উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের কারণ

উৎপাদন ক্ষমতা হলো একটি প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ উৎপাদনের হার। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন কার্য সম্পাদন করা যে কোনো প্রতিষ্ঠানে জন্য মঙ্গলকর। কিন্তু সকল অবস্থায় এরূপ উৎপাদন কার্য সম্পাদন করা যাবে তা নয়। নানান কারণে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. যন্ত্রপাতির বয়স বৃদ্ধি (Increase the age of machine): স্বাভাবিক নিয়মেই যন্ত্রপাতির বয়স বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো মেশিন হতে যে মাত্রায় উৎপাদন পাওয়া সম্ভব  পরবর্তীকালে তা আর সম্ভব হয় না এবং ক্রমান্বয়ে আস্তে আস্তে উক্ত মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। বয়স বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের কারণ হলো- বিভিন্ন পার্টের দুর্বলতা, ঘন ঘন অকেজো হওয়া, পশ্চাৎপদ প্রযুক্তি ইত্যাদি।

২. নিম্ন মানের কাঁচামাল ব্যবহার (Use of low quality's raw materials): কাঁচামাল হলো উৎপাদনের অন্যতম উপাদান। এরূপ কাঁচামাল যত উন্নত হবে উৎপাদনশীলতাও তত বৃদ্ধি পাবে। আর অধিক পরিমাণ উৎপাদনশীলতা সম্পন্ন কাঁচামাল দ্বারা উচ্চ মাত্রায় উৎপাদন করা সম্ভব হয়। তবে উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল যদি নিম্নমানের হয় তাহলে কাঁচামালের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং সেই সাথে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতাও হ্রাস পায়।

৩. অদক্ষ ব্যবস্থাপনা (Inefficient management): প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের মূল শর্ত হলো দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপস্থিতি। ব্যবস্থাপনা দক্ষ হলে যে কোনো উদ্দেশ্য অর্জন সহজ হয়। অনুরূপভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। বিপরীতক্রমে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা যদি অদক্ষ হয় তাহলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না বরং উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে।

৪. অদক্ষ শ্রমিক (Inefficient labor): কাম্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা অপরিহার্য। অর্থাৎ শ্রমিকরা যদি দক্ষ হয় তাহলে সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিকরা যদি কর্মক্ষেত্রে অদক্ষতার পরিচয় দেয়, তাহলে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। কারণ, অদক্ষ শ্রমিকদের শ্রম উৎপাদনশীলতা অত্যন্ত কম।

৫. শ্রম অসন্তোষ (Labor unrest): বিভিন্ন কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানে শ্রম অন্তোষ দেখা দিতে পারে। তবে যে কারণেই শ্রম অসন্তোষ দেখা দিক না কেন এর মাধ্যমে উত্তম কার্য পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। শ্রম অসন্তোষ থাকলে শ্রমিকদের মধ্যে একদিকে যেমন দলাদলির সৃষ্টির হয়, অন্যদিকে তেমনি ব্যবস্থাপনার সাথে তাদের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটে। এর ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়।

৬. পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়া (Reducing product demand): পণ্য উৎপাদন করা হয় বিক্রি করার জন্য। তাই উৎপাদিত পণ্যটি যদি বিক্রি করা না যায়, তাহলো উৎপাদনের পরিমাণ বাধ্যতামূলকভাবে হ্রাস করতে হয়। বাজারে পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন কার্য চালু রাখলে একদিকে যেমন- পণ্যের মওজুদ খরচ বাড়ে অন্যদিকে তেমনি দীর্ঘদিন গুদামে পড়ে থাকার ফলে পণ্যের গুণগত মানও হ্রাস পায়। এ কারণে পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেলে বাধ্যতামূলকভাবে পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস করতে হয়।

৭. মূল্য স্তর কাম্য পর্যায়ে রাখা (Keeping optimum price level): পণ্যের মূল্য কাম্য স্তরে রাখার জন্যও অনেক সময় পণ্যটির উৎপাদন হ্রাস করা হয়। বাজারে পণ্যের চাহিদা ভাল থাকলে একটি কাঙ্ক্ষিত দামে পণ্যটি বাজারে ছাড়া হয়। কিন্তু অধিক পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করা হলে অর্থাৎ বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে মূল্য স্তর হ্রাস পায়, যা ক্ষতিকর এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুনামের উপর ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে। এ অবস্থা হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য, উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে বাজারে পণ্যের সরবরাহ হ্রাস করে মূল্য স্থীতিশীল রাখার চেষ্টা করা হয়।

৮. পণ্যমানকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া (Giving importance on product quality): অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের মান এবং পণ্য উৎপাদনের সংখ্যা পরস্পর বিপরীতমুখী হয়। অর্থাৎ অধিক সংখ্যক পণ্য উৎপাদন করা হলে পণ্যের মান নিম্ন হতে পারে অন্যদিকে মানকে গুরুত্ব দেওয়া হলে উৎপাদন কার্য ধীর গতি সম্পন্ন হতে পারে। তাই বলা যায়, উৎপাদনের ক্ষেত্রে পণ্যের মানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হলে অধিকমাত্রায় পণ্যটি উৎপাদন না করে উৎপাদনের মাত্রাকে একটু কমিয়ে আনা হয়। এতে উৎপাদন মাত্রা হ্রাস পায়।

৯. জটিল উৎপাদন প্রক্রিয়া (Complex production process): পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়া জটিল প্রকৃতির হলে অধিক মাত্রায় উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। উৎপাদন প্রক্রিয়া যদি ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপদজনক হয় অথবা একাধিক উপাদানের সংমিশ্রণে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। কারণ এরূপ অবস্থায় অধিক উৎপাদনের চেয়ে নিরাপত্তার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

১০. জ্বালানি শক্তির অভাব (Lack of power): জ্বালানি শক্তির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ যে কোনো উৎপাদনের পূর্বশর্ত। কোনো কারণে যদি প্রয়োজনীয় জ্বালানি শক্তি সঠিক সময়ে সরবরাহ পাওয়া না যায়, তাহলে অধিক মাত্রায় উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটলে উৎপাদন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।

১১. অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা (Unstable political situation): অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ঋণাত্মক প্রভাববিস্তার করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশে হরতাল, হাঙ্গামা, অসহযোগিতা ইত্যাদির মত অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে, ফলে একদিকে যেমন কাঁচামাল সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটে, অন্যদিকে তেমনি উৎপাদিত পণ্যও সঠিক সময়ে ক্রেতাদের নিকট পৌঁছানো সম্ভব হয় না, যা উৎপাদন ক্ষমতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সীমিত করে।

১২. শ্রম আইনের কঠোর অনুসরণ (Proper use of labor law): দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রম আইন দ্বারাও উৎপাদন কার্যক্রম প্রভাবিত হয়। শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তাই বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও যদি এ সময়ের অতিরিক্ত উৎপাদন কার্য পরিচালনা করতে হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তা সম্ভব নয়। আবার ওভার টাইম এর নিয়ম থাকলেও তারও সুনির্দিষ্ট নিয়ম - নীতি আছে, যা অনেক সময় উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করাকে প্রভাবিত করতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানান কারণে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করা হতে পারে। তবে বাহ্যিক কারণ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের কিছু না করার থাকলেও অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সম্পর্কে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখা সম্ভব হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url