বিএসটিআই এর সমস্যা |Problem of BSTI
বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নয়নে বাংলাদেশ ষ্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এর ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। তাছাড়া পণ্যের মান নির্ধারণ, মান নিয়ন্ত্রণ, মান উন্নয়ন, মান গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে এ প্রতিষ্ঠানের সফলতা চোখে পড়ার মতো। এত সফলতা থাকা সত্ত্বেও নানান সমস্যায় প্রতিষ্ঠানটি জর্জড়িত। বিএসটিআই এর এ সকল সমস্যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. মূলধনের অভাব (Lack of capital): বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) একটি স্বায়ত্বশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এ প্রতিষ্ঠানটিতে মূলধনের অভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সারা দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে জনবল নিয়োগ কার্যক্রম সম্প্রসারণ, গবেষণা, অনুসন্ধান ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা এ প্রতিষ্ঠানটির একেবারেই নেই।
২. জনবলের অভাব (Lack of manpower): বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রায়ই জনবলের আধিক্য লক্ষ্য করা গেলেও বিএসটিআই এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম জনবল নিয়োজিত আছে। স্বল্প সংখ্যক জনবল থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটি তার লক্ষ্য অর্জনে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রয়োজনের তুলনায় দশভাগের একভাগ জনবলও এ প্রতিষ্ঠানে নেই।
৩. আধুনিক প্রযুক্তির অভাব (Lack of modern technology): আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটছে। তাই এরূপ স্পর্শকাতর উৎপাদন প্রক্রিয়ার মান নিরূপণের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন। কিন্তু নানান কারণে বিএসটিআই - এ আধুনিক প্রযুক্তি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে একদিকে যেমন উৎপাদিত পণ্যের মান সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে নতুন নতুন ও আধুনিক পণ্যের মান নির্ধারণ করতেও এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হচ্ছে।
৪. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ (Political interference): এ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষে একটি বড় বাধা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আহরণ করে তখন তারা ন্যায় অথবা অন্যায়ভাবে এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করছে। এর ফলে অনেক সম্ভাবনাময় কর্মসূচিও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সেবামূলক এ প্রতিষ্ঠানটি লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নাম বয়ে বেড়াচ্ছে।
৫. ব্যবসায়ী শ্রেণির অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ (Unexpected interference of businessmen): ব্যবসায়ী শ্রেণি তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নানানভাবে এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। মান সম্মত পণ্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা বিধান করা এ প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা মান সম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আইনগত ঝামেলা এড়ানোর জন্য বিএসটিআই এ নানানভাবে অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে।
৬. দুর্নীতি (Corruption): দুর্নীতি যেন এ প্রতিষ্ঠানটির চিরসাথী। হাতে গোনা কিছু অসৎ কর্মীর দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনীতির নামধারী অরাজনৈতিক দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের হস্তক্ষেপ। এ প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, মান নির্ধারণ এবং ভেজাল বিরোধী অভিযানসহ প্রতিটি কার্যক্রমে ব্যাপক দুর্নীতি লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি তার মূল লক্ষ্য অর্জনে বার বার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
৭. স্বজনপ্রীতি (Nepotism): সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ন্যায় এ প্রতিষ্ঠানেও স্বজনপ্রীতির বিষয়টি লক্ষণীয়। বিএসটিআই এ জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, ভাল জায়গায় পোস্টিং, পদোন্নতি ইত্যাদিসহ সকল ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি লক্ষ্য করা যায়। ফলে এতে একদিকে যেমন যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে, অন্যদিকে অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের হীন স্বার্থ অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এর কারণে, প্রতিষ্ঠানটিতে দিন দিন মারাত্মক নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
৮. দক্ষ কর্মীর অনুপস্থিতি (Absence of efficient worker): দক্ষ কর্মী বাহিনী যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়। ঠিক তেমনিভাবে অদক্ষ ও অযোগ্য কর্মী প্রতিষ্ঠানের দায় হিসেবে পরিগণিত হয়। রাজনৈতিক চাপ ও দুর্নীতির কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি একদিকে যেমন দক্ষ কর্মী নিয়োগদানে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি অর্থ ও প্রশিক্ষণের অভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের দক্ষ করে তোলাও সম্ভব হচ্ছে না, যা এ প্রতিষ্ঠানের একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৯. বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তের অনুপস্থিতি (Absence of realistic decision): বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তের অনুপস্থিতিও বিএসটিআই - এর অন্যতম সমস্যা হিসেবে গণ্য হয়। প্রতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনায়ন ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখার জন্য বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে।
১০. জনআস্থার অভাব (Lack of public faith): জনআস্থা কোনো প্রতিষ্ঠানের উপর সরাসরি প্রভাব না ফেললেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নানান কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিবর্গের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বিএসটিআই এর মিল থাকা সত্ত্বেও তোকারা উক্ত পণ্যের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি মাঝে মধ্যেই জনরোষানলের স্বীকার হয়।
পরিশেষে বলা যায়, মান নির্ধারণ, মান নিয়ন্ত্রণ, মান গবেষণা, ভেজালমুক্ত পণ্য নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি শ্লোগান নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল কালক্রমে তার মান নিয়েই দেখা দিয়েছে নানান প্রশ্ন। আর বিষয়টি এক দিনে বা একক কোনো কারণে সৃষ্টি হয়নি। তাই বলা যায়, দীর্ঘ দিনে ধরে উপরোক্ত কারণগুলোর কারণে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি নানান সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়েছে।