সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ধারণা || Concept of Socialistic Economy

সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রবক্তা হলেন জার্মান বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্কস এবং দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ (লেনিন) -এর নেতৃত্বে রাশিয়ায় সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়। এরপর ১৯২৩ সালে NEP (New Economic Policy) - এর মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তারপর ১৯৩০ সালে জোসেফ স্ট্যালিন রাশিয়ায় মার্কসীয় অর্থনীতির মাধ্যমে Stalinist Growth Model নামে Planned বা Command বা Socialistic Economy চালু করেন। ১৯৮৫ সালে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে এ অর্থনীতির অবসান ঘটে। নির্দেশমূলক বা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা হলো এমন এক ধরনের অর্থব্যবস্থা যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির পরিবর্তে রাষ্ট্রের কাছে থাকে এবং উৎপাদিত পণ্য সমাজের মানুষের কাজের পরিমাণ ও যোগ্যতা অনুযায়ী বণ্টিত হয়।

নোবেল বিজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ পল এ. স্যামুয়েলসন - এর মতে,
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হলো এমন এক ধরনের অর্থনীতি যেখানে শ্রম ব্যতীত উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের মালিকানা সমাজের হাতে থাকে।
এ সমাজে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি বিরাজ করে। বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্রে উপকরণের ব্যক্তি মালিকানা নেই। এরূপ অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে কোন কোন দ্রব্য ও সেবা কী পরিমাণে, কোথায় এবং কীভাবে উৎপাদিত হবে তা নির্ধারণ করে। আবার দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সম্পদের বণ্টন এবং উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বণ্টন একই কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও (Command Economy) বলা হয়। উত্তর কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা এবং পূর্ব ইউরোপের (পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া) দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ Characteristics of Socialistic Economy


১. সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা: সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় জমি, কল-কারখানা, খনি ও অন্যান্য সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা বজায় থাকে। রাষ্ট্র সব সম্পদের মালিক। এক্ষেত্রে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে না।

২. শ্রেণি শোষণ অনুপস্থিত: যেহেতু সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রীয় বা যৌথভাবে সমাজের সেজন্য শ্রমিক শ্রেণি শোষিত হয় না।

৩. বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি: সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় চাহিদা ও যোগানের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হয় না। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিটি পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়।

৪. কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: সমাজতন্ত্রে ভোক্তার বা ক্রেতার চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এরূপ ব্যবস্থায় কী কী দ্রব্য উৎপন্ন হবে, কীভাবে উৎপন্ন হবে এ সব প্রশ্ন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষই নির্ধারণ করায় এবং ঐ সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী ক্রেতারা ক্রয় করতে বাধ্য থাকে।

৫. আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন: তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্রের বণ্টননীতি হলো ‘প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী' (to all according to his needs)। তবে বাস্তবে সমাজতান্ত্রিক দেশে যে নীতি চালু আছে তা হলো প্রত্যেকে পাবে তার কাজ অনুযায়ী (to all according to his works)। এ অর্থব্যবস্থায় সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনায় রেখে রেশন কার্ডের মাধ্যমে আয় ও সম্পদ বণ্টন করা হয়।

৬. কাজের পরিমাণ ও গুণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক বণ্টন: ধনতন্ত্রের ন্যায় সমাজতন্ত্রে শ্রমের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে শ্রমিকের মজুরি নির্ধারিত হয় না। বরং কাজের পরিমাণ ও গুণগত মান অনুযায়ী শ্রমিকের মজুরি প্রদান করা হয়।

৭. স্বতঃস্ফূর্ত উৎপাদন পদ্ধতি: উপকরণের মালিকানা সামাজিকভাবে স্বীকৃত হওয়ায় মালিক - শ্রমিক ব্লতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। ফলে উৎপাদন শক্তি (Productive force) এবং উৎপাদন সম্পর্ক এর মধ্যে কোনো বিরোধ থাকে না।

৮. সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ: সমাজতন্ত্রে উৎপাদন কার্যক্রম মুনাফাভিত্তিক পরিচালিত না হয়ে সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ উৎপাদনের লক্ষ্য মুনাফা অর্জন নয়, বরং সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ অর্জন।

৯. কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা: সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সকল অর্থনৈতিক কার্যকলাপ; যেমন- উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন প্রভৃতি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত সকল তথ্যের ভিত্তিতে এ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে।

১০. সামাজিক নিরাপত্তা: সমাজতন্ত্রে মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমাজের সব সদস্যকে জীবনের সকল ঝুঁকির বিরুদ্ধে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে।

১১. শোষণমুক্ত সমাজ: সমাজতন্ত্র শ্রেণিহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। সমাজতন্ত্রে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত নয় বলে এখানে শোষণের কোনো সুযোগ নেই।

১২. সুষম উন্নয়ন: যেহেতু কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নীতি - নির্ধারণ এবং কার্যক্রম গৃহীত হয়। তাই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন আঞ্চলিক পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে এখানে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।

১৩. মুদ্রাস্ফীতি: সমাজতন্ত্রে সর্বক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। তাই এখানে অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদন হতে পারে না বলে মুদ্রাস্ফীতির উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না।

১৪. কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা: সমাজতন্ত্রে যেহেতু উৎপাদন কার্য কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা অনুসারে হয়ে থাকে এবং নাগরিকের সকল প্রকার নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকার বহন করে সেহেতু কোনো নাগরিকের কর্মসংস্থানের অভাব হয় না।

১৫. ভোক্তার চাহিদার ওপর নিয়ন্ত্রণ: সমাজতন্ত্রে দ্রব্যের চাহিদা ক্রেতার নির্বাচন বা পছন্দের ওপর নির্ভর করে না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদিত হয় এবং বাজারে বিক্রির জন্যে ছাড়া হয় এসব দ্রব্যের দামও সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে এবং ক্রেতা সরকার নির্ধারিত দামে দ্রব্য ক্রয় করতে বাধ্য হয়।

১৬. আর্থ - সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের সমন্বয় সাধন: সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ও বণ্টন নিশ্চিত করে সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ অর্জন ব্যক্তির স্বার্থ নয়।

একথা সত্য যে, বর্তমান বিশ্বে বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র ও বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কোনোটির অস্তিত্ব নেই। এছাড়াও এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের অপচয় কম হয়, কল্যাণ বৃদ্ধি পায় ফলে মানুষের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url