সরকারি ঋণের ধারণা| Concept of Public Debt
সরকারি ঋণ কী| What is Public Debt
সরকারি ঋণ বলতে দেশের সরকার কর্তৃক গৃহীত ঋণকে বুঝায়। কোন দেশের সরকার যদি দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তি বিশ্লেষ বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে কিংবা বিদেশ হতে ঋণ গ্রহণ করে তবে তাকে সরকারি ঋণ বলা হয়।
বর্তমান যুগে জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য সরকারকে বহুবিধ কাজ সম্পাদন করতে হয়। এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের দরকার হয়। সরকার বিভিন্ন উৎস হতে যে রাজস্ব বা আয় পায় তা দ্বারা অনেক সময় এসব ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় সরকার দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বিদেশ হতে ঋণ গ্রহণ করে জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করে থাকে।
সুতরাং বর্ধিত জাতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন দেশের সরকার ঋণ পত্র বিক্রয় করে অথবা অন্য কোন উপায়ে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বিদেশ হতে যে ঋণ গ্রহণ করে তাকে সরকারি ঋণ বলা হয়। সরকার দেশের মধ্যে জনগণের নিকট বা সংস্থা হতে কিংবা বিদেশি সংস্থা অথবা বিদেশি সরকারের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করে।
Findlay Sirass এর মতে,
National debt is a debt which a state owes to its subjects or nationals of the countries.
পরিশেষে বলা যায়, সরকার কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ঋণকে সরকারি ঋণ বলে চিহ্নিত করা হয়।
সরকার ঋণ গ্রহণ করে কেন? Why does the Government Borrow
প্রত্যেক দেশের সরকার জাতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য বিভিন্ন উৎস হতে রাজস্ব সংগ্রহ করে । কিন্তু সংগৃহীত রাজস্ব দ্বারা অনেক সময় সরকারি ব্যয় মিটান সম্ভব হয় না । এ অবস্থায় সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয় । নিয়ে সরকারের ঋণ গ্রহণের বিভিন্ন কারণ আলোচনা করা হলো :
১. সামরিক ঘাটতি পূরণ: প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য সরকারকে নিয়মিত অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু সরকার নিয়মিতভাবে আয় পায় না। ফলে সরকারের আয় - ব্যয়ে অর্থের ঘাটতি পড়ে। এরূপ সাময়িক ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
২. জরুরি অবস্থা মোকাবিলা: অর্থনীতিতে জরুরি অবস্থা দেখা দিলে তা মোকাবিলা করতে তড়িঘড়ি করে চিরাচরিত উৎস থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। অর্থনীতিতে জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ বিভিন্ন রকম অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যা কোন নিয়ম মাফিক বিষয় নয়। এরূপ অবস্থা মোকাবিলার জন্য সরকার রাজস্ব প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষা করতে পারে না। তাছাড়া রাজস্ব আয় দ্বারা এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করাও সম্ভব নয়। কাজেই জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
৩. ঘাটতি বাজেট পুরণ: সরকারের বাজেটে আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলা হয়। অনেক সময় সরকারের আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হয়। ফলে বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়। বাজেটের এরূপ ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুদৃঢ় সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বলতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, বিদ্যুৎ, পরিবহন ও যোগাযোগ ইত্যাদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক বিষয়ের উন্নয়ন সাধনকে বুঝায়। এসবের উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। সরকারকে ঋণ গ্রহণ করে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো গঠন ও এদের উন্নয়নের ব্যবস্তা করতে হয়।
৫. যুদ্ধ ব্যয় নির্বাহ: অনেক সময় এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের যুদ্ধ বাধে। তাছাড়া বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই সবসময় লক্ষ্য করা যায়। কাজেই সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা ও যুদ্ধের বায় নির্বাহ করার জন্য প্রচুর অর্থের দরকার হয়। জনগণের উপর কর ধার্য করে এ জাতীয় ব্যয় নির্বাহ করা মোটেই সম্ভব নয়। সুতরাং যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ, সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালীকরণ প্রভৃতির দরুন সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
৬. মন্দাভাব দূরীকরণ: অর্থনীতিতে অনেক সময় মন্দাভাব দেখা দেয়। এসময় জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং অসং শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবনের জন্য সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হয়। মন্দার সময় জনসাধারণের আয় কমে যাওয়ায় করের মাধ্যমে অর্থের সংস্থান করা সম্ভব হয় না। সুতরাং সরকারকে ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগ বাড়াতে হয়। এতে অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়, অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং মন্দাভাব দূরীভূত হয়।
৭. দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি: সরকারি ঋণ বেসরকারি বিনিয়োগের সবচেয়ে নিরাপদ ক্ষেত্র। সরকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র যেমন- প্রাইজবন্ড, প্রতিরক্ষা সঞ্চয় পত্র, বোনাস সঞ্চয় পত্র, ওয়েজ আর্নার বন্ড, ট্রেজারি বিল ইত্যাদি জনগণের মধ্যে বিক্রি করে ঋণ গ্রহণ করে। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে জনগণের সঞ্চয় প্রবণতা ও বিনিয়োগ প্রবণতা বেড়ে যায়, যা উন্নয়নশীল দেশের সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে।
৮. কল্যাণমূলক কর্মসূচির বাস্তবায়ন: দেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য সরকারকে অনেক কল্যানমূখী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়; যেমন- শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ প্রদান, খাবার পানি সরবরাহ বৃদ্ধ বয়সে পেনশন, বেকার ভাতা, দুর্যোগের সময় সাহায্য দান ইত্যাদি। এসব কল্যাণমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য সরকারের বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব ব্যয় মেটানোর জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করে।
৯. মুদ্রাস্ফীতি রোধ: মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এতে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট বাড়ে এবং অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় দেশের মধ্যে যাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ আছে তাদের নিকট হতে সরকার ঋণ গ্রহণ করে। ফলে বাজারে অর্থের প্রচলনের গতি হ্রাস পায়, জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় এবং মুদ্রান্কীতি রোধ করা সম্ভব হয়।
১০. আয় বৈষম দূরীকরণ: সরকার দেশের সম্পদশালী লোকদের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করে দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণকর ও দেশের উন্নয়নমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করতে পারে। ফলে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের আয় বৈষম্য অনেকাংশে দূর হয়।
১১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় আয় খুবই কম। তাই দেশে মূলধন দুষ্প্রাপ্য। এ অবস্থায় সরকারকে দেশ ও বিদেশ হতে ঋণ গ্রহণ করে পরিকল্পনার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনা হতে দেখা যায় যে, সরকারকে বহুমুখী কাজ সম্পাদনের জন্য ঋণ গ্রহণ করতে হয়। দেখা যায় যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের জনসাধারণ অত্যন্ত দরিদ্র এবং এসব দেশে সম্পদের পরিমাণ খুবই কম। কাজেই দেশের ক্রমবর্ধমান সমস্যাবলির সমাধান তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। সরকারি ঋণের উপযুক্ত ব্যবহারের ফলে দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হয়। ফলে উৎপাদন বাড়ে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির হার ত্বরান্বিত হয়। তবে ঝণের ব্যবহার সম্পর্কে সরকারের সতর্কতা অবলম্বন করা বিশেষ দরকার।