মান ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব |Importance of Quality Management

মুক্ত বাজার অর্থনীতির এযুগে ক্রেতারা পণ্যের মানকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করে। চটকদারি বিজ্ঞাপন ও মূল্য হ্রাসের কবলে পড়ে ক্রেতারা কোনো পণ্য ক্রয় করলেও তা যদি নিম্ন মানের হয় বা ক্রেতাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে পরবর্তীতে সেই পণ্য তারা আর ক্রয় করে না। এমনকি ঐ পণ্য এবং ঐ পণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়ে চলে। তাই পণ্যের মানকে আধুনিক ব্যবস্থাপকগণ অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কারণ উন্নত মানের পণ্য তাদেরকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহায্য করে। তাই পণ্যের উৎপাদক মানকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করে। মান ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা:

১. মান নির্ধারণ (Fixation of standard): উৎপাদিত পণ্যের মান নির্ধারণ করা মান ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম কাজ। মান বলতে পণ্যের নির্দিষ্ট গুণগত বৈশিষ্ট্যসমূহকে বুঝায় যা ভোক্তা বা ক্রেতাদের চাহিদা মেটায়, সন্তুষ্টি বিধান করে এবং যার উপযোগিতা বা কার্যকারিতা ভোগকারী বা ক্রেতাদের কাছে প্রত্যাশার সমান বা তার চেয়েও বেশি। পণ্য বা সেবার মান নির্ধারণে মান ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।

২. নকশাকরণ (Designing): শুধুমাত্র মানের দিক দিয়ে পণ্য ভাল হলেই চলে না, ক্রেতাদের নিকট তা আকর্ষণীয়ও হতে হয়। কারণ পণ্য ক্রয়ের সময় মানের পাশাপাশি পণ্যের আকার, রঙ, বহনযোগ্যতা ইত্যাদিও ক্রেতারা বিবেচনা করে। আর পণ্য ডিজাইন প্রণয়নের সার্বিক দায়িত্ব মান ব্যবস্থাপনার উপরই বর্তায়। তার আন্তরিকতাতেই পণ্যের আধুনিক ডিজাইন করা সম্ভব হয়।

৩. উপকরণ সংগ্রহ (Collection of clements): পূর্ব নির্ধারিত মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা মান ব্যবস্থাপনার আরেকটি অন্যতম গুরুত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। উপকরণ সংগ্রহের জন্য উপকরণের উৎস নির্ধারণসহ তা সংগ্রহের যাবতীয় কার্যক্রম মান ব্যবস্থাপকই করে থাকে।

৪. যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা (To establish communication): পণ্যসামগ্রী শুধুমাত্র উৎপাদন করলেই চলবে না, তা সঠিকভাবে এবং যথাসময়ে ক্রেতাদের মাঝে সরবরাহও করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিভিন্ন ব্যক্তি বা বিভাগের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। মান ব্যবস্থাপনা একদিকে যেমন উৎপাদন পূর্ব বিভিন্ন ব্যক্তি বা বিভাগের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে অন্যদিকে তেমনি উৎপাদন পরবর্তী ব্যক্তি বা বিভাগের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে।

৫. উৎপাদন কার্য পরিচালনা (To operate production function): পণ্য বা সেবা উৎপাদনের সাথে বিভিন্ন কার্যাংশ জড়িত। এরূপ কার্যাংশ সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন মেশিন এবং বিভিন্ন ব্যক্তি জড়িত থাকে। এসকল মেশিন ও ব্যক্তিবর্গকে পরিচালনা করা মান ব্যবস্থাপনার আরেকটি গুরুত্ব হিসেবে গণ্য হয় । উৎপাদন কার্য পরিচালনায় তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখে।

৬. প্রশিক্ষণ দান (To give training): প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীকে কার্য সম্পাদনের যোগ্য করে তোলা যায়। প্রশিক্ষণের যে সকল পদ্ধতি আছে তাদের অন্যতম হল হাতে - কলমে প্রশিক্ষণ। উৎপাদন বিভাগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে এ বিভাগে নিয়োজিত কর্মীদের হাতে - কলয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা মান ব্যবস্থাপনার অন্যতম কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে কর্মীরা দক্ষ হয়ে উঠে।

৭. মান নিয়ন্ত্রণ (Quality control): শুধুমাত্র মান নির্ধারণ করলেই তা হতে সুফল আসে না। নির্ধারিত মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা এবং মান এর সাথে বর্তমান কাজের কোনো অমিল লক্ষ্য করা গেলে তা সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণের সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় হলো মান নিয়ন্ত্রণ। আর উৎপাদিত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা মান ব্যবস্থাপকের একটি অন্যতম গুরুত্ব বলে বিবেচিত হয়।

৮. গবেষণা ও উন্নয়ন (Research & development): গবেষণা ও উন্নয়ন বর্তমানে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অন্যতম বিষয়। কারণ প্রতিযোগিতার এ যুগে বর্তমানকে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বর্তমানে যে পণ্য বা সেবা আছে, কিভাবে তার মান আরো উন্নয়ন করা যায়, এ বিষয়ে চিন্তা - ভাবনা ও গবেষণা করার প্রয়োজন। আর এ বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের কাজটি মান ব্যবস্থাপনার একটি স্বতন্ত্র কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এক্ষেত্রে মান ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।

৯. তথ্য প্রদান (To give information): ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণের জন্য পণ্য বা সেবা সম্পার্কিত যে কোনো ধরনের তথ্য ক্রেতাকে প্রদান করা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অন্যতম দায়িত্ব। তাই ক্রেতা সন্তুষ্টি বিধানের জন্য। পণ্যের মান, গুণাগুণ, ওজন ইত্যাদিসহ পণ্য বা সেবা সম্পর্কিত যে কোনো ধরনের তথ্য মান ব্যবস্থাপক ক্রেতাদেরকে প্রদান করে। এরূপ তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রেও মান ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১০. প্রেষণাদান (To give motivation): মান ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম নীতি হলো কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। উৎপাদন কাজে কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য তাদেরকে প্রেষণা দান করা অত্যন্ত জরুরি। মান ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল কর্মীদের প্রেষণা দিতে না পারলেও তার বিভাগে অর্থাৎ মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের প্রেষণা দানের ব্যবস্থা করে থাকে। তাই বলা যায়, প্রেষণাদানের ক্ষেত্রে মান ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।

পরিশেষে বলা যায়, উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে মান ব্যবস্থাপনা ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তবে পরিপূর্ণ সফলতা লাভের ক্ষেত্রে মান ব্যবস্থাপককে স্বীয় কাজের প্রতি ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url