অর্থায়নের ধারণা | Concept of Finance

প্রাচীনকালে মানুষ দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কাজ সম্পাদন করত। কিন্তু দ্রব্য বিনিময় প্রথার নানারকম সমস্যার কারণে তা বিলুপ্ত হয়ে অর্থের প্রচলন ঘটে; যা কিনা বিনিময়ের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। বর্তমানে অর্থ বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি সঞ্চয় করা হয় । সতি অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করা ছাড়াও তা অন্যকে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যায়। এটিই অর্থায়ন হিসেবে পরিচিত। অর্থ থেকেই অর্থায়ন কথাটির সৃষ্টি। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের জন্য অর্থসংস্থান বা অর্থায়ন প্রয়োজন হয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উৎপাদন, শিল্পায়ন  নগরায়ণ সবকিছুর পিছনে রয়েছে অর্থায়ন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসই বাংলাদেশের প্রধান ও প্রথম শেয়ারবাজার। দ্বিতীয় শেয়ারবাজার হচ্ছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। ডিএসই ঢাকার কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত। ১৯৫৪ সালে এটি গঠিত হয়।

অর্থায়ন কি? What is Finance?


ইংরেজি Finance শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো অর্থায়ন বা অর্থসংস্থান। Finance শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Finis হতে উৎপত্তি হয়েছে। Finis শব্দটি দ্বারা অর্থের সংস্থান, যোগান বা অর্থ সংগ্রহ করাকে বোঝায়। অনেকে অর্থকে ব্যবসায়ের জীবনীশক্তি (Life blood) বলে অভিহিত করেন।
সাধারণত অর্থায়ন বলতে অর্থ সংগ্রহ করাকে বোঝায়। সংকীর্ণ অর্থে, কোনো ব্যবসায় বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিকল্পনা , সম্পদের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থাপনা ও তহবিল সংগ্রহ করাকে অর্থায়ন বলে। বৃহৎ অর্থে, অর্থসংগ্রহ ও সংগৃহীত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলিকে অর্থায়ন বলে। অর্থাৎ দেশের মাঝে ও বহিঃবিশ্বে একটি সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থাপনার মাঝে কীভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, ফার্ম, মুদ্রা বাজার এবং মূলধন বাজার তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তাকে বোঝায়। তবে অর্থনীতিতে অর্থায়ন বলতে অর্থ সংগ্রহ , অর্থ ব্যবহারের কলাকৌশল ও নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন কাজে অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন ইত্যাদি যাবতীয় আর্থিক কার্যাবলির সমষ্টিকে বোঝায়। অর্থায়নের সুনির্দিষ্ট ধারণা পেতে হলে এ সম্পর্কে কয়েকটি সংজ্ঞা বিবেচনা করা প্রয়োজন।

এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিট্যানিকা এর মতে, অর্থায়ন বলতে অর্থ পরিশোধের উপায়কে বোঝায়।

এল. জে. গিটম্যান - এর মতে,
অর্থ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কলা ও বিজ্ঞানকে অর্থায়ন বলে। 

অর্থায়ন ঐ প্রতিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ, বাজার এবং হাতিয়ারগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট যার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গ , ব্যবসায় সংগঠন এবং সরকারের মধ্যে অর্থের লেনদেন হয়।

ই. ডব্লিউ. ওয়াকার বলেন,
কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিকল্পনা, সমন্বয় সাধন, নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের প্রয়োগ সংক্রান্ত কার্যাবলিকে অর্থায়ন বলে।


অর্থায়নের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Finance

অর্থায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম থেকে অর্থায়নের যে সকল বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে তা হচ্ছে – 
১. আর্থিক কার্যক্রম : অর্থায়ন হচ্ছে অর্থসংক্রান্ত সকল কার্যক্রমের সমষ্টি । অর্থাৎ অর্থায়নের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অর্থের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হবে।
২. আর্থিক পরিকল্পনা : অর্থায়ন পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ অর্থসংক্রান্ত সকল কার্যের পূর্বে এর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।
৩. উৎস শনাক্তকরণ : উৎস শনাক্তকরণ সংক্রান্ত কার্যকলাপ অর্থায়নের সাথে সম্পৃক্ত । অর্থাৎ কোন উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করলে মূলধন খরচ কম হবে তা স্থির করতে হয়।
৪. বিনিয়োগ: অর্থায়ন বিনিয়োগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । লাভজনক খাতে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন হচ্ছে অর্থায়নের আলোচ্য বিষয়।
৫ . লভ্যাংশ বণ্টন : ব্যবসায়ের লভ্যাংশ বণ্টন অর্থায়নের সাথে সম্পৃক্ত । এতে বিভিন্ন পলিসি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে । 
৬. অর্থায়ন ও অন্যান্য বিষয় : অর্থায়ন বিষয়টি অর্থনীতি , হিসাববিজ্ঞান , বিপণন এবং ব্যবস্থাপনার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
অতএব, কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনামাফিক অর্থের উৎস শনাক্তকরণ , সুবিধাজনক খাত থেকে অর্থসংগ্রহ , সংগৃহীত অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং অর্থসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলির সমষ্টিকেই অর্থায়ন বলে।

অর্থায়নের কার্যাবলি Functions of Finance 

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সরকারের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান ও তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অনেক কার্য সম্পাদন করতে হয়। যা নিচে আলোচনা করা হলো : 
১. আর্থিক পরিকল্পনা (Financial Planning): বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সরকারকে অর্থের প্রয়োজনীয়তার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয় , তাকে আর্থিক পরিকল্পনা বলে।
২. উৎস শনাক্তকরণ (Source Selection): আর্থিক পরিকল্পনার প্রধান কাজ হলো প্রয়োজনীয় অর্থ কোন কোন উৎস থেকে পাওয়া যেতে পারে তা চিহ্নিত করা । যেমন- কোনো ব্যক্তি , বন্ধু বান্ধব বা কোনো আত্মীয় - স্বজন , কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বা অন্য কোনো বাহ্যিক উৎস থেকে অর্থসংস্থান করা যায়।
৩. তহবিল সংগ্ৰহ ( Collection of fund ): অর্থায়নের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্ভাব্য কোনো উৎস হতে তহবিল সংগ্রহ করা । কোন কোন খাত হতে তহবিল অর্থাৎ অর্থ পাওয়া যাবে নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে অর্থসংগ্রহ করার জন্যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । কিন্তু তহবিল সংগ্রহের সময় তুলনামূলক কম খরচের উৎস শনাক্ত করতে হবে । মূলধনের খরচ কম হলে ব্যবসায়ে মুনাফা বেশি করার সুযোগ থাকে , তেমনি ঝুঁকিও কম থাকে।
৪. তহবিল বিনিয়োগ ( Fund investment ): বিনিয়োগ প্রকল্পসমূহের খরচ ও আয় বিশ্লেষণ করতে হয় । যেসব প্রকল্পে আয় , ব্যয় অপেক্ষা বেশি এবং এ প্রকল্পগুলো হতে সর্বাধিক মুনাফা প্রদানকারী প্রকল্প বেছে নিয়ে সেখানে বিনিয়োগ করা।
৫. তহবিল সংরক্ষণ ( Fund maintain ) : ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত মূলধন বা তহবিল যাতে বিনষ্ট না হয় , সে বিষয়েও অর্থায়নের ভূমিকা রয়েছে। মুনাফা অর্জন ক্ষমতা বজায় রাখা এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রক্ষা করা অর্থায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
৬. ফলাফল নির্ণয় ( Measurement of result ) : বিনিয়োগ প্রকল্পের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হয় । বিনিয়োগ প্রকল্প থেকে কী পরিমাণ লাভ অর্জিত হলে , বর্তমান আর্থিক অবস্থা কেমন , ক্ষতি হলে কীভাবে তা পুষানো যাবে তা নির্ণয় করা হয়।
৭. মুনাফা বণ্টন ( Distribution of profit ) : প্রকল্প থেকে অর্জিত মুনাফার কত অংশ ব্যবসায়ে পুনঃবিনিয়োগের জন্য রেখে দেওয়া হবে এবং কত অংশ মালিক বা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করা হবে , সে ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা।
সুতরাং ব্যবসায়ের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থ বিনিয়োগের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা স্বল্প , মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান এবং লভ্যাংশ নীতি , ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা , আর্থিক বিশ্লেষণ , তহবিল সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে অর্থায়নের প্রকৃতি বিস্তৃত। ব্যবসায়ে শুধু স্থায়ী সম্পত্তি বা স্থায়ী মূলধন সরবরাহ করলেই হবে না , ব্যবসায়ে চলতি মূলধনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের ওপর ব্যবসায়ে চলতি মূলধন বা তারল্য বিষয়টি নির্ভর করে । কিন্তু ব্যবসায়ে তারণা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে অথবা ঘাটতি হলে ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

অর্থায়নের শ্রেণিবিভাগ  Classification of Finance


বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থায়নের শ্রেণিবিভাগ করা হয়ে থাকে। কাজের ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী অর্থায়নের শ্রেণিবিভাগ নিচের প্রবাহ চিত্রে দেখানো হলো— নিচে অর্থায়নের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো— 

ক. সরকারি অর্থায়ন (Governmental Finance): দেশের সরকার কর্তৃক সংগৃহীত অর্থায়নকে সরকারি অর্থায়ন বলে। অর্থাৎ রাষ্ট্র বা স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনীয় অর্থের পরিকল্পনা , উৎস চিহ্নিতকরণ এবং ঐসব উৎস হতে অর্থসংগ্রহ ও তার সুষ্ঠু বণ্টনকে সরকারি অর্থায়ন বলে। সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনা, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও জনকল্যাণমূলক কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় । এই ব্যয় মিটানোর জন্য সরকারকে বিভিন্ন উৎস হতে আর্থিক সম্পদ সংগ্রহ করতে হয় । এই অর্থসংস্থানের উৎস অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক অথবা উভয় ধরনের হতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় , কর , শুল্ক ও অ - কর রাজস্ব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । বাহ্যিক উৎস বলতে বিভিন্ন দেশের সাহায্য সংস্থা , আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন— বিশ্বব্যাংক ( WB), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF). এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), ইউরোপীয় ইউনিয়ন  (EU) প্রভৃতির কাছ থেকে ঋণ, অনুদান, দান ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করাকে বুঝায়।

খ . বেসরকারি অর্থায়ন (Non Governmental Finance): সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নকে বেসরকারি অর্থায়ন বলে। বেসরকারি অর্থায়নকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— 

১. ব্যক্তিগত অর্থায়ন (Personal Finance): কোনো ব্যক্তি তার দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য যে অর্থায়ন করে তাকে ব্যক্তিগত অর্থায়ন বলে। 

২. ব্যবসায় অর্থায়ন (Business Finance): মুনাফার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যবসায়িক কার্যাবলি সম্পদানের জন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহে যে অর্থায়ন করা হয়, তাকে ব্যবসায় অর্থায়ন বলে । ব্যবসায় অর্থায়নকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— 

i. ব্যক্তিগত ব্যবসায় অর্থায়ন: ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নকে ব্যক্তিগত ব্যবসায় অর্থায়ন বলে। একমালিকানা, অংশীদারি ও যৌথ মূলধনী কারবার মূলত এ ধরনের অর্থায়ন করা হয়।

ii. সরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন: সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য সংগৃহীত অর্থায়নকে সরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন বলে। এ ধরনের অর্থায়ন স্বল্প 
, মধ্যম বা দীর্ঘ সময়ের জন্য করা হয়ে থাকে।

iii . স্বায়ত্তশাসিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন: বিভিন্ন কর্পোরেশন বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বল্প , মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদের জন্য যে অর্থায়ন করা হয়, তাকে স্বায়ত্তশাসিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন বলে। বিভিন্ন কর্পোরেশন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার বা এসব সংস্থা নিজেই অর্থ সরবরাহ করে থাকে।

৩. অ - ব্যবসায় অর্থায়ন (Non Business Finance): মুনাফার উদ্দেশ্য ব্যতীত যে সকল প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করা হয় তাকে অ -ব্যবসায় অর্থায়ন বলে। যেমন : সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি হাসপাতাল, ক্লাব, লাইব্রেরি, এতিমখানা, মহিলা সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান।

৪. কর্পোরেট অর্থায়ন (Corporate Finance): দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থ সংগ্রহ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করলে তাকে কর্পোরেট অর্থায়ন বলে।

৫. আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ( International Finance): বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি খাতে যে অর্থায়ন করা হয় , তাকে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বলে। এছাড়া আরও কয়েক প্রকার অর্থায়নের ধারণা রয়েছে। যথা 

ক. মালিকানার ভিত্তিতে অর্থায়ন: মালিকানার ভিত্তিতে অর্থায়ন ৩ ধরনের হতে পারে। যেমন:

এক মালিকানা কারবারে অর্থায়ন 

ii . অংশীদারি কারবারে অর্থায়ন
iii . যৌথ মূলধনী কারবারে অর্থায়ন

খ. মেয়াদের ভিত্তিতে: মেয়াদের ভিত্তিতে অর্থায়ন হলো ৩ প্রকার। যথা— 

i. স্বল্পমেয়াদি অর্থায়ন
ii . মধ্যমেয়াদি অর্থায়ন 
iii . দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন

গ . উৎসের ভিত্তিতে: উৎসের ভিত্তিতে অর্থায়ন ২ প্রকার। যথা 

i. অভ্যন্তরীণ উৎস: উদ্যোক্তাগণ কর্তৃক সরবরাহকৃত মূলধন , শেয়ার , অবষ্টিত মুনাফা ও সঞ্চিত তহবিল অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয।

ii . বাহ্যিক উৎস: উদ্যোক্তার নিজস্ব মূলধন এবং অবণ্টিত মুনাফা ছাড়া ঋণ হিসেবে যে সমস্ত উৎস হতে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, তাকে বাহ্যিক উৎস বলে। এ তহবিল আবার দু'ধরনের হয়। যথা— 

দেশীয়: প্রদেয় বিল, বাণিজ্যিক পত্র, ক্রেতা হতে অগ্রিম গ্রহণ, মজুদ মাল বন্ধকীকরণ, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং গ্রামীণ মহাজন, সুদের কারবারি প্রভৃতি।

আন্তর্জাতিক : দাতা দেশ ও সংস্থা কর্তৃক সাহায্য, ঋণ, দান অনুদান প্রভৃতি।

ঘ . উৎসের কাঠামো ভিত্তিতে: উৎসের কাঠামো ভিত্তিতে অর্থায়ন দুই প্রকার। যথা— 

i. প্রাতিষ্ঠানিক উৎস: যখন কোনো স্বীকৃত বা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থায়ন করা হয় , তখন তাকে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন অর্থায়ন বলে। যেমন— সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক।

ii . অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস: আত্মীয় - স্বজন , বন্ধু - বান্ধব , গ্রাম্য মহাজন, স্বর্ণকার, সাহ্রকার প্রভৃতি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়নের উৎস হিসেবে বিবেচিত।

অর্থায়নের উৎসসমূহ Sources of Finance


ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় ব্যয় নির্বাহের জন্য যে বিভিন্ন উৎস থেকে মূলধন সংগ্রহ করে , তাকে অর্থায়নের উৎস বলে। উন্নয়ন পরকল্পনায় অর্থায়নের উৎসগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন—
ক. অভ্যন্তরীণ উৎস (Domestic or Internal Sources) খ. বাহ্যিক উৎস (External Sources) 

ক . অভ্যন্তরীণ উৎস (Internal Sources): কোনো প্রতিষ্ঠানের মোট তহবিলের যে অংশ মালিকপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উৎস থেকে সরবরাহ করা হয় তাকে অভ্যন্তরীণ উৎস বলে। প্রতিষ্ঠান গঠন করার শুরুতেই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করার জন্য অর্থের প্রয়োজন পড়ে। এ অর্থ মালিক নিজের ব্যক্তিগত তহবিল বা অভ্যন্তরীণ তহবিল থেকে সংস্থান করে । প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন ও তারল্য বজায় রাখতে অভ্যন্তরীণ অর্থসংস্থানের দরকার হয়। অর্থায়নের অভ্যন্তরীণ উৎসসমূহ হলো : 

১. নগদ অর্থ: ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের সঞ্চয় নগদে নিজের হাতে অথবা নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে চলতি বা সঞ্চয়ী হিসার খুলে জমা রাখতে পারে।

২. সংরক্ষিত মুনাফা: প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফার যে অংশ মালিক বা অংশীদারদের মধ্যে লভ্যাংশ হিসেবে বণ্টন না করে আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তাকে সংরক্ষিত মুনাফা বলে।

৩. বকেয়াসমূহ: ধারে প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মাধ্যমেও মূলধন যোগাড় করা যায় । ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানে অনেক ব্যয় হয় যা তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করা হয় না।

৪. অবচয় সঞ্চিতি: প্রতিষ্ঠানে অনেক স্থায়ী সম্পত্তি থাকে। যেমন- দালানকোঠা, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ইত্যাদি। এগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার করার ফলে ক্ষয় হয় এবং এগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই প্রতিবছর অবচয় হিসেবে এ ক্ষয়জনিত অর্থ কেটে রাখা হয়।

৫. ভবিষ্যৎ তহবিল: একটি প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ভবিষ্যৎ তহবিলের ব্যবস্থা থাকে । এ জন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে রাখা হয় এবং মালিকপক্ষ আরও কিছু দিয়ে ভবিষ্যৎ তহবিলকে সমৃদ্ধ করে।

৬. স্থায়ী সম্পদ বিক্রি: নগদ অর্থের প্রয়োজনে পূর্বে ক্রয় করা স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করা যায়। স্থায়ী সম্পত্তি অনেক দিন ধরে ব্যবহার করলে এর উপযোগিতা কমে যায়। তাই এগুলো বিক্রি করে অর্থসংস্থান করা হয়। এটিও একটি অভ্যন্তরীণ উৎস। সাধারণত অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রি করে এ অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

খ. বাহ্যিক উৎস (External Sources): মালিকের বিভিন্ন সময় অর্থের প্রয়োজন হলে বিভিন্ন উৎস থেকে ধার বা ঋণ গ্রহণ করতে পারেন । একে অর্থায়নের বাহ্যিক উৎস বলে। মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত অর্থ যখন পর্যাপ্ত হয় না তখন অতিরিক্ত মূলধনের চাহিদা মিটাতে উদ্যোক্তা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা পাওনাদারদের কাছ থেকে ঋণের মাধ্যমে অর্থসংস্থান করতে পারে। এ অর্থ প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় উৎস হতে সংগ্রহ করা যায়।

প্রাতিষ্ঠানিক উৎস: প্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো: 

১. বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ: প্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক অন্যতম। নতুন শিল্প স্থাপন, ব্যবসায় সম্প্রসারণ, শিল্পের আধুনিকায়ন ইত্যাদি প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি অর্থায়ন করে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক বিশেষ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের চিন্তাও করে।

২. বিনিয়োগ ব্যাংকের ঋণ: শিল্পায়ন ও নতুন ব্যবসায় স্থাপনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে।

৩. বিমা কোম্পানি: বিমা কোম্পানি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো উদ্যোক্তাদের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল প্রদান করে থাকে। যেসব ব্যবসায়ে ঝুঁকি কম বিমা কোম্পানি সেই সব ব্যবসায়ে ঋণ দিয়ে থাকে।

৪ . পুঁজিবাজার: পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের অন্যতম উৎস। যৌথমূলধনী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে সম্প্রসারণের জন্য অতিরিক্ত মূলধনের প্রয়োজন মেটাতে জনসাধারণের নিকট থেকে মূলধন বাজারের মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

৫. বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান: ক্ষুদ্র, বৃহৎ ও মাঝারি সকল আকারের শিল্পে অর্থায়নের জন্য বিশেষায়িত কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন: বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে এনজিও প্রভৃতি। ক্ষুদ্র ব্যবসায় উদ্যোক্তাদেরকে তাদের ব্যবসায়ের বিল্ডিং তৈরিতে অর্থায়ন করে থাকে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ: প্রাতিষ্ঠানিক উৎস ছাড়াও ব্যক্তিগত বা দলীয়ভাবে অর্থায়নের কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস রয়েছে। যেখান থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান করতে পারে।

১. বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের মালিকরা সাধারণত ব্যবসায়ের প্রয়োজনে আত্মীয় - স্বজনের কাছ থেকে। টাকা ধার করতে পারে।

২. মহাজন ও সুদের কারবারি: উদ্যোক্তারা মহাজন ও সুদের কারবারিদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করতে পারে।

৩. বন্ধক; কখনও জরুরি নগদ অর্থ সঙ্কট দেখা দিলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের মালিকরা তাদের স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে যাণ গ্রহণ করতে পারে।

৪. ব্যবসা ঋণ: সাধারণত বাকিতে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে বিক্রেতা ক্রেতাকে সাময়িক অর্থসংস্থান করে। এক্ষেত্রে বিক্রেতা ক্রেতাকে নির্দিষ্ট সময় পর পণ্যের মূল্য পরিশোধের সুবিধা প্রদান করে থাকে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এটি অর্থসংস্থানের সবচেয়ে সহজ উৎস হিসেবে কাজ করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url