কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈশিষ্ট্য
কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো দেশের অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী, একক ও অনন্য ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর এমন কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা একে একটি নিজস্ব রূপ ও বৈশিষ্ট্য দান করতে সক্ষম হয়েছে। নিম্নে এর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচিত হলো:
১. একক সংগঠন (Single organisation): যেকোনো দেশে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে। একাধিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো দেশেই অনুমতি দেয়া হয় না। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিঃসন্দেহে একটি একক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করা যায়। একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর প্রধান সুবিধা হলো, একে অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয় না।
২. সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ (Govt. ownership & control): বর্তমানকালে অধিকাংশ দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম সরকারি ও বেসরকারি যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হলেও এ ব্যাংকের ওপর সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ লক্ষণীয়।
৩. উদ্দেশ্যের ভিন্নতা (Difference in objectives): মুনাফা অর্জন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য নয়। দেশে বিহিত মুদ্রার পরিমাণ ও ঋণের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে জনগণের কল্যাণ সাধনই এর প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
৪. নোট প্রচলনের একক অধিকার (Monopoly right of note issue): দেশের অভ্যন্তরে নোট প্রচলনের একক অধিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এটিও এর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বর্তমান যুগে প্রত্যেক দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোট প্রচলনের একক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।
৫. মুদ্রামান সংরক্ষক (Custodian of money standard): বিদেশী বাজারে দেশী মুদ্রার সম্মানজনক মান সংরক্ষণ এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে মুদ্রামান স্থিতিশীল রাখাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য । এজন্য দেশের অভ্যন্তরে মুদ্রা সরবরাহ পরিস্থিতি কাম্যস্তরে বজায় রাখার জন্য এই ব্যাংক মুদ্রামান সংরক্ষকের দায়িত্ব পালন করে।
৬. সরকারের ব্যাংক (Govt. bank): কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু সরকারের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণেই থাকে ন সরকারের ব্যাংক হিসেবে সরকারের পক্ষে আর্থিক লেনদেন এবং সরকারি তহবিলের রক্ষক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া দেশে-বিদেশে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সরকারের আর্থিক নীতি বাস্তবায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৭. অর্থবাজারের অভিভাবক (Guardian of the money market): দেশের অর্থবাজারের গঠন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই ব্যাংক অর্থবাজার নিয়ন্ত্রণ করে, ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং পুরো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মুদ্রাবাজারের অভিভাবক বলে অভিহিত করা হয়।
৮. অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংকার ও নিয়ন্ত্রক (Banker and controller of other banks): কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটা দেশের বাণিজ্যিক ও অন্যান্য ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা ও নির্দেশাবলি মেনে চলতে হয়। এদেরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসাব খুলতে হয় ও আমানতের একটা অংশ বাধ্যতামূলকভাবে এখানে জমা রাখতে হয়।
৯. বৈদেশিক বিনিময়ের নিয়ন্ত্রক (Controller of foreign exchange): বৈদেশিক বিনিময়ের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রকের একক দায়িত্বও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর ন্যস্ত থাকে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ, এর রিজার্ভ সংরক্ষণ, দেশের অভ্যন্তরে এর লেনদেন নিয়ন্ত্রণ এবং এ বিষয়ে বিদেশী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষাও এরূপ ব্যাংকের দায়িত্বের অধীন। যা একে বৈদেশিক বিনিময়ের নিয়ন্ত্রকের মর্যাদা দান করেছে।
১০. ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল (Lender of the last resort): দেশের সরকার কিংবা কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসে। এটা সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জরুরি প্রয়োজনে ঋণ দেয়। তাই অধ্যাপক হট্টে বলেছেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো ফণের শেষ আশ্রয়স্থল”।
১১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Mission & vision): কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন সাধন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
১২. অমুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠান (Non-profit organization): কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিকাংশ পরিচালনা কার্যাবলির মাধ্যমে ব্যাংক আদৌ কোনো আয় করে না বরং ব্যয় করে। ফলে প্রতিষ্ঠানের লোকসান হয়। তবে এ লোকসান বা ব্যয় সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণের জন্য করা হয়। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।
১৩. আইনগত সত্তা (Legal entity): সকল দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি স্বতন্ত্র আইনগত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সরকারের বিশেষ অধ্যাদেশ বা আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারি মালিকানাধীন হলেও বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে উন্নত দেশসমূহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে স্বায়ত্তশাসিত। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ও পদ্ধতির ওপর সরকারের পরোক্ষ প্রভাব থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ১২৭ নং অধ্যাদেশ বলে গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত।
১৪. নিকাশ ঘর (Clearing house): বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মধ্যে যে সকল আন্তঃব্যাংকিং লেনদেন সম্পন্ন হয় তা নিষ্পত্তিতে র কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধরনের ব্যবস্থাকে নিকাশ ঘর বলা হয়।
১৫. বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ব্যাংকার (Banker for commercial banks): কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ব্যাংকার হিসেবে ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের তহবিল সংরক্ষণ, ঋণদান, পরামর্শ প্রদান, সহায়তা, ঋণদান কার্যক্রম তদারক প্রভৃতি কাজ করে থাকে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ব্যাংকার বলা হয়। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে।