বৈদেশিক সাহায্যের ধারণা || Concept of Foreign Aid
বৈদেশিক সাহায্য কাকে বলে|What is Foreign Aid?
সাধারণত বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ঋণ ও অনুদানকে বৈদেশিক সাহায্য বলে। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য বিভিন্ন দাতা দেশ এবং সংস্থা থেকে যে ঋণ ও অনুদান পাওয়া যায় তাকে বৈদেশিক সাহায্য বলা হয়। এ সাহায্য খাদ্য, ওষুধ, প্রকল্প, দান, অনুদান, ঋণ, আর্থিক ও কারিগরি যেকোনো ভাবেই হতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সঞ্চয় বিনিয়োগ এবং আমদানি - রপ্তানি অপরিহার্য হয়ে পড়ায় জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু এদেশের জাতীয় আয়ের উৎস থেকে অর্জিত অর্থ দ্বারা অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা প্রায় অসম্ভব। তাই উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ সুবিধা প্রদান সাপেক্ষে একদেশ থেকে অপরদেশে সম্পদ হস্তান্তরকে বৈদেশিক সাহায্য বলে। ব্যাপক অর্থে বৈদেশিক সাহায্য বলতে সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে সাময়িকভাবে অর্থ সম্পদ ও কারিগরি সহায়তাকে বোঝায়।
বৈদেশিক সাহায্যের কারণ|Causes of Foreign Aid
বৈদেশিক সাহায্য প্রদানের কারণ মূলত তিনটি। যথা-
১. বাণিজ্যিক স্বার্থ
২. রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
৩. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
অধিকাংশ বৈদেশিক সাহায্য যে মানবিক কারণে দেওয়া হয় না তাতে কোনো সংশয় নেই। বৈদেশিক সাহায্য দেওয়ার সময় দাতাদেশ গ্রহীতাদেশের ওপর রাজনৈতিক শর্ত আরোপ করে কিংবা দেশের বৈদেশিক নীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
১. বাণিজ্য ব্যবধান দূর করা: দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নের জন্য একটি দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানির প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি আয় কম অথচ চলতি আমদানি বায় বেশি। অল্প পরিমাণ রপ্তানি আয় দিয়ে অধিক আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করা সম্ভব হয় না। ফলে বাণিজ্য ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এই ব্যবধান দূর করার জন্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ বাহ্যিক উৎস থেকে বিভিন্ন ধরনের মেয়াদি ঋণ বা সাহায্য গ্রহণ করে।
২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: অনেক সময় কোনো দেশ আকস্মিকভাবে বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় জে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য আমদানির বাড়তি বায় মেটানোর জন্য তারা বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করতে পারে।
৩. খাদ্য ঘাটতি পূরণ: অনেক দেশ আছে যাদের নিয়মিতভাবে খাদ্য ঘাটতি থাকে। এই খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য এসব দেশ বিদেশ থেকে খাদ্য সাহায্য গ্রহণ করে থাকে।
৪. কারিগরি ব্যবধান দূর করা: অনুন্নত দেশে অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি তুলনামূলকভাবে কম। অথচ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদন কৌশলও আধুনিক ও যুগোপযোগী নয়। এজন্য এসব দেশ কারিগরি ব্যবধান দূর করার জন্য বিদেশ থেকে কারিগরি সাহায্য নিতে পারে।
৫. সঞ্চয় - বিনিয়োগ ব্যবধান দূর করা: উন্নয়নশীল দেশে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কম। অথচ বিনিয়োগ চাহিদা বেশি বিনিয়োগ অপেক্ষা সঞ্চয় এসব দেশে কম হয়। একেই সসায় বিনিয়োগ ব্যবধান বলে। এই ব্যবধান দূর করার জন্য অনুন্নত দেশ বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করে থাকে।
৬. দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অর্থসংস্থান: দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্প দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক। এই লক্ষ্যেও কিছু দেশ বিভিন্ন বৈদেশিক উৎস থেকে সাহায্য গ্রহণ করে থাকে।
৭. দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি: বৈদেশিক মূলধন (সাহায্য) প্রবাহের মাধ্যমে সম্পদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জিত হয়। ফলে সাহায্য গ্রহণকারী দেশে উৎপাদন বাড়ে।
৮. সম্পদের কাম্য ব্যবহার: অনেক উন্নয়নশীল দেশে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। মূলধনের অভাবে এসব সম্পদের কাম্য ব্যবহার সম্ভব হয় না। বিদেশি সাহায্য বা ঋণ এরূপ সম্পদ উত্তোলন এবং কাম্য ব্যবহারে সহায়তা করতে পারে।
৯. বিনিয়োগ প্রসার: উন্নয়নশীল দেশে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীর ক্ষমতা সীমিত। তাই বৈদেশিক বিনিয়োগ এখানে যথেচ্ছ প্রয়োজন। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করার জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল।
১০. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন: দ্রুত উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বা সাহায্য। একটি দেশ তার বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যও প্রচুর বিদেশি সাহায্য ও ঋণ গ্রহণ করে থাকে।
বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতার অসুবিধা |Difficulty of relying on foreign aid
একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অতিমাত্রায় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ার অসুবিধা আলোচনা করা হলো:
১. বিদেশিদের স্বার্থ সংরক্ষণ: বিদেশি দাতা সংস্থা বা দেশগুলো নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তাছাড়া বিদেশি উদ্যোক্তাগণ তাদের অর্জিত মুনাফা নিজ দেশে প্রেরণ করে। ফলে অভ্যন্তরীণ সম্পদের এক বৃহৎ অংশ মুনাফা আকারে বিদেশে চলে যায়।
২. কঠিন শর্ত: বিভিন্ন দাতা বা সংস্থাসমূহ তাদের ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন শর্তারোপ করে। অনেক ক্ষেত্রে এসব শর্ত সাহায্য গ্রহণকারী দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
৩. উচ্চ সুদের হার : বৈদেশিক দাতা সংস্থা বা দেশসমূহ ঋণ সহায়তা প্রদানের সাথে সাথে উচ্চ হারে সুদ প্রদান শর্ত জুড়ে দেয়। ফলে ঋণের বিপরীতে সুদের হারও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। ফলে ঋণ গ্রহণকারী দেশের পক্ষে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের সুদ ছিল ০.৭৫ %। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে উক্ত ঋণের সুদ হয়েছে ২.০ %।
৪. সম্পদের অপব্যবহার: বিদেশি উদ্যোক্তাদের মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। তাই তারা যথেচ্ছাভাবে সম্পদের ব্যবহার করে। ফলে সম্পদের অপচয় বৃদ্ধি পেয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
৫. অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা : বৈদেশিক সাহায্যের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা দেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আনয়ন করে। বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অনেক সময় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া দেশের বাজেটের একটি বিরাট অংশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্য সময়মতো ও যে পরিমাণ প্রত্যাশা করা হয় তা পাওয়া যায় না। ফলে বৈদেশিক সাহায্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়।
৬. মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি : বৈদেশিক সাহায্যের নামে অনেক সময় উন্নয়নশীল দেশে অতিরিক্ত অর্থ আগমনের ফলে দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তথা মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়।
৭. পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি : বৈদেশিক সাহায্য একটি দেশকে পরনির্ভরশীল করে তোলে। এর ফলে দেশটি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে পিছিয়ে পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে সাহায্য নয় বাণিজ্যই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। অর্থাৎ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করা উচিত।