পণ্য ডিজাইনের উদ্দেশ্য | Objectives-of-product-design
উৎপাদিতব্য পণ্যের আকার, ধরন, মান ইত্যাদি পণ্যটি উৎপাদনের পূর্বেই ঠিক করা হল পণ্যের ডিজাইন বা পণ্যের নকশাকরণ। বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পণ্যের ডিজাইন করা হয়। এ উদ্দেশ্যগুলোর কোনোটি ক্রেতাকেন্দ্রিক আবার কোনোটি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক। পণ্য ডিজাইনের উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. আকর্ষণ সৃষ্টি (Create attraction): পণ্য ডিজাইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাদের মাঝে আকর্ষণ সৃষ্টি করা। অনেকদিনের পুরাতন ও একঘেঁয়েমী ডিজাইন ক্রেতাদের মাঝে তেমন আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না। তাই নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে পণ্যটিকে ক্রেতাদের মাঝে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, যা পণ্যের চাহিদা ও বিক্রয় বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়!
২. উৎপাদন ব্যয় হ্রাস (Cost reduced): পণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করার উদ্দেশ্যেও পণ্যের নতুন নতুন ডিজাইন করা হয়। পণ্যের আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর ডিজাইন করা হলে তা শুধুমাত্র ক্রেতাদের মাঝে আকর্ষণই সৃষ্টি করে না পণ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাসেও সহায়তা করে। নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে আবার দ্রুততার সাথে পশু উৎপাদন করাও সম্ভব হয়। উৎপাদনের অপচয় হ্রাস এবং দ্রুত উৎপাদনের ফলে একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়, যা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।
৩. উপযোগ সংযোগ (Adding utility): পণ্যের বর্তমান উপযোগের সাথে নতুন নতুন সুযোগ - সুবিধা সংযোগ করে পণ্যের ডিজাইন করা হলে তাকে উপযোগ সংযোগ বলে। পণ্য ডিজাইন করার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো উপযোগ সংযোগ করা। পণ্য ডিজাইনের মাধ্যমে পুরাতন পণ্যের সাথে নতুন নতুন উপযোগ যুক্ত করা হয়। যেমন পুরাতন মোবাইল সেটের তুলনায় নতুন মোবাইল সেটে একাধিক ফাংশন থাকে যা এর ব্যবহারকারীকে বহুমুখী ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেয়। কথা বলার পাশাপাশি সময় দেখা, ছবি দেখা, গান শোনা, ছবি তোলা এবং ইন্টারনেট ব্রাউজিংসহ আরো কত প্রকার কাজ একটি মাত্র মোবাইল সেটের মাধ্যমে করা যায়। ফলে এর উপযোগিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
৪. সহজ বহন (Easy transportation): পণ্যের ডিজাইন আধুনিক হলে পণ্যটি অতিসহজেই ভোক্তারা বহন করতে পারে। বর্তমানে পণ্য ডিজাইনের ক্ষেত্রে ডিজাইনার যে সকল বিষয়কে বিবেচনা করে তার মধ্যে পণ্যের বহনযোগ্যতা অন্যতম। পণ্যের প্রকৃতি বিবেচনায় যদিও পণ্যটি ভারি ও আয়তনে বড় হয়, তবুও ডিজাইন এমন ভাবে করা হয় যাতে তা সর্বাপেক্ষা ঝামেলা এড়িয়ে অতি সহজেই বহন করা যায়। বর্তমানে অধিক হারে ল্যাপটপ কম্পিউটারের ব্যবহার মূলত সহজ বহনের ধারণাটি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
৫. উন্নত মান (Developed standard): বর্তমান হতে আরো উন্নত মানের পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পণ্যের ডিজাইন করা হয়। যে কোনো পণ্যের নতুন ডিজাইন এর অর্থই হলো উন্নত মানের পণ্য সরবরাহ। কারণ যখনই কোনো পণ্যের ডিজাইন করা হয়, তখনই বাজারে বিদ্যমান অন্যান্য পণ্যের তুলনায় পণ্যের উন্নত মানের বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা চালান হয়। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বিদ্যমান পণ্যের নতুন ডিজাইন করে তাহলে সেক্ষেত্রেও তা পূর্বের তুলনায় মানসম্মত হওয়ার বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়।
৬. ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি (Increasing purchasing power of consumers): পণ্যের মূল্য ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার উদ্দেশ্যেও পণ্যের ডিজাইন করা হয়। পণ্য ডিজাইনের ফলে একদিকে যেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম খরচে পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার কথা চিন্তা করে পণ্যকে ছোট ছোট লটে ভাগ করে পণ্যের মোড়ক করা হচ্ছে। যেমন মিনি প্যাক শ্যাম্পু, মিনি প্যাক ডিটারজেন্ট পাউডার, মিনি প্যাক টুথ পেস্ট ইত্যাদি।
৭. ইমেজ সৃষ্টি (Creating image): পণ্য ডিজাইনের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদের মধ্যে পণ্য এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধনাত্মক ইমেজ সৃষ্টি করা। নতুন নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে ভোক্তাদেরকে উন্নত মানের পণ্য অপেক্ষাকৃত কম দামে সরবরাহ করা সম্ভব হয়, যা ভোক্তা সন্তুষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আর ভোক্তা সন্তুষ্টির ফলে প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের ধনাত্মক ইমেজ সৃষ্টি হয়। পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভোক্তাদের এরূপ ইমেজ অত্যন্ত প্রয়োজন।
৮. বাজার সম্প্রসারণ (Expansion of market): উন্নত ও আধুনিক ডিজাইনের মাধ্যমে ভোক্তাদের মাঝে পণ্য ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ইমেজ গড়ে তোলা যায়। ফলে দেশীয় ভোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশী ভোক্তাদের মাঝেও পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। এতে একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হয়, অন্যদিকে তেমনি বিদেশের বাজারেও পণ্যের পরিচিত ঘটে। তাই অনেক প্রতিষ্ঠানই বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পণ্যের নতুন নতুন ডিজাইন করে থাকে।
৯. স্থায়ী ক্রেতা সৃষ্টি (To create permanent customer): পণ্যের নতুন নতুন ডিজাইন করার ফলে স্থায়ী ক্রেতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। একই প্রতিষ্ঠানে যদি একাধিক ডিজাইনের পণ্য থাকে তাহলে ক্রেতাদের মাঝে তা আগ্রহের সৃষ্টি করে। এতে ক্রেতারা অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে না পড়ে নির্দিষ্ট পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ফলে তারা উক্ত প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ক্রেতায় পরিণত হয়।
১০. প্রতিযোগিতা মোকাবেলা (Facing competition): প্রতিযোগিতা মোকাবেলার জন্যও পণ্যের নতুন নতুন ডিজাইন করা হয়। পণ্য ডিজাইনের ফলে একদিকে যেমন ক্রেতাদের মাঝে পণ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে তেমনি একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় ক্রেতারা তুলনামূলক কম দামে পণ্যটি ক্রয় করতে পারে। আবার নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে পণ্যের গুণগত মানও বৃদ্ধি করা হয়, যা পণ্যটিকে ক্রেতাদের মাঝে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। ফলে প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
পরিশেষে বলা যায়, বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পণ্যের ডিজাইন করা হয়। এরূপ ডিজাইনের ক্ষেত্রে, একদিকে যেমন ক্রেতাদের রুচি, পছন্দ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদিকে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি উৎপাদনের প্রকৃতি, পণ্যের প্রকৃতি, প্রতিযোগী পণ্যের আকার, মান ইত্যাদিকেও বিবেচনা করা প্রয়োজন।