মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়|How to control inflation

মুদ্রাস্ফীতি সমাজে আয় বণ্টনের বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করে, সামাজিক অসন্তোষের সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতিতে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাপত্রকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১. আর্থিক নীতি
২. রাজস্ব নীতি এবং
৩. অন্যান্য ব্যবস্থা

১. আর্থিক নীতি (Monetary Policy): মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। বর্তমান ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে এ লেনদেন হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক নীতির সাহায্যে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করে থাকে: 
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়
ক. ব্যাংক হার বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয় তাকে ব্যাংক হার বলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যাংক হার বাড়ালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও তাদের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণ ব্যয়সাধ্য হয়ে পড়ে এবং ঋণের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এভাবে মুদ্রাস্ফীতির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে।

খ. খোলাবাজার নীতি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় খোলাবাজারে সরকারি ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যাংক সৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে। খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রয় করলে ক্রেতাগণ তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর চেক কেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাওনা মিটিয়ে থাকে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যায়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রয় করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। 

গ. সংরক্ষণের হার বৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ জমার অনুপাত বা সংরক্ষণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের নগদ অর্থের পরিমাণ কমে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা কমায় বাজারে অর্থের যোগান হ্রাস পায়, জনগণের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ কমে, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, দামস্তর কমে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। 

২. রাজস্ব নীতি (Fiscal Policy): বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক নীতি অপেক্ষা রাজস্ব নীতি অনেক বেশি কার্যকরী। লর্ড কেইস সর্বপ্রথম এ নীতি অবলম্বন করার পরামর্শ দেন। মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত ব্যয়। কাজেই ব্যয়ের পরিমাণ কমাতে পারলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাজস্ব নীতির মধ্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো প্রধান: 

ক. সরকারি ব্যয় হ্রাস: মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে দিতে পারে। আবার, সমতা বাজেট বা উদ্বৃত্ত বাজেট নীতি গ্রহণ করে সরকারি ব্যয় হ্রাস করতে পারে। এর ফলে অর্থনীতিতে আর্থিক প্রবাহ কমে এবং সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পায়। ফলে দামস্তর কমে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। 

খ. করের পরিমাণ বৃদ্ধি: চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার জনগণের ওপর আরোপিত করের মাত্রা বৃদ্ধি করে কিংবা নতুন নতুন কর আরোপ করে জনগণের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমাতে পারে। ফলে বাজারে পণ্যসামগ্রী ও সেবার চাহিদা কমে সামগ্রিক চাহিদা কমে দামস্তর হ্রাস পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে।

গ. ভর্তুকি: অর্থনীতিতে খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে বা উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে সরকার উৎপাদন ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করতে পারে। এর ফলে ৎপাদন খরচ কমে। উৎপাদন তথা সামগ্রিক যোগান বাড়ে, দামস্তর কমে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে।

ঘ. অভ্যন্তরীণ ঋণ: মুদ্রাস্ফীতির সময়ে সরকার দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে। এর ফলেও অর্থনীতিতে আর্থিক আয় প্রবাহ কমে, সামগ্রিক চাহিদা হ্রাস পায়, দামস্তর কমে ও মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়। 

৩. অন্যান্য ব্যবস্থা: রাজস্ব নীতি ও আর্থিক নীতিসহ সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যেমন: 

ক. সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ: সরকার পণ্যসামগ্রী ও সেবার সর্বোচ্চ দামসীমা বেঁধে দিতে পারে। এর ফলে দামস্তর একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে পারে না। অবশ্য এক্ষেত্রে গোপনে কালোবাজারি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমস্যা আরও গভীর হয়। 

খ. উৎপাদন বৃদ্ধি: ব্যবহৃত ও অব্যবহৃত সম্পদের উৎকৃষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে দামস্তর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় ও কম উৎপাদন ক্ষেত্র হতে প্রয়োজনীয় ও বেশি উৎপাদন ক্ষেত্রে সম্পদ স্থানান্তর করতে পারলে উৎপাদন হার বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি রোধ হবে। 

গ. ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন: সরকার মুদ্রাস্ফীতির সময় বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে ন্যায্যমূল্যে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে বাজারে বেসরকারি খাতে চাহিদার চাপ কমে দামস্তর হ্রাস পাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

ঘ. মজুরি নিয়ন্ত্রণ: মুদ্রাস্ফীতির সময় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মজুরির হার বাড়ানোর জন্য মালিকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। তাদের অধিক মজুরি দেওয়ার ফলে উৎপাদন ব্যয় ও মূল্যস্তর বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে সরকার আইন করে মজুরি হারের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে। 

ঙ. আমদানি বৃদ্ধি: মুদ্রাস্ফীতির সময় আমদানির পরিমাণ বাড়ালে বাজারে দ্রব্যের যোগান বাড়বে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমে যাবে। এ জন্য মুদ্রাস্ফীতির সময় আমদানি শুল্ক কমিয়ে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি করে দ্রব্যমূল্য হ্রাস করা যায়। 

চ. গচ্ছিত অর্থ আটক: মুদ্রাস্ফীতির সময় জনসাধারণ বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিরা যাতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে না পারে সেজন্য অনেক সময় সরকার তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ সাময়িকভাবে আটক করে রাখে। এর ফলে এ অংশ ব্যয় করা সম্ভবপর হয় না। ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমে। 

ছ. মুদ্রা অবৈধকরণ: মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করলে অনেক সময় পুরাতন মুদ্রা পরিত্যাগ করে নতুন মুদ্রা চালু করে বেশি মূল্যের নোটকে অচল করে দেওয়া হয়। সুতরাং আলোচনায় বলা যায় যে, এককভাবে কোনো পদ্ধতি দ্বারা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন সরকার কর্তৃক রাজস্ব ও আর্থিক নীতির সমন্বয় সাধন, প্রত্যক্ষ পদ্ধতি অবলম্বন এবং উপযুক্ত সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url