মুদ্রানীতির ধারণা| Concept of Monetary Policy

মুদ্রানীতি নীতি কী? What is Monetary Policy?

অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মুদ্রার ব্যবহার ও প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাথে সাথে কোন সুনির্দিষ্ট নীতি ব্যতীত যেহেতু কোন কাজই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয় না, তাই অর্থ সংক্রান্ত বিষয়েও কিছু নীতি প্রায় সকল দেশেই পালন করা হয়ে থাকে। দেশের অর্থ কর্তৃপক্ষ অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণের জন্য যে নীতির ব্যবস্থা করে তাই আর্থিক নীতি। এটাকে সংকীর্ণ অর্থে আর্থিক নীতি বলা হয়।

এই আর্থিক নীতির বিস্তৃত সংজ্ঞা প্রদান করেন Poul Einzing বলেন,
আর্থিক ও অনার্থিক লক্ষ্যে পরিচালিত সব রকমের আর্থিক ও অনার্থিক সিদ্ধান্ত এবং গৃহীত পদক্ষেপ যাদের দ্বারা দেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হয়, তাদের সমন্বিত রূপকে আর্থিক নীতি বলে।
এই বিস্তৃত নীতির ক্ষেত্রে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ নীতি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তবে আর্থিক নীতির বাস্তব সংজ্ঞা হচ্ছে, কতিপয় নীতির সমন্বয়, যার দ্বারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে অর্থের যোগান এবং পরোক্ষভাবে অর্থের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে।

মুদ্রা নীতির লক্ষ্য |Objectives of Monetary Policy 

কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে আর্থিক নীতির উদ্দেশ্য পরিচালিত হয়ে থাকে। ফলে বিভিন্ন দেশে ঐ উদ্দেশ্যের মধ্যে ভিন্নতা দেখা দেয়। তবে কতকগুলো মৌলিক উদ্দেশ্য আছে যা বিভিন্ন দেশে একইরূপ দেখা যায়। উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নে দেয়া হলো: 

১. মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা: আর্থিক নীতির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য দেশের অভ্যন্তরে দ্রব্য ও সেবার মূল্য স্থিতিশীল রাধা, এর দ্বারা দেশের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য অর্জিত হয়ে থাকে। এই অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য হচ্ছে এমন একটি অবস্থা, যে অবস্থায় সাধারণ কর্মহীনতা ও মুদ্রাস্ফীতি থাকে না। এই উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে আর্থিক নীতি তৈরি করার সময় একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রাখা হয়। আর এটাই হলো মূল্যের স্থিতিশীলতা।

২. বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা: বিনিময় হারের দ্বারা বাণিজ্যিক লেনদেন পরিচালিত হয়। প্রত্যেক দেশেরই বৈদেশিক বিনিময় হার স্থির রাখা প্রয়োজন। বিনিময় হারের উপর আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য বিশেষভাবে নির্ভরশীল এবং বিনিময় হারের বার বার পরিবর্তন অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এজন্য আর্থিক নীতি প্রয়োগ করে বিনিময় হার স্থির রাখা দরকার।

৩. নিরপেক্ষ আর্থিক নীতি: অধ্যাপক হায়েক এর মতে, অর্থের ভূমিকা সবসময় নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কারণ এতে হয় না। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সামস্তরের বৃদ্ধি বা হ্রাস উৎপাদনের বৃদ্ধি বা হ্রাস অনুযায়ী হয়। এতে বাণিজা চক্রের শীঘ্ৰে দামস্তরের সমন্বয় ঘটানো যায়।

৪. বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণ: মুদ্রানীতির একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণ। প্রায় দেশেই মুদ্রাস্ফীতি বা প্রা সংকোচন দেখা যায়। কিন্তু এ দু'টিই কোন সুস্থ অর্থনীতির কাম্য হতে পারে না। মুদ্রাস্ফীতির ও মুদ্রা সংকোচনের ফলে অর্থনীতিতে মূল্যস্তরের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যা অর্থনীতিতে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। ফলে কোন দেশে বাণিজ্য চক্র দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক নীতি ব্যবহার করা হয়। এ সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আর্থিক নীতিন একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।

৫. নিয়োগ বৃদ্ধি: আর্থিক নীতির লক্ষ্য দেশের উৎপাদন নিয়োগ বৃদ্ধি। কেইনসের মতে, দেশের আর্থিক নীতির লক্ষা হওয়া উচিত কিভাবে দেশে সম্পদের পূর্ণ নিয়োগ করা যায়। আর্থিক নীতি এমনভাবে পরিচালিত হতে হবে যাতে নিয়োগের নিম্নাবস্থা থেকে নিয়োগ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণ নিয়োগের লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। আবার আর্থিক নীতি এমনভাবে পরিচালিত হতে হবে যাতে নিয়োগ বাড়াতে গিয়ে দেশ আবার অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতির করলে যেন না পড়ে।

৬. বিনিয়োগ বৃদ্ধি: অর্থের যোগান বাড়িয়ে সুদের হার কমানোকে সুলভ মুদ্রানীতি বলে। মূলধনের প্রান্তিক দক্ষতা ও সুদের হারের উপর বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ভর করে। এর দ্বারা দেশের আয় এবং সার্বিক উন্নয়নের উপরও প্রভাব পড়ে। এজন্য মুদ্রাস্ফীতির একটি মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কিভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা যায়।

৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নই আর্থিক নীতির প্রধান উদ্দেশ্য। দেশের মোট দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার যোগানের সাথে মোট অর্থের চাহিদার ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব দেশের অর্থ কর্তৃপক্ষের উপর নাস্ত। যখন অতিরিক্ত আর্থের চাহিদা দেখা যায় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে, তখন অর্থ কর্তৃপক্ষকে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক নীতির লক্ষ্য হচ্ছে পুঁজি সংগঠন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা।

৮. পূর্ণ কর্মসংস্থান: বর্তমানে আর্থিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ণ নিয়োগের ব্যবস্থা করা। কেইনস বলেন, সুলভ আর্থিক নীতি এবং তৎসহ অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধির দ্বারা ঘাটতি ব্যয় পদ্ধতির মাধ্যমে কোন দেশ পূর্ণ কর্মসংস্থান প্রতিষ্ঠা করে অতি দ্রুত অর্থনীতিতে উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

মুদ্রানীতি বা আর্থিক নীতির সীমাবদ্ধতা|
Limitation of Monetary Policy 


যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আর্থিক নীতি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে প্রত্যেক দেশে এই নীতির কার্যকারিতা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এই নীতির কার্যকারিতার জন্য কয়েকটি বিষয় মেনে চলতে হয়। যেমন- আদিক নীতির সাফল্যের পিছনে প্রধান ভূমিকা পালনকারী দু'টি বিষয় হচ্ছে উন্নত আর্থিক ও মূলধন বাজার। কিন্তু বেশিরভাগ দেশগুলোতে এই আর্থিক ও মূলধন বাজারে অনুন্নত অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। যা আর্থিক নীতির কার্যকারিতাকে অনেকটা বাধাগ্রস্ত করে থাকে।

১. মূল্যন্তরের স্থিতিশীলতার ত্রুটি: আর্থিক নীতির লক্ষ্য হলো সাধারণ বা গড় মূল্যস্তর ঠিক রাখা। কিন্তু সাধারণ মূল্যস্তরের মধ্যে বিভিন্ন দ্রব্যের বিভিন্ন এককের মূল্যও নিহিত থাকে। সাধারণ মূল্যস্তর যেদিকে যায়, প্রতিটি প্রব্যের মূল্যও সেদিকে যাবে, এটি ঠিক নয়। কোন বিশেষ দ্রব্যের দাম বাড়লে বা কমলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে, যদিও গড় মূল্যস্তর অপরিবর্তিত থাকে।

২. বিনিময় হারের স্থিরতার ত্রুটি: বিনিময় হারের স্থিরতা রক্ষা করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ মলাপ্তরের স্থিতিশীলতা অবজ্ঞা করা হয়। কিন্তু সামগ্রিক জীবনযাত্রা অভ্যন্তরীণ মূল্যস্তরের উপর নির্ভর করে। অর্থের বহির্মুলা ও অভ্যন্তরীণ মূল্যের মধ্যে পৃথকীকরণ ঠিক নয়। দেশের অবস্থার প্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে বিধান করতে হবে। একটিকে অবজ্ঞা করে নয়।

৩. অর্থের নিরপেক্ষতাজনিত ত্রুটি: পরিবর্তনশীল অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক উত্থানপতন দূর করা এ নীতির দ্বারা সম্ভব নয়। এর দ্বারা কেবলমাত্র স্বল্পকালীন স্থিতিশীলতা অর্থনীতিতে মূল্যস্তর স্থির রাখা যায়। কেইনস ও তাঁর অনুসারীরা মদে করেন, বাণিজ্যিক চক্র আর্থিক কারণে ঘটে না। তাই আর্থিক নীতির মাধ্যমে বাণিজ্য চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

৪. বিনিয়োগ বৃদ্ধির ত্রুটি: সুদের হার কমলে জনগণ অমিতব্যয়ী হতে পারে। তখন তাদের সঞ্চয় প্রবণতাও কমে ফলে মূলধন গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুলভ আর্থিক নীতির ধারা ঘাটতি ব্যয়কে সমর্থন জানানো হয়। কিন্তু ঘাটতি ব্যয়ের মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা থাকে।

৫. নিয়োগ বৃদ্ধিজনতি ত্রুটি: অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিয়োগ বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেইনস পূর্ণ নিয়োগ অবস্থায় পৌছানোর জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তারল্য ফানের কারণে আর্থিক নীতির দ্বারা পূর্ণ পৌঁছানো যায় না। ফলে বিনিয়োগ, আয় ও নিয়োগ বাড়ে না।

৬. বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের ত্রুটি: মুদ্রানীতি মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর নির্ভরশীল। যেমন- আর্থিক ব্যবস্থা ঋণের উপর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। আবার বায়ের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে। বায় উৎপাদনের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে। সর্বশেষে উৎপাদন দ্রব্যমূল্যের উপর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। কিন্তু বিভিন্ন দেশগুলোতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর কোন সমন্বয় থাকে না। এজন্য সব দেশে মুদ্রাস্ফীতি সফলভাবে কার্যকরী হতে পারে না।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বিষয়গুলো কার্যকরী হলে সঠিকভাবে মুদ্রানীতি কার্যকরী হয় না।

মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর


Q. মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার কারণ কি?

উত্তর: মুদ্রাস্ফীতি প্রধানত দুটি কারণে হয়ে থাকে।
১) চাহিদা জনিত এবং
২) মূল্য জনিত।

উভয়ই কোন দেশের অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধির জন্য সমানভাবেই দায়ী, তবে ভিন্নভাবে কাজ করে। যখন কোন পণ্যের চাহিদা গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়ে তখন "চাহিদা জনিত" কারণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে পণ্যের সরবরাহ ব্যয় বেড়ে গেলে মূল্য জনিত মূল্যবৃদ্ধি হয়।

Q. ধাবমান মুদ্রাস্ফীতি (running inflation) কি?

উত্তর: মুদ্রাস্ফীতির হার যখন দৌড়ে চলে এবং ক্রমেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাকে ধাবমান মুদ্রাস্ফীতি বলে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url