অর্থায়নের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ| Origin & Evolution of Finance

অর্থায়নের উৎপত্তি এবং এর ইতিহাস দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমার ফল। আদিম স্তর থেকে প্রত্যক্ষ বিনিময় ব্যবস্থা তা থেকে মুদ্রার প্রচলন ও ব্যবহার, তা থেকে বাজারজাতকরণ এবং বর্তমানে বৃহদায়তন উৎপাদন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। ফলে অর্থায়নের প্রক্রিয়াকে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলে বিবেচনা করা যায়। অর্থায়নকে অর্থনীতির একটি শাখা হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ১৮৯৭ সালে ব্যবসায় অর্থায়ন আলাদা বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পায়। নিচে অর্থায়নের ক্রমবিকাশ উল্লেখ করা হল-

ব্যবসায় একত্রীকরণ, আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতকরণ ও বিশ্লেষণ (১৮৯০-১৯০০): ১৮৯০ সাল থেকে ১৯০০ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিগুলোর একত্রীকরণের প্রবণতা শুরু হয়। আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন প্রতিষ্ঠানের একত্রীকরণ হওয়া উচিত এ সংক্রান্ত রূপরেখা দিতে আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তারা এ একত্রীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান ও আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে কার্য সম্পাদন করে। ফলে অর্থসংস্থান একটি স্বতন্ত্র কার্যক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ (১৯০০-১৯১০): এ সময়ে অর্থনৈতিক মহামন্দা দেখা দেয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য ব্যবসায় অর্থসংস্থান, তারল্য ও পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। 

ব্যবসায়ের ওপর এরূপ নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়ায় অর্থ সরবরাহকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রতি খেয়াল রেখে আর্থিক তথ্যাদি প্রকাশ শুরু করা হয়।

শিল্পবিপ্লব ও প্রযুক্তিগত উন্নতি (১৯১০-১৯২০): ১৯১৩ সালে হেনরি ফোর্ডের সাফল্য ব্যাপক উৎপাদন প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং পূর্ণাঙ্গ শিল্পের আবির্ভাব হয়। শিল্পগুলোতে অধিক পরিমাণ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হওয়ার ফলে অর্থায়ন ও সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের সমস্যা এবং বিশেষ করে তারল্য সমস্যা বেশি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হতো।

কম্পিউটার ও বিশ্লেষণধর্মী পদ্ধতির প্রয়োগ (১৯২০-১৯৩০): আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক তথ্য বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবিকাশের এ পর্যায়ে আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয়। অপারেশন রিসার্চ ও সিদ্ধান্ত তত্ত্ব প্রভৃতি বিশ্লেষণধর্মী পদ্ধতির প্রয়োগে আর্থিক সম্ভাব্যতা নিখুঁতভাবে যাচাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

মহামন্দা এবং উত্তরণ (১৯৩০-১৯৪০): আগের দশকগুলোতে একত্রীভূত অনেক কোম্পানি এ দশকে দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে শেয়ার বাজারে কোম্পানিগুলোর বড় দরপতন ঘটে এবং অনেক লাভজনক কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় পড়ে যায়। ফলে অর্থনীতিতে মহামন্দা দেখা দেয়। এ দশক থেকেই মহামন্দার হাত থেকে রক্ষার জন্য মূলধন সংরক্ষণ, তারল্য সংরক্ষণ, দেউলিয়াত্ব প্রতিরোধ প্রভৃতি আর্থিক ব্যবস্থাপনার মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

বাহ্যিক অর্থসংস্থানের ওপর গুরুত্ব প্রয়োগ (১৯৪০-১৯৫০): সর্বপ্রথম এ দশকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ প্রকল্প মূল্যায়নে মূলধন বাজেটিং -এর প্রয়োগ শুরু করে। উপযুক্ত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ করার ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য বাহ্যিক পক্ষসমূহ কীভাবে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কর্মকাণ্ডকে মূল্যায়ন করছে প্রতিষ্ঠানসমূহ তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে।

আধুনিক অর্থসংস্থানের উন্নয়ন (১৯৫০-১৯৬০): এ সময়ে কোম্পানি অর্থসংগ্রহের জন্য মূলধন বাজারকে প্রাধান্য দিতে থাকে। অধ্যাপক Modigani এবং Miller- এর মূলধন কাঠামো তত্ত্ব অর্থায়নের অগ্রগতিতে পথ প্রদর্শক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ সময়ে অর্থায়নের ঝুঁকির ধারণা বুঝিয়ে দেয় যে, মুনাফা বৃদ্ধির সাথে ঝুঁকির পরিমাণও বৃদ্ধি পায় । পরবর্তীতে অধ্যাপক Hary Markowitz এবং William Sharpe ঝুঁকির ধারণার ওপর ভিত্তি করে যুগান্তকারী ‘পত্রকোষ তত্ত্ব' প্রকাশ করেন।

কম্পিউটার প্রযুক্তির যাত্রা (১৯৬০-১৯৭০): এ দশকে কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে অর্থায়ন বিশ্লেষণে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। এ দশকে অধ্যাপক William Sharpe তার 'পত্রকোষ তত্ত্ব' পুনঃসংস্কার করে Capital Asset Pricing Model উদ্ভাবন করেন। তাছাড়া ১৯৭০ সালে ব্লাক এবং শোলস অপশন মডেল উদ্ভাবন করেন।

অর্থায়নের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি (১৯৭০-১৯৮০): ব্যবসায় সম্প্রসারণ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য অর্থায়ন তার সনাতনী ধারা পরিবর্তন করে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। ১৯৭৮ সালে Ross তার Arbitrage Pricing: Theory উদ্ভাবন করেন।

অর্থায়নের আধুনিক যুগের সূচনা (১৯৯০ -বর্তমান সময়): নব্বই দশকের পর থেকে আমদানি- রপ্তানি বাণিজ্য প্রসারের সাথে সাথে অর্থায়নের আন্তর্জাতিক পরিধি বাড়তে থাকে। ব্যবসায়ে পর্যাপ্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন উৎস সম্পর্কে ধারণা লাভ শুরু হয়।

পরিশেষে বলা যায়, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির যুগ পর্যন্ত অর্থায়নের যে সকল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তারই ফলশ্রুতিতে আধুনিক অর্থায়ন এরূপ লাভ করেছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url