রাজস্বনীতি কী| Definition for fiscal policy
রাজস্বনীতি কী? What is Fiscal policy?
রাজস্বনীতি বলতে সরকারের আয়-ব্যয় এবং ঋণ সংক্রান্ত নীতিকে বুঝানো হয়। সংক্ষেপে বলা যায় যে, সরকারের আয় - ব্যয় সংক্রান্ত নীতিই রাজস্বনীতি। সরকার জনগণের কল্যাণে আয়, নিয়োগ, উৎপাদন, দমস্তর করনীতি, ব্যয়নীতি, বাজেট নীতি, ঋণনীতি প্রণয়ন করে থাকে। আর এগুলোর সমন্বিত রূপকে রাজস্বনীতি বলা হয়। নিচে কতিপয় অর্থনীতিবিদ এর সংঙ্গা প্রদত্ত হলো:
অধ্যাপক হিক্সের মতে,
রাজস্বনীতি এমন একটা নীতি যা অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারি অর্থব্যবস্থা সমস্ত উপাদানকে কাজে লাগায়।
অধ্যাপক টেইলর এর মতে,
ফিস্ক শব্দটির অর্থ হলো রাজকোষ বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কোষাগার যেসব নীতি নির্ধারণ করেন সামগ্রিকভাবে তাদের রাজস্বনীতি বলে।
অধ্যাপক আর লিন্ডহল এর মতে,
সরকার কখন কোন প্রকার রাজস্ব কোন পদ্ধতিতে সংগ্রহ করবে এবং কোন পদ্ধতিতে ঐ রাজস্ব ব্যয় করবে তা নিয়েই রাজস্বনীতি আলোচনা করে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সরকারের আয়-ব্যয়, ঋণনীতি, করনীতি ইত্যাদির সংযুক্ত রূপই রাজস্বনীতি।
রাজস্বনীতির লক্ষ্য|Objectives of Fiscal policy
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর রাজস্বনীতি লক্ষ বা উদ্দেশ্য নির্ভর করে। একটি দেশে গতি প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে রাজস্বনীতি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বহুবিধ হয়ে থাকে। নিচে এগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: উন্নয়নশীল দেশের প্রধান সমস্যা হলো অনুৎপাদনশীল খাতে অধিক ব্যয়ের প্রবণতা। অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হয়। সরকার এক্ষেত্রে করণীতি এমনভাবে করবে যাতে করে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের পরিমান হ্রাস পায়। সরকারের উচিৎ ব্যয়নীতি উন্নয়নশীল খাতে করা যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত হয়।
২. মূলধান গঠন: অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান মুলধন গঠন। মূলধন গঠন বৃদ্ধি পাবে যদি জনগণের সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে দরিদ্র শ্রেণীর সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য কর রেহাত দেয়া এবং ধনী শ্রেণীর উপর বিলাসজাত দ্রব্যের তৌগ হ্রাসে কর হার বৃদ্ধি করে নিরুৎসাহিত করা। সরকার রাজস্বনীতি এমনভাবে প্রয়োগ করবে যাতে ভোগ ব্যয় হ্রাস পায় সন্ধ্যা বৃদ্ধি যা মূলধন গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
৩. নিয়োগ বা কর্ম সংস্থান সৃষ্টি: নিয়োগ বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে রাজস্বনীতি ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করলে নিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশে উদ্বৃত্ত শ্রমকে শিল্প ক্ষেত্রে স্থানান্তরের মাধ্যমে কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। সরকার সম্প্রসারণ মূলক নীতির দ্বারা নিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
৪. মন্দা ও বেকারত্ব দূরীকরণ: মন্দা ও বেকারত্ব দূরীকরণে সরকাররে রাজস্বনীতি ভূমিকা অনস্বীকার্য। সম্প্রসারণ মূলক রাজস্বনীতি গ্রহণের ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি করে আয় ও নিয়োগ বৃদ্ধি করতে পারে যা মন্দা ও বেকারত্ব হ্রাস করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে থাকে।
৫. অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ: আয়ের সম বন্টন রাজস্বনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য সমাজে কাম্য নয়। সেই বৈষম্য দূরীকরণে প্রগতিশীল কর এবং হস্তান্তর ব্যয় ভূমিকা রাখে।
৬. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: মুদ্রাস্ফীতির ফলে সমাজে বিভিন্ন প্রকার বিরূপ প্রভাব পড়ে যা অর্থনীতিতে কাম্য হতে পারে না । সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারী ব্যয় হ্রাস করতে পরে, করের পরিমান বৃদ্ধি করতে পারে, এবং জনগণকে সঞ্চয়ী রতে বাধ্য করতে পারে ফলে সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পায় যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
৭. মুদ্রা সংকোচন নিয়ন্ত্রণ: মুদ্রা সংকোচনের দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পার ফলে সঞ্চয় হ্রাস পায় মূলধন গঠন কমে যায়। সরকার মুদ্রা সংকোচন নিয়ন্ত্রণে সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি, করের হার হ্রাস করতে পারে কলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। একারণে মুদ্রা সংকোচন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
৮. আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আর্থ সামাজিক কাঠামো উন্নত হওয়ার দরকার। সে লক্ষ্যে রাজস্বনীতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, জ্বালানী, বিদুৎ, যোগাযোগ, পানি ইত্যাদি বিষয়সমূহ আধুনিকরণের মাধ্যমে টেকসই ভিত্তি রচনা করে। এগুলোর উন্নতি হলে দেশের টেকসই উন্নয়ন হবে।
৯. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজস্বনীতির আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো বেকারত্ব সর্বনিম্ন স্তরে রেখে মূল্যস্ত রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এক্ষেত্রে চক্রবিরোধী রাজস্বনীতি ভূমিকা রাখে।
১০. সামাজিক নিরাপত্তা: সরকার রাজস্বনীতি মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী যেমন বেকারভাতা, দুঃস্থভাতা, প্রতিবন্দি ভাতা ও বয়স্কভাতা ইত্যাদি গ্রহণ করতে পারে।
উপর্যুক্ত আলোচনা দেখা যায়, এই পদ্ধতিগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা গেলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবসম্ভাবী হবে।
রাজস্বনীতির হাতিয়ারসমূহ|Instruments of Fiscal Policy
সরকার তার আয়-ব্যয় ঝর্ণনীতি ইত্যাদি বাস্তবায়নে তথা রাজস্বনীতির জন্য কিছু হাতিয়ায় ব্যবহার করে থাকে। এগুলো সংক্ষেপে নিচে আলোচনা করা হলো:
১. সরকারি ব্যয়: রাজস্বনীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হয় কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন দেওয়া। এছাড়াও বয়স্ক ভাতা, বেকার ভাতা, পেনশন, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাতে সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ ব্যয় করে থাকে। এসব বায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
২. কর রাজস্ব: কর রাজস্ব হচ্ছে রাজস্বনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কর থেকে সরকারী রাজস্ব সংগ্রহিত হয়। সরকার প্রত্যক্ষও পরোক্ষ কর আরোপ করে রাজস্ব আদায় করে থাকে। সরকার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সংগতি রেখে কর হার হ্রাস বৃদ্ধি করে থাকে। আবার কখন সমানুপাতিক, প্রগতিশীল, বা আধাগতিশীল ধরনের করনীতি গ্রহণ করে থাকে। কর আরোপের দ্বারা জনগণ এর ভোগ, বিনোয়োগ, সঞ্চয়, আয় উৎপাদন ও নিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ে।
৩. ভর্তুকী: সরকার অনেক সময় উৎপাদনশীল খাতে জনগণকে ভর্তুকী দিয়ে সাহায্য করে তাকে। উৎপাদকদের যেমন ভতুকী দিয়ে উৎপাদনে সাহায্য করে তেমনি ভোক্তাদের উপর ভতুর্কী দিয়ে দ্রব্য ক্রয়ে সাহায্য করে থাকে। সাধারণত দেশে কৃষি, শিল্প চিকিত্না খাতে ভর্তুকী দিয়ে থাকে।
৪. সরকারি ঋণ: সরকারী ঋণ রাজস্বনীতির একটি গুরুত্ব পূর্ণ হাতিয়ার। সরকার তার ঘাটতি ব্যয় নির্বাহ করার জন্য দেশের অভ্যন্তর হতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে ঋণ নিয়ে থাকে আবার অনেক সময় বৈদেশিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। এসব ঋণ সরকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল খাতে ব্যয় করে।
৫. হস্তান্তর ব্যয়: একটি দেশের সরকারকে অবসর ভাতা, দুঃস্থদের ভাতা, বেকার ভাতা, সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এসব ব্যয়কে হস্তান্তর ব্যয় বলা হয়। হস্তান্তর ব্যয় বৃদ্ধি পেলে জনগণের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমান বাড়ে।
উপর্যুক্ত বিভিন্ন হাতিয়ার গ্রহণের মাধ্যমে সরকার তার রাজস্বনীতি পরিচালনা করে থাকে।
উপর্যুক্ত বিভিন্ন হাতিয়ার গ্রহণের মাধ্যমে সরকার তার রাজস্বনীতি পরিচালনা করে থাকে।