পণ্য ডিজাইনের গুরুত্ব

আমরা ঈদ, দূর্গাপূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে নানান ধরনের নানান ঢঙ্গের বাহারি পোশাকের সমাহার দেখি। আবার ১লা বৈশাখ, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃ-ভাষা দিবস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিশেষ ডিজাইনের পোশাক লক্ষ্য করা যায়।

এ সকল দিবসকে সামনে রেখে বর্তমানে ফ্যাশন হাউজগুলো তাদের পণ্যের ডিজাইন করে থাকে। তাছাড়া শীতকালে যে ধরনের পোশাক বাজারে আসে, গরমকালে নিশ্চয়ই সে ধরনের পোশাক বাজারে পাওয়া যায় না। আবার অভিজাত এলাকায় যে মানের পণ্য বিক্রি হয়, অন্য এলাকায় সে মানের পণ্য বিক্রি হয় না। কোনো বিশেষ আকারের পণ্য বাজার দখল করতে পারলেও একই মানের পণ্য শুধুমাত্র আকারের তারতম্যের কারণে বাজার হতে বিতাড়িতও হতে পারে। 
পণ্য ডিজাইনের গুরুত্ব
অতএব দেখা যায়, ক্রেতাদের পাশাপাশি উৎপাদকগণের নিকটও পণ্যের ডিজাইন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভোক্তাদের রুচি, পছন্দ, ক্রয় অভ্যাস ইত্যাদি পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন উৎপাদকগণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ডিজাইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যও পণ্যের আধুনিক ডিজাইন করার প্রয়োজন পড়ছে। পণ্য ডিজাইনের গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. আকর্ষণ সৃষ্টি (Create attraction): পণ্য ডিজাইনের মাধ্যমে পণ্যটিকে ক্রেতাদের মাঝে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। অনেকদিনের পুরাতন ও একঘেঁয়েমী ডিজাইন ক্রেতাদের মাঝে তেমন আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না। তাই পণ্যের তুন ডিজাইনের মাধ্যমে পণ্যটিকে ক্রেতাদের মাঝে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়, যা পণ্যের চাহিদা ও বিক্রয় বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

২. উৎপাদন ব্যয় হ্রাস (Reduce cost): পণ্যের নতুন ডিজ়াইনের জন্য উৎপাদন পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে। যে কোনো পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করার অর্থ হলো পূর্বের তুলনায়। আধুনিক পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা। আর আধুনিক পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার ফলে একদিকে যেমন উৎপাদন উপকরণের অপচয় হ্রাস হয়, অন্যদিকে তেমনি দ্রুততার সাথে উৎপাদন কার্য সম্পাদন করা সম্ভব হয়। উৎপাদনের অপচয় হ্রাস এবং দ্রুত উৎপাদনের ফলে একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়, যা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।

৩. উপযোগ সংযোগ (Adding utility): পণ্যের বর্তমান উপযোগের সাথে নতুন নতুন সুযোগ - সুবিধা সংযোগ করে পণ্যের ডিজাইন করা হলে তাকে উপযোগ সংযোগ বলে । পণ্য ডিজাইনের মাধ্যমে পুরাতন পণ্যের সাথে নতুন নতুন উপযোগ যুক্ত করা হয়। যেমন- পুরাতন মোবাইল সেটের তুলনায় নতুন মোবাইল সেটে একাধিক ফাংশন থাকে যা এর ব্যবহারকারীকে বহুমুখী ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেয়। কথা বলার পাশাপাশি সময় দেখা, ছবি দেখা, গান শোনা, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্রাউজিংসহ আরো কত প্রকার কাজ একটি মাত্র মোবাইল সেটের মাধ্যমে করা যায়। ফলে এর উপযোগিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। অনুরূপ ভাবে ডিজিটাল ঘড়ি, কম্পিউটার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও আমরা এ ধরনের উপযোগ সংযোগের বিষয়টি লক্ষ্য করতে পারি।

৪. সহজ বহন (Easy to carry): পণ্যের ডিজাইন আধুনিক হলে পণ্যটি অতিসহজেই ভোক্তারা বহন করতে পারে। বর্তমানে পণ্য ডিজাইনের ক্ষেত্রে ডিজাইনার যে সকল বিষয়কে বিবেচনা করে তার মধ্যে পার বহনযোগ্যতা অন্যতম। পণ্যের প্রকৃতি বিবেচনায় যদিও পণ্যটি তারি ও আয়তনে বড় হয়, তবুও পন্যটির ডিজাইন এমনভাবে করা হয়, যাতে তা সর্বাপেক্ষা ঝামেলা এড়িয়ে অতি সহজেই বহন করা যায়। বর্তমানে অধিক হারে ল্যাপটপ কম্পিউটারের ব্যবহার মূলত সহজ বহনের ধারণাটি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।

৫. উন্নত মান (Developed standard): পণ্য ডিজাইনের মাধ্যমে বাজারে উন্নত মানের পণ্য পাওয়া সরে হচ্ছে। যে কোনো পণ্যের নতুন ডিজাইন এর অর্থই হলো উন্নত মানের পণ্য সৃষ্টি। কারণ যখনই কোনো পণ্যের ডিজাইন করা হয়, তখনই বাজারে বিদ্যমান অন্যান্য পণ্যের তুলনায় পণ্যের উন্নত মানের বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা চালান হয়। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বিদ্যমান পণ্যের নতুন ডিজাইন করে তাহলে সেক্ষেত্রেও তা পূর্বের তুলনায় মানসম্মত হওয়ার বিষয়টিকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়। তাই বলা যায়, পণ্য ডিজাইনের ফলে ক্রেতারা উন্নত মানের পণ্যসামগ্রী পেয়ে থাকে।

৬. নতুন পণ্য প্রবর্তন (Introducing new product): পণ্য ডিজাইন মূলত পণ্য গবেষণারই ফল। পণ্য গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। পণ্য ডিজাইনের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন পণ্যের বাহ্যিক আকার - আকৃতিকে বিবেচনা করা হয়, অন্যদিকে তেমনি পণ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়কেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাহ্যিক আকার ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যখন নতুনত্ব আসে, তখন অনায়াসে নতুন পণ্যের উদ্ভব হতে পারে। যেমন: কম্পিউটারের ফ্লপি ডিস্ক এর পরিবর্তে বর্তমানে পেন ড্রাইভ ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ফ্লপি চিহ্ন এর পরিবর্তিত নতুন পণ্য। তাই বলা যায়, পণ্য ডিজাইনের মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্যের উদ্ভাবন করা সম্ভব হচ্ছে।

৭. ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি (Increasing purchasing power of consumers): পণ্য ডিজাইনের মাধ্যমে ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পণ্য ডিজাইনের ফলে একদিকে যেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম খরচে পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে পণ্যকে ছোট ছোট লটে ভাগ করে পণ্যের মোতৃক করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার কারণে পণ্যের মূল্য হ্রাস পাচ্ছে, আবার ক্রেতাদের চাহিদামত ছোট ছোট লটে পণ্য পাওয়ায় তারা অতিসহজেই তা ক্রয় করতে পারছে। তাই বলা যায়, ডিজাইনের মাধ্যমে ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি ক্রয়কে সহজ করে তোলা হচ্ছে।

৮. ইমেজ সৃষ্টি (Creating image): ভোক্তাদের মাঝে পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের ইমেজ সৃষ্টিতেও ডিজাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নতুন নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে ভোক্তাদেরকে উন্নত মানের পণ্য অপেক্ষাকৃত কম দামে সরবরাহ করা সম্ভব হয়, যা ভোক্তা সন্তুষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আর ভোক্তা সন্তুষ্টির ফলে প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের ধনাত্মক ইমেজ সৃষ্টি হয়। পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভোক্তাদের এরূপ ইমেজ অত্যন্ত প্রয়োজন।

৯. বাজার সম্প্রসারণ (Expansion of market): বাজার সম্প্রসারণে পণ্য ডিজাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । উন্নত ও আধুনিক ডিজাইনের মাধ্যমে ভোক্তাদের মাঝে পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের ইমেজ গড়ে তোলা যায়। ফলে দেশীয় ভোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশী ভোক্তাদের মাঝেও পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। এতে একদিকে যেমন দেশে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হয়, অন্যদিকে তেমনি বিদেশের বাজারেও পণ্যের পরিচয় ঘটছে। তাই বলা যায়, পণ্য ডিজাইনের মাধ্যমে পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়। 

১০. প্রতিযোগিতা মোকাবেলা (Facing competition): পণ্য ডিজাইনের ফলে একদিকে যেমন ক্রেতাদের মাঝে পণ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে তেমনি একক প্রতি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় ক্রেতারা তুলনামূলক কম দামে পণ্যটি ক্রয় করতে পারে। আবার নতুন ডিজাইনের মাধ্যমে পণ্যের গুণগত মানও বৃদ্ধি করা হয়, যা পণ্যটিকে ক্রেতাদের মাঝে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতা মোকাবেলা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য বাজারে পরিবেশন করে। প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।

১১. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন (Improving standard of living): পণ্যের নতুন নতুন ডিজাইন করার ফলে ভোক্তাদের মাঝে পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও উপযোগিতা বৃদ্ধি পায়। বাজারে নতুন নতুন ও উন্নত মান সম্মত পণ্যের আগমন ঘটে। এরূপ উন্নত মানের পণ্য ক্রয় করার ফলে ক্রেতাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হয়। যেমন: আমাদের দেশে গতানুগতিক মোবাইল অপারেটিং সিস্টেমের পরিবর্তে অতি সম্প্রতি 3G ও 4G মোবাইল সিস্টেম, মোবাইল ফোনের গ্রাহকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটিয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, পণ্যের ডিজাইন প্রণয়ন করা উৎপাদকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। পণ্য ডিজাইনের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন ক্রেতাদের রুচি, পছন্দ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ক্রয় ক্ষমতা ইত্যাদিকে বিবেচনায় আনা হয়, অন্যদিকে তেমনি উৎপাদনের প্রকৃতি, পণ্যের প্রকৃতি, প্রতিযোগী পণ্যের আকার, মান ইত্যাদিকেও বিবেচনা করা হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url