: ধরি, গুড় ও চিনি দুটি পরিবর্তক দ্রব্য । গুড়ের দাম কমে গেলে ক্রেতা চিনির পরিবর্তে গুড় বেশি ক্রয় করে। এর ফলে সস্তা পণ্যটির চাহিদা বাড়ে। এজন্য দ্রব্যের দাম ও চাহিদার মধ্যে যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তা নিম্নগামী চাহিদা রেখার দ্বারাই প্রকাশ পায়।
৪. ক্রয়ক্ষমতা বা সামর্থ্য: কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে তা অনেক ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে তার সামগ্রিক চাহিদা কমে। আবার দাম কমলে অনেক ক্রেতা সেটি ক্রয় করতে সমর্থ হয়। এভাবে দাম ও চাহিদার বিপরীতমুখী সম্পর্ক দেখা যায়— যা নিম্নগামী চাহিদা রেখার দ্বারা প্রকাশ হয়।
৫. ঢাল ঋণাত্মক: চাহিদা রেখার ঢাল ঋণাত্মক; ফলে দাম ও চাহিদার পরিমাণের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন— কোনো দ্রব্যের দাম 2 টাকা থেকে 4 টাকায় বৃদ্ধি পেলে, চাহিদার পরিমাণ ৪ একক থেকে হ্রাস পেয়ে 6 একক হলে, চাহিদা রেখা বামদিক থেকে ডানদিকে নিম্নগামী হয়।