নিম্ন মানের পণ্য উৎপাদনের কারণ

বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ প্রয়োজনকে সামনে রেখেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করে। কিন্তু নানান কারণে উৎপাদিত পণ্যের মান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হয়ে নিম্ন মানের হতে পারে। যে সমস্ত কারণে উৎপাদিত পণ্য নিম্ন মানের হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

দৈবচয়িত কারণসমূহ |Providential causes


অনিরূপণযোগ্য বা অজানা কারণে পণ্যের মান নিম্ন মানের হলে তাকে নিম্ন মান হওয়ার দৈবচয়িত কারণ বলে। এ কারণগুলোর উপর কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবে এ কারণে পণ্যের মান খুব বেশি নিম্ন মানের হয় না। কোনো ক্ষেত্রে মানের সামান্য পার্থক্য দেখা দেয়। যেমন- একই রঙের কাপড় উৎপাদন করলেও রঙের মধ্যে কিছুটা তারতম্য ঘটতে পারে। পণ্যের নিম্ন মান হওয়ার পিছনে যে কারণগুলো বিদ্যমান তা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. শ্রমিক-কর্মীদের কর্ম দক্ষতার পার্থক্য (Difference of work efficiency of the workers): উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে সকল উপাদান জড়িত তার মধ্যে শ্রম অন্যতম। তবে শ্রম প্রদানে নিয়োজিত শ্রমিক, মান নিম্ন মানের হতে পারে। কর্মীদের কর্মদক্ষতার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শ্রমিকদের কর্মদক্ষতার তারতম্যের কারণে পণ্যের মান নিম্নমানের হতে পারে।

২. যন্ত্রপাতির অন্তর্নিহিত কারণ (Internal causes of machine): একই যন্ত্রপাতির সাহায্যে উৎপাদিত সকল পণ্য একই মানের হওয়া উচিত এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তা হয় না। যেমন একই ক্যামেরায় তোলা সবগুলো ছবি একই মানের হয় না। আবার ফটোকপির সময় সকল শীটে একই রকম প্রিন্ট আসে না। কিন্তু এ সকল বিষয় সমাধানে এর অপারেটরের তেমন কিছু করার থাকে না। এটা মেশিনের অন্তর্নিহিত বিষয়।

৩. আকস্মিক দুর্ঘটনা (Sudden accident): আকস্মিক দুর্ঘটনার কারণে পণ্যের মান নিম্ন মানের হতে পারে। কারখানায় আগুন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, ভূমিকম্প, ঝড় - বৃষ্টি ইত্যাদি কারণে কাঁচামাল বা উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এ ধরনের দুর্ঘটনার উপর কর্তৃপক্ষের তেমন নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

৪. ভুল-ত্রুটি (Mistaks): উৎপাদন প্রক্রিয়ায় হঠাৎ ভুল হলে অথবা শ্রমিক - কর্মীদের ভুল - ত্রুটির কারণে পণ্যের মান নিম্ন মানের হতে পারে। এরূপ ভুলের উপর সংশ্লিষ্ট কর্মীর বা কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ  থাকে না। আবার যেকোনো ভুলের কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে যা পণ্য মানের উপর ব্যাপক ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে।

৫. প্রযুক্তিগত ত্রুটি (Technological disturbance): বর্তমানে অধিকাংশ উৎপাদন ব্যবস্থাই প্রযুক্তি নির্ভর। তবে প্রযুক্তি সকল সময় কাজ নাও করতে পারে। যে কোনো সময় প্রযুক্তি বিকল অথবা প্রযুক্তির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। যেমন- কম্পিউটার প্রযুক্তি যে কোনো সময়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসাড় হতে পারে। তাই বলা যায়, প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে পণ্য নিম্ন মানের হতে পারে।

৬. অপর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ (Insufficient power supply): জ্বালানি শক্তি পণ্য উৎপাদনের প্রাণ। তাই মান সম্মত পণ্য উৎপাদনের পূর্বশর্ত হলো- পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্বালানি বা শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত করা। যদি শক্তি বা জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে তাহলে পণ্যের মান নিম্ন হতে পারে।

আরোপিত কারণসমূহ |Assigned causes


 যে সকল কারণে পণ্যের মান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের স্বদেচ্ছা থাকলে তা এড়ানো সম্ভব; সে সকল কারণকে আরোপিত কারণ বলে। নিম্ন মানের পণ্য উৎপাদনের পিছনে যে সকল আরোপিত কারণ বিদ্যমান তা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. অদক্ষ শ্রমিক-কর্মী (Inefficient labor): অদক্ষ শ্রমিক - কর্মীর কারণে পণ্যের মান নিম্ন মানের হতে পারে। দক্ষ কর্মীর দ্বারা যে মানের পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব অদক্ষ কর্মীর দ্বারা সে মানের পণ্য উৎপাদন আশা করা যায় না। তবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অদক্ষ কর্মীদের দক্ষ করে তোলা যায়।

২. নিম্ন মানের যন্ত্রপাতির ব্যবহার (Use of low quality machineries): পণ্যের মান নিম্ন হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে নিম্ন মানের যন্ত্রপাতির ব্যবহার। উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি যদি অনেক দিনের পণ্যের মান নিম্ন হয়। পুরাতন হয় বা আধুনিক মানের না হয় তবে তা পণ্য মানের উপর ফণাত্মক প্রভাব ফেলে এবং এরপ অবস্থায় পণ্যের মাল নিম্ন হয়।

৩. নিম্ন মানের কাঁচামাল ব্যবহার (Use of low quality raw materials): পণ্যের মান বহুলাংশে কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল যদি উন্নত মানের হয় তাহলে পণ্যের মান উন্নত হয়। অন্যথায় পণ্যটি নিম্ন মানের হতে বাধ্য। এ কারণে কাঁচামাল ক্রয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

৪. গতানুগতিক উৎপাদন পদ্ধতির ব্যবহার (Use of traditional production system): পণ্য উৎপাদনে যদি গতানুগতিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাহলে পণ্যের মান হ্রাস পায়। কারণ গতানুগতিক পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদন করা হলে প্রতিটি পণ্য একই মানের হয় না। যেমন- বইয়ের সেলাই যদি গতানুগতিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ সুই - সুতা দিয়ে করা হয় তাহলে প্রতিটি বইয়ের বাঁধাইয়ের মান একইরূপ হবে না কিন্তু আধুনিক মেশিনে গু দিয়ে বাঁধাই করলে মান একই রূপ হবে। 

৫. মূলধনের অভাব (Lack of capital): অপর্যাপ্ত মূলধনের কারণে পণ্যের মান নিম্ন হতে পারে। পণ্য মান ঠিক রাখার জন্য যে সকল উপায় - উপাদানের প্রয়োজন তা সংগ্রহ ও উন্নত করার জন্য প্রচুর পরিমাণ মূলধনের প্রয়োজন হয়। তাই মূলধনের অভাব দেখা দিলে এসকল প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে পণ্যের মান নিম্ন হয়।

৬. পরিকল্পনার ঘাটতি (Deficiency of plan): পণ্যের মান ঠিক রাখার জন্য পূর্ব পরিকল্পনার প্রয়োজন। তাই মান নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনায় যদি ঘাটতি থাকে তবে পণ্যটি নিম্ন মানের হতে বাধ্য। এ কারণে পণ্যের মান ঠিক রাখার জন্য সঠিক ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার।

৭. প্রযুক্তি ও কৌশলগত বিচ্যুতি (Dificiency of technological and tactical factors): প্রযুক্তি ও কৌশলগত বিচ্যুতির কারণে পণ্যের মান হ্রাস পেতে পারে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ। করা সম্ভব না হলে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের মান সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তাই পণ্যের মান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাখার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করা প্রয়োজন।

৮. দুর্বল মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (Poor quality controlling system): মান পরিকল্পনার ন্যায় মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত। কোনো কারণে যদি মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে তা হলে পণ্যের মান হ্রাস পায় । এ কারণে পণ্যের মান ঠিক রাখার জন্য কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা প্রয়োজন।

পরিশেষে বলা যায়, বিভিন্ন কারণে পণ্য নিম্ন মানের হতে পারে। তবে উপরে উল্লেখিত সাধারণ বিষয়গুলোর কারণে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য মান হ্রাস পেতে পারে। তাই মান ঠিক রাখার জন্য উৎপাদন ব্যবস্থাপককে এ বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url