মান ব্যবস্থাপনার কি এবং বৈশিষ্ট্য | Quality of Management

আসলে মান এর কোনো আক্ষরিক সংজ্ঞা নেই কারণ, তোমার কাছে যা মানসম্মত আরেকজনের কাছে তা মানসম্মত নাও হতে পারে। তাই বলা যায়, ‘মান’ বিষয়টিই আপেক্ষিক। তবে মান সম্পর্কে মোটামুটিভাবে বলা যায়, ক্রেতাদের প্রত্যাশা পূরণে পণ্যের সক্ষমতাই হলো মান।

অন্যভাবে বলা যায়, মান বলতে পণ্যের নির্দিষ্ট গুণগত বৈশিষ্ট্যসমূহকে বুঝায় যা ভোক্তা বা ক্রেতাদের চাহিদা মেটায়, সন্তুষ্টি বিধান করে বা যার উপযোগিতা বা কার্যকারিতা ভোগকারী বা ক্রেতাদের কাছে প্রত্যাশার সমান বা তার চেয়েও বেশি। পণ্যের এসকল গুণগত বৈশিষ্ট্য হলো- পণ্যের সাইজ, পণ্যের ডিজাইন, ফিনিশিং, কালার, উপাদান, টেকসই ক্ষমতা ইত্যাদি। এখন দেখা যাক,

মান ব্যবস্থাপনা কাকে বলে?


মান যেমন ক্রেতাদের প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ, তেমনি মান ব্যবস্থাপনা হলো- ক্রেতাদের প্রত্যাশা পূরণের ব্যবস্থা। তবে মান ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে বলা যায়, মান ব্যবস্থাপনা বা সার্বিক মান ব্যবস্থাপনা হলো সেই মতবাদ, যা তিনটি নীতির উপর গুরুত্ব দেয়। এ তিনটি নীতি হলো- ক্রেতা সন্তুষ্টি, কর্মীদের সম্পৃক্ততা এবং মানের ধারাবাহিকতা। মান ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ক্রাজেসকি এবং রিজম্যান বলেছেন,
সার্বিক মান ব্যবস্থাপনা হলো সেই মতবাদ যা তিনটি নীতির উপর গুরুত্ব দেয়। এগুলো হলো ক্রেতা সন্তুষ্টি; কর্মীদের সম্পৃক্ততা এবং মানের ধারাবাহিক উন্নয়ন।
এ সম্পর্কে আবার উইলিয়াম জে. স্টেভেনসন বলেছেন,
সার্বিক মান ব্যবস্থাপনা হচ্ছে সেই মতবাদ বা দর্শন যা একটি সংগঠনের সকলের সাথে সম্পৃক্ত যা মান উন্নয়ন এবং ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।
তাই দেখা যায়, মান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো:
  • ক্রেতারা কী চায়, তা খুঁজে বের করা।
  • ক্রেতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্য বা সেবার নকশা করা।
  • নকশা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ক্রয়করণ।
  • অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চমানের কাজ - কর্ম সম্পাদন করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান লাভকরণ (বেঞ্চ মার্কিং)।
  • সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণ।
  • সকলকে সম্পৃক্ত করে উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্ধারণ।
  • সর্বোপরি ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।
পরিশেষে বলা যায়, মান ব্যবস্থাপনা বা সামগ্রিক মান ব্যবস্থাপনা হলো মানের ধারাবাহিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্রেতাদের প্রত্যাশা সন্তুষ্টিসহকারে পূরণার্থে পণ্যের নকশাকরণ, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ক্রয়করণ, উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে উন্নত জ্ঞান অর্জন, প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান এবং সকলকে সম্পৃক্ত করে উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্ধারণ। মান ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, ভোক্তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্যের মান নির্ধারণ, মান সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং মান নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় কার্যক্রমকে মান ব্যবস্থাপনা বলে।

মান ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য


গ্রাহকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্য ও সেবার মান, দাম, ডিজাইন, প্যাকিং ও উপস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে উচ্চতর দক্ষতা প্রদর্শন করে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের ব্যবস্থাপনা কৌশলকেই মান ব্যবস্থাপনা বলে। মান ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. আধুনিক দর্শন (Modern philosophy): মান ব্যবস্থাপনা হলো ব্যবস্থাপনার একটা আধুনিক দর্শন। মান ব্যবস্থাপনা বা সার্বিক মান ব্যবস্থাপনা হলো সেই মতবাদ, যা তিনটি নীতির উপর গুরুত্ব দেয়। এ তিনটি নীতি হলো- ক্রেতা সন্তুষ্টি, কর্মীদের সম্পৃক্ততা এবং মানের ধারাবাহিকতা। এটি ব্যবস্থাপনার নতুন দৃষ্টিভঙ্গির নির্দেশ করে।

 ২. গ্রাহক সন্তুষ্টি বিধান (Satisfying the customers): মান ব্যবস্থাপনার মূলকথা হলো কার্যক্রমের সকল পর্যায়ে উন্নত মান নিশ্চিত করে গ্রাহকের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সন্তুষ্টি অর্জনই মূল কথা। এ লক্ষ্যে ক্রেতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পণ্য বা সেবার ডিজাইন করা এবং তাদের প্রত্যাশার কথা চিন্তা করে কাঁচামাল ব্রুনা ও পণ্যের মান ঠিক রাখা এ ব্যবস্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।

৩. মানের ধারাবাহিক উন্নয়ন (Continuous development of quality): মান ব্যবস্থাপনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বর্তমান মানকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। বর্তমান মানকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার ও গবেষণা করা মান ব্যবস্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হয়। অর্থাৎ মানের কোনো নির্দিষ্ট পর্যায় নয় বরং প্রতিনিয়ত কার্যমানের উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে থাকাই এ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য।

৪. মান, ডিজাইন, স্থায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনা করা (Consideration of standard, design, longibility etc): পণ্যমান উন্নয়নকল্পে উত্তম পণ্যমান, দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন, উত্তম প্যাকিং, রুচিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত আরামদায়ক পণ্য, সহজ ব্যবহারযোগ্যতা, স্থায়িত্ব ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করাও মান ব্যবস্থাপনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হয়। এ বৈশিষ্ট্যের আলোকে এ ব্যবস্থাপনা পণ্যের মান নির্ধারণ করেন, ডিজাইন প্রণয়ন করেন এবং সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

৫. গ্রাহক সেবা প্রদান (Providing customer service): বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য গ্রাহক সেবা প্রদান করা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়। গ্রাহক সেবা বিবেচনায় ন্যায্য দাম, সহজে পণ্য প্রাপ্তি, উত্তম পণ্য পরিবেশনা, কর্মীদের উত্তম ব্যবহার, বিক্রয়োত্তর সেবা, উত্তম যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া মান ব্যবস্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।

৬. ব্যবস্থাপনা দক্ষতার উপর গুরুত্বারোপ (To give importance on management efficiency): এরূপ ব্যবস্থাপনা উন্নত প্রযুক্তি ও যথাযথ পদ্ধতির ব্যবহার, উপযুক্ত কর্মী জোগাড়, কর্মী উন্নয়ন ও উচ্চতর ব্যবস্থাপনা দক্ষতার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে। তাই বলা যায়, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করাও মান ব্যবস্থাপনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য হয়।

পরিশেষে বলা যায়, মান ব্যবস্থাপনা সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার একটি শাখা হওয়া সত্ত্বেও এর এমন কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যার সাহায্যে এ ব্যবস্থাপনাকে যে কোনো ব্যবস্থাপনা হতে পৃথক করা যায়। মান ব্যবস্থাপনার এ বৈশিষ্ট্যগুলো উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url